সিপাহী বিদ্রোহ কি?
সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ১৮৫৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি সহিংস এবং অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ। এটিকে ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহ বা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনও বলা হয়।
ইংরেজরা বন্ধুকের কার্তুজ শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরি করেছে, এমন গুজবে মুসলমান ও হিন্দুরা তাদের ধর্ম বিনষ্ট করার অভিযোগে ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ সূচনা করে ইতিহাসে তা সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
১৮৫৭ সালের ১০ মে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনী এবং বাঙ্গালি সিপাহিদের মধ্যে সিপাহি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। এটিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, মহাবিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ নামেও অভিহিত করা হয়। এই বিদ্রোহ দমনকালে ইংরেজ বাহিনী নির্মমভাবে বহু নিরপরাধ নরনারী, শিশু, বৃদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করে।
রাজধানী দিল্লির বাইরে ৪০ মাইল দূরে মিরাট নামক একটি সেনানিবাসে বিদ্রোহ শুরু হয়ে পরবর্তীতে উত্তর ও মধ্য ভারত জুড়ে দিল্লি, আগ্রা, কাউনপুর, গোয়ালিয়র এবং লখনউয়ের মতো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। পরিশেষে, ৮ জুলাই ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশরা এই অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার করলে বিদ্রোহের অবসান ঘটে।
সিপাহী বিদ্রোহের কারণ
১৮৫০ সালে সংগঠিত সিপাহী বিদ্রোহের ৪টি প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সামাজিক। নিম্মে সিপাহী বিদ্রোহের প্রধান কারণসমূহ আলোচনা করা হল।
১. রাজনৈতিক কারণ:– ১৮৪০-এর দশকের শেষের দিকে, লর্ড ডালহৌসি তামাদি মতবাদ আরোপ করেন। বৃটিশ নীতির তামাদি মতবাদ বা ডকট্রিন অফ ল্যাপস (Doctrine of Lapse) এর অধীনে কোনো পুরুষ উত্তরাধিকারী ছাড়া শাসক মারা গেলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে রাজ্যটি সংযুক্ত করা হবে।
ডকট্রিন অফ ল্যাপস নীতির অধীনে, কোম্পানী ১৮০০-এর দশকে ভারতের ২৫টিরও বেশি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। এই নীতির অর্থ ছিল যে ব্রিটিশরা যদি সেই রাজ্যগুলির শাসকদের ‘অযোগ্য’ বলে মনে করে বা যদি তাদের উপযুক্ত উত্তরাধিকারী না থাকে, তাহলে কোম্পানী অঞ্চলটি দখল করতে পারে এবং সরাসরি নিজেরাই শাসন করতে পারবে।
আরো পড়ুন, ওয়াহাবী আন্দোলন কি? ওহাবী আন্দোলনের ইতিহাস
২. অর্থনৈতিক কারণ:– ভারতের কৃষক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশদের বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম দ্বারা শোষিত হচ্ছিল এবং সেইসাথে অতিরিক্ত কর দিতেও বাধ্য হয়েছিল। সুতরাং, যারা ট্যাক্স বা কর দিতে অক্ষম ছিল তাদের জমি ব্রিটিশদের কাছে সমর্পণ করতে হত। এছাড়া ব্রিটিশদের আধুনিক মেশিনে তৈরি পণ্যের সাথে ভারতীয় হস্তশিল্পের পণ্যগুলো প্রতিযোগিতা করতে হয়। ব্রিটিশদের সাথে স্থানীয়দের এই অসম প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন সংস্কার, এবং অতিরিক্ত কর ইত্যাদির কারণে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়।
৩. সামরিক কারণ:– ইআইসি বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধের জন্য ব্রিটিশ সৈন্যের পাশাপাশি স্থানীয় ভারতীয়দের নিয়োগ করা হয়। ভারতীয় সিপাহীদের বেতন ইউরোপীয় সিপাহীদের তুলনায় ছিল অনেক কম। বেতন, পেনশন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ইউরোপীয় সৈন্য ও সিপাহিদেরকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। ফলে, সামরিক ক্ষেত্রে ভারতীয়রা বৈষম্যের স্বীকার সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত।
৪. সামাজিক কারণ:– ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ বাতিল এবং বিধবা পুনর্বিবাহকে উৎসাহিত ইত্যাদি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জন্য হুমকি হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। ব্রিটিশরা চেয়েছিল হিন্দু ও মুসলিম ধর্মকে খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত করা হোক।
মিরাটে ভারতীয় সৈন্যদের দেওয়া নতুন এনফিল্ড রাইফেলগুলোকে ঘিরে একটি বিতর্ক থেকে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৮৫৭ সালের মে মাসে, রাজধানী দিল্লির অদূরে মিরাট নামক একটি সেনানিবাসে নতুন এনফিল্ড রাইফেলের জন্য বুলেট কার্তুজগুলো শুকর এবং গরু থেকে প্রাপ্ত পশুর চর্বি দিয়ে গ্রীস করা হয়েছিল। গ্রীস করা কার্তুজগুলো দাঁত দিয়ে উপরের অংশটি কামড় দিয়ে খুলতে হয়েছিল।
যাইহোক, সিপাহীরা ছিল মুসলিম এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের। যেখানে মুসলিমদের শূকরের চর্বি খাওয়া নিষিদ্ধ এবং হিন্দুদের গরুর। এমতবস্থায়, সিপাহীরা ধর্মীয় কারণে চর্বিযুক্ত গোলাবারুদে মুখ লাগাতে অমান্য ও অস্বীকার করেছিল। এর ফলে, তখন সিপাহীদের অনেককে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এসকল কারণে কোম্পানীর সৈন্যদের প্রতি সিপাহীদের আক্রোশ বেড়ে যায়।
সিপাহী বিদ্রোহের ফলাফল
- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তার কর্তৃত্ব হারায় এবং ব্রিটিশ সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে শাসন অব্যাহত রাখে। ফলে এটি ব্রিটিশ সরকারের উপনিবেশে পরিণত হয়।
- ১৮৫৮ সালে ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়া একটি ঘোষণায় ভারতের ধর্মীয় ঐতিহ্য বা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
- ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহে যে সম্প্রদায়গুলো ব্রিটিশদের অনুগত ছিল তাদের ব্রিটিশ সরকার “মার্শাল রেস” হিসাবে চিহ্নিত করেছিল এবং তাদেরকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রচুর পরিমাণে নিয়োগ দেওয়া হয়।
- সিপাহী বিদ্রোহের পর, ব্রিটিশ সরকার ভারতের জন্য একটি নতুন নগর পরিকল্পনার ব্যবস্থা তৈরি করেছিল যা স্থানীয় লোকদের থেকে শ্বেতাঙ্গদের পৃথকীকরণে ভূমিকার রাখে।
- রাজ্যের আমলাতন্ত্র নতুন সরকারি অফিস এবং স্থানীয় জনগণের নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রসারিত হয়।
সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে আরো প্রশ্ন,
সিপাহী বিদ্রোহের নেতা কে ছিলেন?
সিপাইী বিদ্রোহের নেতা ছিলেন মঙ্গল পাণ্ডে। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ উপমহাদেশের প্রথম ইংরেজ বিরোধী অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন সিপাহী মঙ্গল পাণ্ডে। সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ ছিল মঙ্গল পাণ্ডে।
সিপাহী বিদ্রোহ কোথায় হয়েছিল?
সিপাহী বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ার প্রধান স্থানসমূহ হল, মিরাট, দিল্লী, কানপুর, লক্ষ্নৌ, ঝাঁসি এবং গোয়ালিয়র।