কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রজন্ম

আমরা আজকে যেসকল ডিজিটাল কম্পিউটারগুলো দেখতে পাচ্ছি তা বিভিন্ন সময়ে নানা বিবর্তন, পরিবর্তন, ও প্রযুক্তিগত বিকাশেরই ফল। বর্তমান অবস্থায় পৌছাতে এসকল কম্পিউটারগুলোকে পাড়ি দিতে হয়েছিল সুদীর্ঘ পথ যাকে আমরা জেনারেশ বা কম্পিউটার প্রজন্ম বলে থাকি।
প্রথম দিকের কম্পিউটারগুলো ছিল অত্যন্ত বড় ও ভারি। যার এক একটির ওজন ছিল প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ টন এবং এগুলো এক হাজার বর্গফুট আয়তনের জায়গা দখল করত। এই কম্পিউটারগুলো পরিচালনার জন্য ১৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুত শক্তি খরচ করতে হয়েছিল।
কম্পিউটারের প্রতিটি প্রজন্ম একটি বড় প্রযুক্তিগত বিকাশ দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যা মৌলিকভাবে কম্পিউটারগুলোর পরিচালনার পদ্ধতিকে পরিবর্তন করেছিল। ফলে ক্রমবর্ধমান ছোট, সস্তা, শক্তিশালী, দক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল কম্পিউটারের আর্বিভাব ঘটে।

কম্পিউটারের প্রজন্ম

ভ্যাকুয়াম টিউব, ট্রানজিস্টর এবং মাইক্রোপ্রসেসরের মতো কম্পিউটারের বড় প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে কম্পিউটারকে পাঁচটি প্রজন্মে ভাগ করা হয়েছে।
১. প্রথম প্রজন্ম
২. দ্বিতীয় প্রজন্ম
৩. তৃতীয় প্রজন্ম
৪. চতুর্থ প্রজন্ম
৫. পঞ্চম প্রজন্ম
প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার (১৯৪০-১৯৫৬)
 
প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারে ভ্যাকুয়াম টিউব প্রযুক্তি ব্যবহার করত। ১৯৪০ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এই কম্পিউটারে ভ্যাকুয়াম টিউবের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছিল। ভ্যাকুয়াম টিউবগুলোর উপাদান বড় হওয়ার কারণে প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারগুলো আকারে বেশ বড় হয়েছিল। ফলস্বরুপ, প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার রাখার জন্য একটি বড় রুমের প্রয়োজন হত।
ENIAC ছিল প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের একটি উদাহরণ। এটি প্রায় ২০,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব, ১০,০০০ ক্যাপাসিটর এবং ৭০,০০০ রেজিস্টার নিয়ে গঠিত।  এটির ওজন ছিল ৩০ টনেরও বেশি এবং এটি বিশাল জায়গা দখল করত। প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের অন্যান্য উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে EDSAC, IBM 701, এবং Mark 1।
 

প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য

  • প্রধান ইলেকট্রনিক উপাদান হিসাবে ভালভ বা ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করত।
  • আকারে বড়, প্রক্রিয়াকরণে ধীর এবং কম সঞ্চয় ক্ষমতা ছিল৷
  • প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ এবং তাপ উৎপন্ন করত।
  • কম্পিউটিং ক্ষমতা সীমিত ছিল।
  • সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য ছিল না।
  • প্রোগ্রামিং এর জন্য মেশিন-স্তরের ভাষা ব্যবহার করত।
  • খুব ব্যয়বহুল ছিল.
  • উদাহরণ: ENIAC, EDVAC, UNIVAC, IBM 650, Markk 1 ইত্যাদি।
দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার (১৯৫৬ -১৯৬৩)
 
১৯৫৫সালের দিকে ট্রানজিস্টর নামে একটি ডিভাইস আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারে ভারী ভ্যাকুয়াম টিউবগুলোকে প্রতিস্থাপন করে। ট্রানজিস্টর ছিল ভ্যাকুয়াম টিউব থেকে ছোট এবং উচ্চ অপারেটিং গতি সম্পন্ন।
দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে ভ্যাকুয়াম টিউবের পরিবর্তে ট্রানজিস্টরের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এই কম্পিউটারগুলোতে ট্রানজিস্টর ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ট্রানজিস্টরগুলো ভ্যাকুয়াম টিউবের চেয়ে ছোট ছিল হওয়ার কারণে  কম্পিউটারগুলো আকারে ছোট, দ্রুত এবং সস্তা হয়ে যায়।
ট্রানজিস্টর ব্যবহার করা প্রথম কম্পিউটারটি ছিল TX-0 এবং এটি ১৯৫৬ সালে চালু করা হয়েছিল। দ্বিতীয় প্রজন্মে অন্যান্য কম্পিউটার যেগুলোতে ট্রানজিস্টর ব্যবহার করেছিল তার মধ্যে রয়েছে IBM 7070, IBM 1620, Philco Transac S-1000, এবং RCA 501, CDC 3600 ইত্যাদি।
দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার CPU এর উপদানগুলোর জন্য ট্রানজিস্টর এবং প্রধান মেমোরির জন্য ফেরাইট কোর এবং সেকেন্ডারি মেমোরির জন্য চৌম্বকীয় ডিস্ক ব্যবহার করে। এটি উচ্চ-স্তরের ভাষা ব্যবহার করেছে যেমন FORTRAN (1956), ALGOL (1960) এবং COBOL (1960 – 1961)।

দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য

  • ভ্যাকুয়াম টিউবের পরিবর্তে ট্রানজিস্টর ব্যবহার।
  • কাজের গতি ও নির্ভরযোগ্যতার উন্নতি।
  • প্রক্রিয়াকরণের গতি প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের থেকে দ্রুততর।
  • আকারে ছোট (৫১ বর্গফুট)
  • ইনপুট এবং আউটপুট ডিভাইসগুলো দ্রুত ছিল৷
  • টেলিফোন লাইনের মধ্যদিয়ে ডাটা প্রেরণের ব্যবস্থা।
  • উদাহরণ: IBM 1400 এবং 7000 সিরিজ, কন্ট্রোল ডেটা 3600 ইত্যাদি।
তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার (১৯৬৪-১৯৭১)
ইনট্রিগ্রেটেড সার্কিট বা আইসি এর বিকাশের মাধ্যমে তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারগুলো আত্মপ্রকাশ করে। এই আইসিগুলো চিপস নামে পরিচিত। একটি একক আইসি-তে অনেকগুলো ট্রানজিস্টর, রেজিস্টার এবং ক্যাপাসিটর থাকে যা সিলিকনের পাতলা স্লাইসের উপর নির্মিত। ফলে এই প্রজন্মের কম্পিউটারের আকার আরও হ্রাস পায়। এই সময়ের মধ্যে বিকশিত কিছু কম্পিউটার হল IBM-360, ICL-1900, IBM-370, এবং VAX-750।
তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে উচ্চ-স্তরের ভাষা যেমন বেসিক (বিগিনার্স অল-পারপাস সিম্বলিক ইন্সট্রাকশন কোড) ব্যবহার হয়েছিল। এই প্রজন্মের কম্পিউটার ছিল আকারে ছোট, সস্তা, বড় মেমোরি এবং দ্রুত প্রসেসিং ক্ষমতা সম্পন্ন। ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় সব কম্পিউটারই আইসি ব্যবহার করেছিল। আইসি আজও কম্পিউটারে ব্যবহৃত হয়।

তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য:

  • ট্রানজিস্টরের জায়গায় ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC) চিপ এর ব্যবহার।
  • সেমিকন্ডাক্টর মেমরি ডিভাইসের ব্যবহার
  • আকারে ছোট, সস্তা, বড় মেমোরি এবং দ্রুত প্রসেসিং ক্ষমতা সম্পন্ন।
  • এই প্রজন্মে মিনিকম্পিউটার চালু হয়েছিল।
  • প্রোগ্রামিংয়ের জন্য উচ্চ-স্তরের ভাষা ব্যবহার।
  • উদাহরণ: IBM 360, IBM 370 ইত্যাদি।
চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটার (১৯৭২-২০১০)
মাইক্রো প্রসেসরের আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে চতুর্থ প্রজন্ম কম্পিউটারে যাত্রা শুরু হয় যা সাধারণত CPU নামে পরিচিত। মাইক্রো প্রসেসর ও ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ব্যবহারে কম্পিউটারগুলো সহজে ডেস্কে ফিট করা যেত। সেইসাথে ল্যাপটপ কম্পিউটারের ধারণা তৈরি হয়।
মাইক্রো প্রসেসর ব্যবহার করা প্রথম দিকের কিছু কম্পিউটারের মধ্যে রয়েছে Altair 8800, IBM 5100, এবং Micral। যদিও চতুর্থ প্রজন্ম ২০১০ সালে শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করা হয় কিন্তু বর্তমান কম্পিউটারগুলোতে এখনও মাইক্রোপ্রসেসর ব্যবহার করা হয়।

চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য:

  • প্রধান সুইচিং উপাদান হিসাবে মাইক্রো প্রসেসর ব্যবহার।
  • এগুলোকে মাইক্রো কম্পিউটার বা ব্যক্তিগত কম্পিউটারও বলা হয়।
  • এর আকার ডেস্কটপ থেকে ল্যাপটপ বা পামটপে পরিবর্তিত হয়।
  • উচ্চ গতির প্রক্রিয়াকরণ, নির্ভুলতা, নির্ভরযোগ্য, এবং বহুমুখী ব্যবহার।
  • খুব বড় স্টোরেজ ক্ষমতা সম্পন্ন।
  • উদাহরণ: IBM PC, Apple-Macintosh ইত্যাদি।
পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার (২০১০ -বর্তমান)
পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial intellegence) ব্যবহার শুরু করেছে। কম্পিউটারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে সুপরিচিত উদাহরণগুললোর মধ্যে একটি হল IBM-এর Watson। অন্যান্য সুপরিচিত উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে আইফোনে অ্যাপলের সিরি এবং উইন্ডোজ ৮ এবং উইন্ডোজ ১০ কম্পিউটারে মাইক্রোসফ্টের কর্টানা।
পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারগুলো ULSI (আল্ট্রা-লার্জ স্কেল ইন্টিগ্রেশন) চিপ ব্যবহার করে। ULSI চিপগুলোতে লক্ষ লক্ষ ট্রানজিস্টরকে একটি একক আইসিতে স্থাপন করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ৬৪-বিট মাইক্রোপ্রসেসর তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া এগুলোতে ১ জিবি পর্যন্ত মেমোরি চিপ এবং ফ্ল্যাশ মেমোরি, ৬০০ জিবি পর্যন্ত হার্ড ডিস্ক এবং ৫০ জিবি পর্যন্ত অপটিক্যাল ডিস্ক এর ব্যবহার শুরু হয়। পঞ্চম প্রজন্মের ডিজিটাল কম্পিউটার হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যন্ত্র।

পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য

  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার।
  • একাধিক মাইক্রো প্রসেসর বিশিষ্ট একীভূত বর্তনী।
  • স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুবাদে সক্ষম।
  • বিশাল মেমোরি ও স্টোরেজ সুবিধা।
  • কণ্ঠস্বরে নির্দেশনা পালন।

Similar Posts