মৌলিক গণতন্ত্র কাকে বলে?
মৌলিক গণতন্ত্র হল এমন এক ধরণের সীমিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা যেখানে সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রদানের পরিবর্তে কিছু সংখ্যক নির্ধারিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জাতীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের করা হয়।
মৌলিক গণতন্ত্র (Basic Democracy) হলো জেনারেল আইয়ুব খানের এক অভিনব শাসন ব্যবস্থা। ১৯৫৮ সালে এক সামরিক অভ্যূত্থান ঘটিয়ে আইয়ুব খান পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করে। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে ২৬ অক্টোবর ক্ষমতা গ্রহণের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মৌলিক গণতন্ত্র নামে এক ধরণের শাসন ব্যবস্থার আদেশ জারি করেন। তাই আইয়ুব খানকে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার প্রবর্তক বলা হয়।
আইয়ুব খান পাকিস্তানের উভয় প্রদেশে নতুন চার স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করেন। মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা একাধিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য গঠন করা হয়েছিল।
এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে এটি জনগণের ইচ্ছাকে সরকারের কাছাকাছি এবং সরকারী কর্মকর্তাদেরকে জনগণের কাছাকাছি এনে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্পন্ন করবে। আইয়ুব খান বলেন, ”It will be a foundation stone of a new political system in the country.” অর্থাৎ এটি হবে দেশে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর।
মৌলিক গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
মৌলিক গণতন্ত্র ছিল একটি চার স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন কাঠামো যার মধ্যে রয়েছে: ইউনিয়ন কাউন্সিল, থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, এবং বিভাগীয় কাউন্সিল।
১. ইউনিয়ন কাউন্সিল
ইউনিয়ন কাউন্সিল ছিল মৌলিক গণতন্ত্রের সর্বনিম্ন স্তর। ৫ থেকে ৮ টি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠিত হয় যার জনসংখ্যার সীমা ছিল প্রায় ১০,০০-১৫,০০০ জন। পৌর এলাকায় এটির নাম ছিল ইউনিয়ন কমিটি এবং ছোট শহরে এর নাম ছিল টাউন কমিটি। সর্বমোট ১৫ জন সদস্য নিয়ে একটি ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠিত। এর মধ্যে ১০ জন জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হত, বাকি ৫ জন মনোনীত। কিন্তু ১৯৬২ সালে এই মনোনয়ন পদ্ধতি বাতিল করা হয়।
ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যরা নিজের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতেন। পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মোট ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীর (Basic Democrats) সংখ্যা নির্ধারিত হয় যারা পরবর্তীতে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচনে অথবা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইলেক্টরাল কলেজ হিসেবে কাজ করে।
আরো পড়ুন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য
কার্যাবলী: এই কাউন্সিলগুলোর সদস্যদেরকে বিচার বিভাগীয়, অর্থনৈতিক, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন উন্নয়নের মতো বিভিন্ন কার্যভার দেওয়া হয়। সবশেষে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য এই ইউনিয়ন পরিষদকে ইলেক্টোরাল কলেজে রূপান্তর করা হয়।
২. থানা কাউন্সিল
মৌলিক গণতন্ত্রের স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার দ্বিতীয় স্তর ছিল থানা কাউন্সিল। এই পরিষদে কোনো নির্বাচন হত না। এটি কিছু অফিসিয়াল এবং কিছু বেসরকারী সদস্য নিয়ে গঠিত। বেসরকারী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন থানার অন্তর্গত সকল ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং অফিসিয়াল সদস্যদের মধ্যে ছিলেন থানার সকল সরকারি কর্মকর্তা। অফিসিয়াল সদস্য সংখ্যা ছিল বেসরকারী সদস্যদের সমান। এই থানা কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন মহকুমা প্রশাসক।
কার্যাবলী: এটি থানার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলের মধ্যে এবং জেলা একটি সমন্বয়কারী সংস্থা হিসাবে কাজ করত।
৩. জেলা কাউন্সিল
থানা কাউন্সিলের ওপরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর ছিল জেলা কাউন্সিল। এর সদস্য সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৪০ জন যার অর্ধেক সদস্য ছিল সরকারী কর্মকর্তা এবং বাকি অর্ধেক নির্বাচিত প্রতিনিধি। এসব নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানদের থেকে নির্বাচিত হত। অফিসিয়াল বা সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল এস ডি, নির্বাহী প্রকৌশলী, জেলা কৃষি কর্মকর্তা, বন বিভাগীয় কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন, বিদ্যুত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, জেলা আনসার এডজুটেন্ট, এবং সহকারী রেজিস্টার ইত্যাদি।
কার্যাবলী: জেলা কাউন্সিল আর্থিক এবং নির্বাহী ক্ষমতা সম্পাদন করত। এছাড়া জেলার অন্তর্গত বিভিন্ন উন্নয়ন ফাংশন এবং কর আরোপ করতে নিয়োজিত ছিল। জেলা প্রশাসকের কার্যাবলী ও ক্ষমতা ২ ভাগে বিভক্ত ছিল।
- বাধ্যতামূলক: বাধ্যতামূলক ফাংশন সমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল বিদ্যালয়, গ্রন্থাগার হাসপাতাল, পাবলিক রাস্তা, খেলার মাঠ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষণাবেক্ষণ।
- ঐচ্ছিক: ঐচ্ছিক ফাংশনগুলোর মধ্যে রয়েছে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা, মানুষের সংস্কৃতি, সামাজিক, অর্থনৈতিক কল্যাণ নিশ্চিত।
৪. বিভাগীয় কাউন্সিল:
মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তর ছিল বিভাগীয় কাউন্সিল। সর্বমোট ৪৫ জন সদস্য নিয়ে বিভাগীয় কাউন্সিল গঠিত হয় যাদের অর্ধেক ছিল সরকারী কর্মকর্তা এবং বাকি অর্ধেক ছিল জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধিবর্গ। বেসরকারী সদস্যদের প্রায় অর্ধেক ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে নির্বাচিত হতেন।
বিভাগীয় কমিশনার তার পদাধিকার বলে বিভাগীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিভাগীয় কাউন্সিলের কার্যালীর মধ্যে ছিল বিভিন্ন জেলা কাউন্সিলের সাথে সমন্বয় করা।