ভারতীয় উপমহাদেশে উনবিংশ শতাব্দির একটি আলোচিত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যিনি এদেশে নারীর শিক্ষার প্রচার এবং ধর্মসংস্কারক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় হিন্দুদের বিধবা বিবাহের আইন পাশ হয়েছিল। এছাড়া বাংলা গদ্যের নতুন সংস্করণ তৈরিতে তার ভূমিকা ছিল অনবদ্য। বিদ্যাসাগর সমাজ-সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ছাড়াও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অসাধারণ প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁর সম্পর্কে কিছু আকর্ষণীয় তথ্য এখানে তুলে ধরছি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮২০ সালে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে এক দরিদ্র ব্রহ্মণপরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। বিদ্যাসাগরের পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় এবং তাঁর মায়ের নাম ভগবতি দেবি। তাঁর পারিবারিক নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। যদিও তিনি রক্ষণশীল ব্রাহ্মন পরিবারের সন্তান, তথাপি, তিনি ছিলেন একজন মুক্তমনের অধিকারী। তাঁর অসামান্য দয়া, অপরিসীম উদারতা এবং সদয় আন্তরিকতার জন্য লোকেরা ‘দয়ার সাগর’ বলে সম্মোধন করতেন।
বিদ্যাসাগরকে বাংলা বিরাম বা যতিচিহ্নের জনক বলা হয়। এই মহান সংস্কারক ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই মৃত্যুবরণ করে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘বিদ্যাসাগর চরিত’।
ছোট বেলায় তাঁর শিক্ষার প্রতি অনেক আকর্ষণ ছিল। দরিদ্র পরিবারের সন্তানের কারনে পড়ালেখায় অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ঘরে আলো জ্বালানোর মত সামর্থ না থাকায় রাস্তায় লাইটের নিচে বসে পড়ালেখা চালিয়ে যান। বিদ্যাসাগর পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো ছাত্র ছিল। ১৮২৬ সালে গ্রামের পাঠশালা থেকে সংস্কৃত শিখে তাঁর পিতার সাথে কলকাতায় চলে যান। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২৯ থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত, ব্যাকরণ, সাহিত্য, স্মৃতি ও নীতিশাস্ত্র শিখেছিলেন। ১৮৪০ সালে, তিনি সংস্কৃত কলেজে একটি জ্ঞান প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহন করার মাধ্যমে ‘বিদ্যাসাগর‘ উপাধি অর্জন করেছিলেন ।
১৮৪১ সালে, তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। পাঁচ বছর থাকার পর, ১৯৪৬ সালে বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে সংস্কৃত কলেজে ‘সহকারী সচিব’ হিসাবে যোগদান করেন। তিনি সংস্কৃত কলেজে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছিলেন। পরিবর্তন আনার সুপারিশের কারনে, বিদ্যাসাগর এবং সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি রসোময় দত্তের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। যার ফলে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজ থেকে পদত্যাগ করেন এবং কেরানি হিসেবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পুনরায় যোগদান করেন।
ঈম্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তা-ধারণা নিয়ে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মূলত পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মতাদর্শ তাঁর মনের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। ফলস্বরুপ, তিনি সমাজ সেবা ও সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি এবং তাঁর সহকর্মী রামগোপাল ঘোষ এবং মদন মোহন তর্কালঙ্কারকে সাথে নিয়ে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বেশ কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বর্ণ বা লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই শিক্ষার অধিকার রয়েছে। তাই, তিনি নিম্ন বর্ণের লোকদের জন্য সংস্কৃত কলেজের প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত করেছিলেন।
সেসময় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ হাজারো কুসংস্কারের পরিবেষ্টনে আবদ্ধ ছিল। হিন্দুদের এমন ভয়ানক জাতীয় জীবনের সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় একটি ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। সমাজের এসব চিত্র বিদ্যাসাগরকে খুবই পীড়া দিত। উপমহাদেশে আবহমান কালের এসব কুসংস্কার এবং শিক্ষাবিমুখতায় তাকে সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল।
বিধবা বিবাহ প্রথা চালুর বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সব সময় সোচ্ছার ছিলেন। তাঁর একান্তিক প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার ২৬ জুলাই, ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাশ করে। তাছাড়া, তিনি বাল্য বিবাহ এবং বহু বিবাহের তীব্র বিরোধিতাও করতেন। বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার সম্পর্কিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ ও ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার’ অন্যতম।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর অবদান
ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলায় যতি চিহ্নের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, বাংলা গদ্য ছিল প্রাণহীন। বিদ্যাসাগর বাংলা সাধু ভাষার গদ্যরীতিকে পূর্ণাঙ্গরুপ দান করেন। তাঁর প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ বেতাল পঞ্চবিংশতি প্রকাশ করার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ভাষাকে জড়তা ও দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্ত করেন। তখন বাংলা সাহিত্যে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব ছিল অতিমাত্রায়। ফলে বাংলা সাহিত্য কিছু লোকের চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বিদ্যাসাগরই বাংলা ভাষাকে সেই কাঠামো থেকে বের করে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। যাতে এর রস সবাই আস্বাদন করতে পারে।
তিনি বাংলা বর্ণমালা পুনর্গঠনে বিশেষ ভুমিকা রাখেন। তাঁর অবদানে, বাংলা বর্ণমালায় ১২ টি স্বরবর্ণ এবং ৪০ টি ব্যঞ্জণবর্ণে রুপান্তর হয়। ভাষা যে শুধুমাত্র ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম নয়, তার দ্বারা যে আরো বেশি কিছু করা সম্ভব, বিদ্যাসগর প্রথম দেখিয়েছিলেন। তিনি বক্তব্যকে সরল, সহজ এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন। সাহিত্যের প্রকৃত স্বার্থকতা সৃষ্টি করেন।
পাঠ্য গ্রন্থ
সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১)
ঋজুপাঠ (১৮৫১)
বর্ণপরিচয় (১৮৫৫): এটি ছিল বাংলা বর্ণশিক্ষার প্রাথমিক বই। বইটি দুটি খন্ডে রচিত।
আখ্যানমঞ্জরী (১৮৬৩)
ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩)
অনুবাদ গ্রন্থ
বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৭): প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ।
শকুন্তলা (১৮৫৪): কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলা অবলম্বনে।
সীতার বনবাস (১৮৬০): বাল্মীকির রামায়ণ অবলম্বনে রচিত।
মহাভারত (১৮৬০)
জীবনচরিত (১৮৪৯): চেম্বার্সের বায়োগ্রাফিজ অবলম্বনে রচিত
নীতিবোধ (১৮৫১): রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্সের ‘মোরাল ক্লাস বই’ অবলম্বনে রচিত।
বোধোদয় (১৮৫২), চেম্বার্সের রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে রচিত
কথামালা (১৮৫৬): ঈশপস ফেবলস অবলম্বনে রচিত
চরিতাবলী (১৮৫৬): যা বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার অবলম্বনে রচিত
ভ্রান্তিবিলাস: শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এরস অবলম্বনে
বিদ্যাসাগরের মৌলিক গ্রন্থ
সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩): বাংলায় রচিত সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ।
বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫)
বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১৮৭১)
অতি অল্প হইল (১৮৭৩)
আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩)
ব্রজবিলাস (১৮৮৪)
প্রভাবতী সম্ভাষণ (১৮৬৩): বন্ধুর মেয়ের অকাল মৃত্যু অবলম্বনে রচিত শোকগাঁথা।
বিদ্যাসাগর চরিত (১৮৯১)
শব্দমঞ্জরী (১৮৬৪)
রত্নপরিক্ষা (১৮৮৬)
নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (১৮৮৮)
ভূগোল খগোল বর্ণনম (১৮৯২): মরনোত্তর প্রকাশিত গ্রন্থ।