দেশের প্রাপ্ত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বন্টন অর্থাৎ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যাবলীর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলে।
যখন কোন সমাজ বা দেশ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সামাজিক ও আইনগত রীতিনীতি গড়ে তোলে, তখন তাকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলে।
নাগরিকের সম্পত্তি অর্জনের অধিকার, উৎপাদন পদ্ধতি, বিনিময় মাধ্যম, বন্টন পদ্ধতি, ভোগ, শ্রম নিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রকৃতি ইত্যাদি কার্যাবলীর প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত কাঠামোকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলে।
মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিতসা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি সকল দেশের জন্য একই, কিন্তু এগুলো পূরণ করতে বিভিন্ন দেশ তার প্রাপ্ত সম্পদের সাপেক্ষে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। এরুপ অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে নিম্মে আলোচনা করা হল।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানারকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে। তারমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কিছু বিখ্যাত ও প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিম্মে আলোচনা করা হল।
1. ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা
2. কমান্ড বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা
3. মিশ্র অর্থনীতি ব্যবস্থা
4. অন্যান্য
যে অর্থনীতি ব্যবস্থায় উৎপাদন উপকরণগুলো ব্যক্তি মালিকায় থাকে, এবং সরকারি হস্তক্ষেপ বিহীন অবাধ দাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাজার পরিচালিত হয়, তাকে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি বা পুঁজিবাদী অর্থনীতি বলে।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হল যেখানে উৎপাদনের উপকরণগুলো সরকারের পরিবর্তে ব্যক্তিগত উদ্যোগের মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রিত হয়।
ভি আই লেনিন ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি সম্পর্কে বলেন, ‘‘ধনতন্ত্র বলতে উৎপাদনের ঐ উন্নত স্তরকে নির্দেশ করে যেখানে মনুষ্য শ্রমের উৎপাদন নয়, মনুষ্য শ্রমশক্তি নিজেই পণ্যে পরিণত হয়।’’
সর্বপ্রথম ইউরোপে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়। মূলত ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউরোপ অঞ্চলে এই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা পায়। এই অর্থনীতি ব্যবস্থাকে বলা হয় স্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, কারণ প্রত্যেক ব্যক্তি উৎপাদন, বন্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। অর্থাৎ এতে কোনরুপ সরকারের হস্তক্ষেপ থাকে না।
পুঁজিবাদ বা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মুক্তবাজার বা লাইসেজ-ফায়ার অর্থনীতি। এখানে ব্যক্তিরা থাকে অবাধ। তারা নির্ধারণ করতে পারে কোথায় বিনিয়োগ করতে হবে, কি উৎপাদন বা বিক্রি করতে হবে এবং কোন মূল্যে পণ্য ও সেবা বিনিময় করতে হবে। laissez-faire বাজারে কোনরুপ চেক বা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কাজ করে। এছাড়াও এই অর্থনীতির অন্যন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন,
বৃহৎ উৎপাদন ব্যবস্থা
পুঁজিপতি শ্রেণির বিস্তার
ব্যক্তিমালিকানায় সম্পদ
ব্যক্তি উদ্যোগের স্বাধীনতা
ভোক্তার সার্বভৌমত্ব
স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থা
অবাধ প্রতিযোগিতা
মুনাফা লাভ
সমাজে শ্রেণিবিভক্তি
কমান্ড অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা নামেও পরিচিত। এই অর্থনৈতিক কাঠামোর অধীনে উৎপাদন যাবতীয় উপকরণের ক্ষমতা সরকার বা একমাত্র শাসকের কাছে কেন্দ্রীভূত থাকে।
বিভিন্ন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত যেমন কোন পণ্য উৎপাদন করতে হবে, কতটা উৎপাদন করতে হবে এবং এর দাম কি হবে, সব কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দ্বারা নির্ধারিত হয়।
অর্থনীতিবিদ র্যাগান এর মতে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হলো এমন একটি অর্খব্যবস্থা যেখানে সম্পত্তির রাষ্ট্রীয় বা কেন্দ্রীয় মালিকানায় বিদ্যামান থাকে এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
চীন, রাশিয়া, কিউবা, ভেনিজুয়েলা এবং পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে।
শ্রেণি শোষণের অনুপস্থিতি
উৎপাদন উপকরণের মালিকানা থাকে না
অবাধ প্রতিযোগিতা নেই
চাহিদার উপর নিয়ন্ত্রণ
কেন্দ্রীয় বন্টন ও নিয়ন্ত্রণ
সুষম বন্টন
শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা
বেকারত্বের লোপ
মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা
মুদ্রস্ফীতির অনুপস্থিতি
সুষম উন্নয়ন
ভোক্তার স্বাধীনতা থাকে না
ব্যক্তিগত মুনাফার স্বীকৃতি নেই
যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রের দুর্বলতাগুলো পরিত্যাগ করে এবং এর গুণগুলো গ্রহণ করে গড়ে ওঠে, তাকে মিশ্র অর্থনীতি বলে।
অর্থনীতিবিদ র্যাগান এর মতে, ‘‘মিশ্র অর্থনীতি হল এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে বিশুদ্ধ ধনতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সংমিশ্রণ ঘটে। কিছু সম্পদ ব্যক্তি মালিকানায় এবং কিছু সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকে। এছাড়া অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত বাজার ব্যবস্থা ও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে।’’
মিশ্র অর্থনীতি বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সবচেয়ে সাধারণ রূপগুলোর মধ্যে একটি। অনেক উন্নত দেশ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, বাংলাদেশ, ভারত এবং বেশিরভাগ ইউরোপে এই অর্থনীতি ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। এটি পুঁজিবাদী ও কমান্ড অর্থনীতির সংমিশ্রণ ব্যবস্থাকে নির্দেশ করে।
মিশ্র অর্থনীতি ব্যবস্থায় প্রায়শই উৎপাদনের উপকরণগুলো কিছু ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্র্রীয় মালিকানায় থাকে। যাইহোক, মিশ্র অর্থনীতিতে কিছু শিল্প কলকারখানা সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, অন্যগুলো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্যসেবা ও বিবিসির সম্প্রচার সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিস্তার
সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ
সম্পদের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানা
স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থা
অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ
মুদ্রস্ফীতির উপস্থিতি
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
সামাজিক নিরাপত্তা
অসম বন্টন ব্যবস্থা