সার্বভৌমত্ব কি?
সার্বভৌমত্বের ধারণা জাতি-রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে স্থায়ীভাবে জড়িত। সার্বভৌমত্ব একটি ইংরেজি শব্দ যা ল্যাটিন শব্দ “সুপার অ্যানাস” থেকে উদ্ভূত যার অর্থ ‘উচ্চতর’ বা ‘সুপার মোস্ট’।
পনের শতকে, ফরাসি আইনবিদ “সার্বভৌম” এবং “সার্বভৌমত্ব” উভয় শব্দই ব্যবহার করেছিলেন। প্রথমবারের মতো, ১৯৭৫ সালে জিন বোডিনের “দ্য রিপাবলিক” প্রকাশনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানে “সার্বভৌমত্ব” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান তত্ত্বে সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় এবং শৃঙ্খলা রক্ষায় চূড়ান্ত তত্ত্বাবধায়ক বা কর্তৃত্ব। সার্বভৌমত্বের ধারণা – রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক আইনের সবচেয়ে বিতর্কিত ধারণাগুলোর মধ্যে একটি। এটি রাষ্ট্র ও সরকার এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কঠিন ধারণাগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব সেই ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে অর্পণ করা হয় যার একটি আইন প্রতিষ্ঠা বা বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করার জন্য অন্য লোকেদের উপর চূড়ান্ত কর্তৃত্ব রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনে, সার্বভৌমত্ব হল একটি রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষমতার প্রয়োগ। ডি জুরে সার্বভৌমত্বের আইনি অধিকারকে বোঝায়; ডি ফ্যাক্টো সার্বভৌমত্বের বাস্তব ক্ষমতা বোঝায়।
সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা
রাষ্ট্রবিজ্ঞান তত্ত্বে সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় এবং শৃঙ্খলা রক্ষায় চূড়ান্ত তত্ত্বাবধায়ক বা কর্তৃত্ব।
হ্যারল্ড লাস্কির মতে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য সার্বভৌমত্ব হল রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা।
জন অস্টিন এর মতে, যদি একটি নির্দিষ্ট সমাজে একটি নির্দিষ্ট কর্তৃত্ব থাকে বা যারা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুগত নয় কিন্তু সেই সমাজের সকল মানুষের সাধারণ আনুগত্য থাকে, তবে তা উচ্চতর কর্তৃত্বকে সার্বভৌম বলা হয় এবং সেই সার্বভৌম কর্তৃত্ব সম্পন্ন সমাজ একটি স্বাধীন ও রাজনৈতিক সমাজ।
Willoughby এর মতে, “সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ইচ্ছা।”
ওপেনহেইম বলেছেন, “সার্বভৌমত্ব হল সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব, এমন একটি কর্তৃত্ব যা অন্য কোন পার্থিব কর্তৃত্ব থেকে স্বাধীন।”
কেলসেন মতে, “এর আসল এবং একমাত্র নির্দিষ্ট অর্থ সার্বভৌমত্ব মানে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব”
ব্রুগেস, “রাষ্ট্রের নাগরিকদের উপর সবচেয়ে বেশি, আসল, চিরন্তন এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা।”
জে জে রুশো, “সার্বভৌমত্ব একটি পরম, অবিভাজ্য, এবং অবিচ্ছেদ্য শক্তি।”
সার্বভৌমত্বের প্রকারভেদ
সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে নিম্নরূপ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- প্রকৃত এবং নামমাত্র সার্বভৌমত্ব
- অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব
- আইনি ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব
- ডি জুরে এবং ডি ফ্যাক্টো সার্বভৌমত্ব
- জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব
১. প্রকৃত এবং নামমাত্র সার্বভৌমত্ব (Real and Titular Sovereignty)
প্রাচীনকালে অনেক রাষ্ট্রে রাজারা প্রকৃত সার্বভৌমত্ব চর্চা করতো। ফরাসি বিপ্লবের পর এটির পরিবর্তন হয়। আধুনিককালে, অধিকাংশ রাষ্ট্রে মন্ত্রী পরিষদকে প্রকৃত সার্বভৌম হিসাবে বিবেচনা করা হয় যখন রাজা শুধুমাত্র নামমাত্র ক্ষমতা ভোগ করে।
নামমাত্র সার্বভৌম শুধুমাত্র নামে একজন শাসক, কিন্তু বাস্তবে কোন কার্যকর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম নয়। ব্রিটেনের রানী, জাপানের রাজা এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি টাইটেলার বা নামমাত্র সার্বভৌমত্বের উদাহরণ।
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ উৎস, দেশের ঐক্য ও ঐতিহ্যের প্রতীক, এবং সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী ইত্যাদি হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী জনগণ।
২. অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব (Internal and External Sovereignty)
অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা যার দ্বারা রাষ্ট্র তার সমস্ত ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং প্রতিষ্ঠানের উপর চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে। আইন হল রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সার্বভৌমের চূড়ান্ত আদেশ। এই আইন অনুসারে রাষ্ট্রের কার্যাবলী পরিচালিত হয়। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমে আইন ভঙ্গকারীকে কঠোর শাস্তি দিতে পারে।
বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে বোঝায় যার দ্বারা কোন রাষ্ট্র কোন বিদেশী রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের অর্থ হল রাষ্ট্র বহিরাগত শক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ইচ্ছা ও নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
৩. আইনগত ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব (Legal and Political Sovereignty)
আইনগত সার্বভৌমত্ব হল রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ক্ষমতা যার দ্বারা রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে এবং তা প্রয়োগ করে। আইনগত সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্রের অবাধ ক্ষমতা; কেউ তা অমান্য করতে পারে না। ব্রিটেন, ভারত এবং বাংলাদেশে আইনগত সার্বভৌম ক্ষমতা রয়েছে। এই সার্বভৌমত্বকে আইনসভার চূড়ান্ত ক্ষমতা হিসাবে দেখা হয়।
রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের অস্তিত্ব প্রকাশ্য নয়। সাধারণভাবে বলতে গেলে, ভোটারদের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব রয়েছে। রাজনৈতিক সার্বভৌম ইচ্ছা নিজেকে একটি বৈধ সার্বভৌম আইনে রূপান্তরিত করে। জনমত এবং জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আইনগত সার্বভৌম তার সিদ্ধান্ত নেয়।
৪. ডি জুরে এবং ডি ফ্যাক্টো সার্বভৌমত্ব (De Jure and De Facto Sovereignty)
ডি-ফ্যাক্টো সার্বভৌম হল সেই ব্যক্তি যার সার্বভৌমত্বের কোন আইনি দাবি নেই কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটির অধিকারী এবং এর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগ করে।
ডি-জুর সার্বভৌম হল সেই ব্যক্তি যার সার্বভৌমত্বের আইনি দাবি আছে কিন্তু বাস্তবে তার অধিকার নেই।
৫. জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব (Popular Sovereignty)
জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব মানে সার্বভৌমত্ব জনগণের হাতে। সরকারের শাসন ক্ষমতার ভিত্তি হচ্ছে জনসমর্থন। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যমে প্রথম জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বের আহ্বান প্রতিফলিত হয়েছিল।
ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লবে (১৬৮৮) জনগণের সার্বভৌমত্বের আংশিক প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য করা যায়। জন লকের সিভিল গভর্নমেন্টের দুই ট্রিটিসিসে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে রাজার শাসন জনগণের সম্মতির উপর নির্ভর করে।
ফরাসি বিপ্লবে জনগণের সার্বভৌমত্বের দাবি ছিল। রুশোর চিন্তাধারাও জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বের সুস্পষ্ট পরিচয়ের সাথে মিলে যায়।
জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বের নীতি আমেরিকার স্বাধীনতায় আন্দোলনেও (1776) জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এছাড়া রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লব (১৯১৭) এবং চীনে গণবিপ্লব (১৯৪৯) জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে দুটি সফল পদক্ষেপ চিহ্নিত করে।
সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য
সার্বভৌমত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ:
১. পরমতা
পরমতা বলতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং বাইরে সার্বভৌমত্বের চেয়ে উচ্চতর কোনও আইনি ক্ষমতা নেই। কিছু আধুনিক চিন্তাবিদ এবং আইনবিদদের মতামত যে আন্তর্জাতিক আইন এটির চেয়েও উচ্চতর, অন্যরা তা মনে করে না।
সার্বভৌম ক্ষমতা একটি রাষ্ট্রের অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতার চেয়ে উচ্চতর। সার্বভৌমত্ব হল অতি সর্বাধিক এবং সীমাহীন শক্তি যা কোন প্রকার নির্দেশনার অধীন নয়। সমস্ত রাষ্ট্রীয় নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠান এটির উপর অধিষ্ঠিত এবং এটি কোনও অভ্যন্তরীণ বাহ্যিক শক্তি বা চাপমুক্ত সমস্ত ক্ষমতার উত্স।
২. স্থায়ীত্ব
রাষ্ট্র স্থায়ী এবং সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য উপাদান, তাই এটিও স্থায়ী, অন্তত রাষ্ট্রের মতো।
৩. সর্বজনীনতা
সার্বভৌমত্বের এই বৈশিষ্ট্যটি বোঝায় যে রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রেণী, সংগঠন বা সমিতি সার্বভৌম কর্তৃত্বের বাইরে কিন্তু সবই তার নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের অধীনে। সার্বভৌমত্বের সর্বজনীনতাও বোঝায় যে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ব্যক্তি এবং জনজীবনের প্রতিটি বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারেন।
৪. অ-হস্তান্তরযোগ্য
সার্বভৌমত্ব হস্তান্তর বা স্থায়ীভাবে অন্য কোনো রাষ্ট্র, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অর্পণ করা যাবে না। একজন মানুষকে যেমন তার ধ্বংস বা মৃত্যু ছাড়া তার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, তেমনি সার্বভৌমত্বকেও বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। সার্বভৌমত্ব তার ধ্বংস ছাড়া এমনকি যদি একটি রাষ্ট্র স্বেচ্ছায় ভূখণ্ডের একটি নির্দিষ্ট অংশ অন্য রাষ্ট্রকে ছেড়ে দেয়, তবে এটি তার সার্বভৌমত্বকে প্রভাবিত করে না। মানুষের জীবন যেমন অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করা যায় না, তেমনি সার্বভৌমত্ব হস্তান্তর করা যায় না।
৫. অবিভাজ্যতা
সার্বভৌমত্বের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এটি অবিভাজ্য। সার্বভৌম ক্ষমতা বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্পণ করা যেতে পারে কিন্তু এসব অঙ্গ বা একক সার্বভৌমত্ব নয়। মানবদেহকে যেমন বিভক্ত করা যায় না এবং এর বিভাজন তার মৃত্যু, সার্বভৌমত্বেরও বিভাজন তার মৃত্যুর সমান এবং এর বিভাজন অসম্ভব।
৬. অনন্য
সার্বভৌমত্ব একটি রাষ্ট্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং এটিই সার্বভৌমত্ব যা একটি রাষ্ট্রকে পবিত্র এবং অন্যান্য সমস্ত মানব প্রতিষ্ঠানের উপরে স্থান দেয়। রাষ্ট্র মানুষের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান এবং মানব সভ্যতার শীর্ষ বিন্দু। রাষ্ট্রে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌম ক্ষমতা নেই শুধুমাত্র রাষ্ট্রের রয়েছে। সুতরাং, এটি একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য যা রাষ্ট্রকে স্বতন্ত্র এবং উচ্চতর মর্যাদা দেয়।
৭. সার্বভৌম কর্তৃত্বই চূড়ান্ত।
৮. সার্বভৌম ক্ষমতা শাশ্বত এবং সীমাহীন ক্ষমতা।
৯. সার্বভৌমত্ব আইনের ঊর্ধ্বে এবং আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না।
১০. সার্বভৌমত্ব একটি মৌলিক শক্তি, প্রদত্ত ক্ষমতা নয়।
১১. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অপরিবর্তনীয়।