নীল বিদ্রোহ কি? নীল বিদ্রোহের কারণ কি

নীল বিদ্রোহ কি?

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নীলচাষিরা নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তা ইতিহাসে ‘নীল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। ১৮৫৯ – ৬০ সালে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদেশী নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই বিদ্রোহকে Blue Mutiny নামেও অভিহিত করা হয়।
‘নীল’ হলো গুল্ম জাতীয় এক প্রকার উদ্ভিদ। এটি শীম পরিবারভুক্ত একটি উদ্ভিদ। এর অন্যান্য স্থানীয় নাম: নিলিনী, রঞ্জনী, গ্রামিনিয়া, কালোকেশী, নীলপুষ্প, এবং মধুপত্রিকা। নীল এর বৈজ্ঞানিক নাম: Indigofera tinctoria
নীল এক প্রকার উদ্ভিদ যা থেকে নীল রং তৈরি হয়। মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম নীল রং তৈরির আগে, প্রাকৃতিক নীল রং অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। বিশেষ করে, ইউরোপে শিল্প বিপ্লবে কারণে বস্ত্র শিল্পে নীলের ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পায়। সেসময় ভারতীয় উপমহাদেশে এই প্রাকৃতিক নীল রং চাষ করা হত।
ভারত উপমহাদেশের মাটি নীল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায়, বৃটিশ নীলকরেরা নীলচাষে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে। নীল বিশেষ করে নদীয়া, যশোর, বগুড়া, রংপুর প্রভৃতি জেলায় চাষ করা হত।
প্রথমদিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। কিন্তু ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের ফলে তাঁদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করে। তখন থেকেই মূলত কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়।
ফলে, ১৮৫৯ ফেব্রুয়ারী – মার্চ মাসে নীলচাষীরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে নীল চাষ করতে অস্বীকৃতি জানায়। যদিও, প্রথমদিকে এই আন্দোলন অহিংস ছিল, কিন্তু নীলচাষ না করার কারণে চাষীদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার শুরু হলে, আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়।
নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে ‘নীল কমিশন’ গঠন করে। এই কমিশন সরেজমিনে তদন্ত করে চাষিদের অভিযোগ যথার্থ বলে অভিমত দেয়। ফলে সরকার নীলচাষের ওপর একটি আইন পাস করেন। ফলস্বরুপ, ১৮৬২ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। সর্বশেষ, ১৯০০ সালের মধ্যে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণভাবে নীলচাষের অবসান ঘটে।

নীল বিদ্রোহের কারণ

১৮ শতকে, ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সময়, ব্রিটিশ টেক্সটাইল শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই শিল্পের বৃদ্ধির ফলে, ব্রিটেনে নীল কাপড় তৈরির জন্য নীলের চাহিদা বেড়ে যায়। আটারো শতকের শেষের দিকে, আমেরিকা থেকে নীলের সরবরাহ কমে যায়। ফলস্বরূপ, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা ও বিহারের কৃষকদের লাভজনক নীল শিল্পের বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করে।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে নীল ব্যবসায় ছিল খুবই লাভজনক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ইউরােপীয় বণিকদের হাতে নীল ব্যবসায়ের একচেটিয়া অধিকার তুলে দেন। ১৮৩৩ সালে সনদ আইনে ভারতে এসে যে কোন ব্রিটিশ নাগরিক নীল চাষ করার অধিকার পেতেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই নীল চাষের মালিকানা ছিল নীলকর সাহেবদের হাতে।
নীল চাষের জন্য বিভিন্ন কুঠি স্থাপিত হয়। কৃষকদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ নিয়ে তার জমিতে নীল চাষের ব্যবস্থা করা হত। এই দাদনের পরিমাণ ছিল নগণ্য। কিন্তু কৃষকদের শ্রম ও অর্থ দিয়ে নীল চাষ করতে হত। এইভাবে নীলচাষীদের শােষণের ওপর নীল সাহেবরা মুনাফা লুটতে লাগল। অর্থনৈতিক শােষণের পাশাপাশি ছিল গরীব চাষীদের উপর নির্মম অত্যাচার।
কোন চাষী নীল চাষ করতে অসম্মত হলে তার উপর অকথ্য অত্যাচার চলত। এই সব অত্যাচার ও শােষনে বিরুদ্ধে নীলচাষীরা বাধ্য হয়ে বিদ্রোহের পথে অগ্রসর হয়। ১৮৫৯ – ৬০ সালে যশাের, খুলনা, চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, ফরিদপুর, পাবনা প্রভৃতি জেলায় প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কৃষক এই বিদ্রোহে সংশ্লিষ্ট হয়।
প্রথম দিকে বিদ্রোহ ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু নীল সাহেবদের দমন নিপীড়নের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে কৃষকেরা মরিয়া হয়ে নীলকরদের কুঠি আক্রমণ করে। নীল বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস। তারা এক সময়ে নীলকুঠির দেওয়ান ছিলেন কিন্তু প্রজাদের ওপর অত্যাচারে বিচলিত হয়ে তাঁর প্রজাদের সমবদ্ধ করতে অগ্রসর হন।
নীল বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল কোনো চাষির ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীলচাষ করানো। ফলে, নীলকরদের অত্যাচার, লুষ্ঠন, শোষণ বেড়ে যায়। নীলকর সাহেবেরা সব সময় কৃষককে উৎকৃষ্ট জমিতে নীলচাষ করিয়ে নিত। কোনো কৃষকই তাদের খাদ্যশস্য ছেড়ে ওই উৎকৃষ্ট জমিতে নীল চাষে আগ্রহী ছিল না।
১৮৩০ সালে ব্রিটিশ সরকার পঞ্চম আইন পাস করে ঘোষণা করে যে, কোন কৃষক দাদন নিয়ে নীল চাষ না করলে নীলকর সাহেবরা কৃষকদের কয়েদ করতে ও তাদের অস্থায়ী সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। এই আইন পাসের ফলে, নীল চাষীদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং নীলকর সাহেবদের বেআইনি ও হিংসাত্মক কাজের ফলে কৃষকরা প্রায় ভূমিদাসে পরিণত হয়। এই কারণে পঞ্চম আইন নীলচাষীদের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
১৮৫৯-৬০ সালে, উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলা অঞ্চলে নীল চাষীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ব্যাপক সহিংস বিদ্রোহটি নীল বিদ্রোহ বা নীল দাঙ্গা নামে পরিচিত ছিলো।

Similar Posts