কল্যাণমূলক রাষ্ট্র কি? এর সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র কি?

প্রতিটি রাষ্ট্রের সরকারের দায়িত্ব তার নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবিচার থেকে রক্ষা করা এবং তাদের মর্যাদা রক্ষা করা। সকল সরকারী প্রকল্প এবং নীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা এবং বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য পরিবেশ প্রদান করা।
যাইহোক, কিছু দেশে, সরকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার বিধান এবং তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। যে দেশগুলো তাদের নাগরিকদের কল্যাণ প্রচার করে তাদের কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা ব্যবহার করে এমন দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন, অস্ট্রিয়া, গ্রীস, জাপান, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, কুয়েত, ইসরায়েল, স্লোভেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, ইসরায়েল, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সকলের জন্য সমান সুযোগ, সম্পদের সুষম বন্টন এবং জনগণের অংশগ্রহণের নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং পেনশন পরিকল্পনা সহ প্রদত্ত পরিষেবার জন্য সরকার থেকে তহবিল গঠন করে। দেশে আয়ের বৈষম্য কমাতে বড় আয়করের ট্যাক্স থেকে এই তহবিল প্রাপ্ত হয়। আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র, কল্যাণমূলক এবং পুঁজিবাদ। আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে নর্ডিক দেশ (নরওয়ে, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড), জার্মানি, ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ড। উন্নত কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে; উদার, সামাজিক গণতান্ত্রিক এবং রক্ষণশীল।
ইতিহাস
সামাজিক নিরাপত্তা আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সামাজিক নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও এর প্রেক্ষাপট অতি পুরোনো। সামাজিক নিরাপত্তা আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অপরিহার্য কার্যক্রম হলেও প্রাচীন আমলে-এর প্রচলন ছিল। প্রাচীন মিসর, গ্রিস, রোম, চীন, এবং ভারতে এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২২ সালে স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে যে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, খোলাফায়ে রাশেদীনের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তার সুপথ প্রদর্শিত হয়ে দীর্ঘদিন মানবকল্যাণে ভূমিকা রেখেছিল।
ইংল্যান্ডে ১৫৩১ ও ১৬০১ সালে দরিদ্র আইন। জার্মানির চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্ক ১৮৮৩ সালে সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেন এবং ১৯১৭ সালে বলশেভিক তথা রুশ বিপ্লবের পর সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন ভাবনা দেখা যায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ১৯৩৫ সালে সামাজিক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেন। এ ছাড়া ১৯৪২ সালে যুক্তরাজ্যে লর্ড উইলিয়াম বিভারেজ কর্তৃক প্রণীত রিপোর্টের ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তা আইন ও কর্মসূচি তৈরি হয়।
১৮৮০-এর দশক থেকে পশ্চিমা দেশগুলোতে শিল্পায়নের ফলে এটি বিকাশ লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ(১৯১৪-১৮), মহামন্দা(১৯২৯-৩৯) এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে(১৯৩৯-৪৫) কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের সূচনার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ রূপ বিকশিত হয়। বর্তমান বিশ্বে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বিভিন্ন বিমা ও সাহায্যভাতার প্রচলন দেখা যায়।

কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হল শাসনের একটি উপায় যেখানে রাষ্ট্র বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠী তার নাগরিকদের জন্য মৌলিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করে।
একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে, সরকার তার নাগরিকদের ব্যক্তি ও সামাজিক কল্যাণের জন্য দায়ী।
কল্যাণ রাষ্ট্র হল সরকারের একটি রূপ যেখানে রাষ্ট্র সমান সুযোগের নীতির উপর ভিত্তি করে এবং সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের ভিত্তিতে তার নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মঙ্গল রক্ষা করে এবং প্রচার করে।
যে দেশগুলো তাদের নাগরিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, এবং সামাজিক নিরাপত্তা  প্রদান করে তাকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলে।
যে দেশগুলো তাদের নাগরিকদের কল্যাণ প্রচার করে তাদের কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসাবে উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা ব্যবহার করে এমন দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি।

কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র কি? এর সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য

১. সামাজিক বীমা: কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য, যেমন পাবলিক পেনশন এবং সামাজিক বীমা ইত্যাদি। সামাজিক বীমা বেশিরভাগ উন্নত শিল্পোন্নত দেশগুলোতে রয়েছে যেমন, যুক্তরাজ্যের জাতীয় বীমা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তা)।
২. সামাজিক নিরাপত্তা: একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে অর্থনীতি মূলত একটি মিশ্র অর্থনীতি যেখানে পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ বিদ্যমান থাকে। সরকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে এবং জনগণের সামাজিক কল্যাণে একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।
৩. প্রকৃতির সমাজতান্ত্রিক: একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রকৃতির সমাজতান্ত্রিক। এটি সমতার নীতির উপর ভিত্তি করে এবং সকলকে সমান সুযোগ প্রদান করতে আগ্রহী। এছাড়া সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করাও এর লক্ষ্য।
৪. অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ: এটি সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে, সমস্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগ সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
৫. নাগরিকদের মৌলিক সুবিধা প্রদান: এটি তার নাগরিকদের সমস্ত মৌলিক সুবিধা প্রদান করে। একটি কল্যাণমূলক সরকার তার জনগণকে সাধারণ শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, গণপরিবহন, আবাসন এবং অন্যান্য আর্থিক সহায়তার মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষেবা প্রদানে আগ্রহী।
৬. উদ্যোগ গ্রহণ এবং পরিচালনা: এটি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং পরিচালনা করে। শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মালিকানা ও পরিচালনাও কল্যাণমূলক সরকার দ্বারা করা হয়।
৭. ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে: একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে, সাধারণ মানুষকে তাদের অনেক প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের সাথে মোকাবিলা করতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ; আইনি ন্যায়বিচার এবং প্রশাসনিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে ন্যায়বিচার এবং তার প্রয়োজনীয়তা পূরণ নিশ্চিত করার।
৮. কার্যক্রম পরিকল্পনা: কল্যাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব জাতীয় নীতি প্রণয়ন করা এবং প্রতিটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সুষমভাবে পরিকল্পনা করা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে উৎপাদন ও বন্টন। শিল্পনীতি, বাণিজ্য নীতি, বাণিজ্যিক ও ব্যাংকিং নীতি ইত্যাদি প্রণয়ন করা হয় সেসব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য।
৯. শ্রমিকদের কল্যাণ: শ্রমিকদের কল্যাণ রাষ্ট্রের কর্তব্যের আওতায় আসে। তারা শ্রমিকদের শোষণ রোধে এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান, কারখানা, কোম্পানি এবং কর্মসংস্থানের অন্যান্য খাতে যারা কাজ করে তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য।
5/5 - (16 votes)

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.