শাস্তির তত্ত্ব, প্রকার ও রূপ

শাস্তির তত্ত্ব

শাস্তির বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। শাস্তির কিছু তত্ত্ব প্রাচীনকালে ব্যবহৃত হত কিন্তু এখন সেগুলি নিয়মিত ব্যবহার করা হয় না। নিম্মে শাস্তির বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হল।
১. শাস্তির দৃষ্টান্তমুলক তত্ত্ব (Deterrent theory of punishment)
দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি তত্ত্বের উদ্দেশ্য হলো, শাস্তির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা বা উদাহরণের মাধ্যমে অপরাধীকে ও জনগণকে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করা।
বেন্থাম শাস্তির দৃষ্টান্তমুলক তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে পরিচিত। শাস্তির দৃষ্টান্তমুলক তত্ত্ব অনুসারে, যদি অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে সেই অপরাধের পুনরাবৃত্তি আর হবে না এবং মানুষকে সেই অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত করবে।
শাস্তির প্রতিবন্ধক তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য হল প্রতিটি আসামীর জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করা এবং ভবিষ্যতের অপরাধ এড়ানো।
২. শাস্তির প্রতিশোধমূলক তত্ত্ব (Retributive Theory of Punishment)
এই তত্ত্বটি প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে, যা “চোখের বদলে চোখ এবং দাঁতের বদলে দাঁত” এর মাধমে প্রয়োগ করা হতো।
এর অর্থ হল অপরাধীকে সেইভাবে শাস্তি দেওয়া হয় যেমনটি সে করেছিল। যেমন, কোনো ব্যক্তি যদি রড দিয়ে পিটিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তির পা ভেঙে দেয়, তাহলে সেই ব্যক্তি তাকে রড দিয়ে পিটিয়ে তার পাও ভেঙে দেবে।
৩. শাস্তির প্রতিরোধমূলক তত্ত্ব (Preventive Theory of Punishment)
শাস্তির প্রতিরোধমূলক তত্ত্বের ধারণাটি ছিল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, কারাদণ্ড, এবং লাইসেন্স স্থগিত করার মাধ্যমে অপরাধীকে নিষ্ক্রিয় করে অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা।
যেমন, কোন হত্যাকারীকে ফাঁসি দিলে সে আর কোন ভাবেই মানুষ হত্যা করতে পারবেন না অথবা কোন ডাকাতকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলে সে আর কোন ভাবেই ডাকাতি করার সুযোগ পাবে না।
৪. শাস্তির প্রায়শ্চিত্তমূলক তত্ত্ব (Expiatory Theory of Punishment)
প্রায়শ্চিত্তমূলক তত্ত্বটি নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে ছিল। তাই অনেক আইনবিদ একে শাস্তির আইনগত তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করতে অস্বীকার করেছেন। এই তত্ত্বটি অপরাধ এবং শাস্তি সম্পর্কিত প্রাচীন ধর্মীয় ধারণার সাথে বেশি সম্পর্কিত।
এই তত্ত্ব বন্দীদের অন্তর থেকে তাদের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হতে এবং অপরাধ পরিহার করার সংকল্প করার জন্য বিচ্ছিন্ন কক্ষে রাখা হত।
৫. শাস্তির অক্ষমতা তত্ত্ব (Incapacitation theory of punishment)
শাস্তির অক্ষমতা বলতে একজন ব্যক্তির সমাজে স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা বোঝায়। অক্ষমতা তত্ত্বটি অন্যায়কারীকে সমাজ থেকে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে সরিয়ে দেয়। এই তত্ত্ব অপরাধীকে শারীরিক কাজ করতে বাধা দেয়। কিন্তু, সেই ব্যক্তির দ্বারা করা অপরাধ যদি অত্যন্ত জঘন্য হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডও প্রযোজ্য হয়।
উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি হারে অপরাধীদের অক্ষম করার জন্য কারাবাস ব্যবহার করে।
অক্ষমতার তত্ত্বটি ১৮ এবং ১৯ শতকে ব্রিটেনে উদ্ভূত হয়েছিল, যেখানে দোষী সাব্যস্ত অপরাধীদের প্রায়ই আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হত। পরে একবিংশ শতাব্দীতে, তত্ত্বটি কিছুটা পরিবর্তিত হয়, যেখানে অপরাধীদের অক্ষমতার জন্য সাধারণত কারাগারের প্রেরণ করা হতো।
৬. শাস্তির সংস্কারমূলক তত্ত্ব (Reformative Theory of Punishment)
এটি শাস্তির সেরা তত্ত্বগুলির মধ্যে একটি। সংস্কারমূলক তত্ত্ব ব্যক্তিকরণের পদ্ধতির মাধ্যমে অপরাধীর সংস্কারের উপর জোর দেয়। এই তত্ত্বের মাধ্যমে অপরাধীকে সংস্কার করে তার অপরাধের উদ্দেশ্য দূর করে তাকে আবার স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়া।
৭. শাস্তির ক্ষতিপূরণমূলক তত্ত্ব (Compensatory Theory of Punishment)
অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের প্রধানত দুটি ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে, যথা-
  • একজন অপরাধী যিনি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আঘাত এবং করেছেন, বা সম্পত্তির ক্ষতি করেছেন, এবং
  • যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তাকে অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

শাস্তির প্রকারভেদ

পৃথিবীতে অনেক ধরনের শাস্তির বিধান থাকলেও বাংলাদেশে প্রায় ৬ ধরনের শাস্তির বিধান আছে। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৫৩ ধারায় শাস্তি বা দন্ড বিবৃত করা আছে। যেমন-
  1. মৃত্যুদন্ড (ফাসি),
  2. যাবজ্জীবন কারাদন্ড,
  3. সশ্রম কারাদন্ড,
  4. বিনাশ্রম কারাদন্ড,
  5. সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরন,
  6. অর্থদন্ড (জরিমানা),
এছাড়াও আরো কয়েক ধরনের শাস্তির প্রচলন আছে। যেমন-
  • অক্ষমতা ঘোষণা
  • দেউলিয়া ঘোষণা
  • লাইসেন্স বাতিল করা

শাস্তির বিভিন্ন রূপ

প্রাচীনকাল থেকে অপরাধীকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হতো। কিছু কিছু শাস্তির ধরন বর্তমানেও প্রচলিত রয়েছে।
শারীরিক শাস্তি (Corporal punishment)
এটি এক ধরণের পদ্ধতি যেখানে আসামিকে ছোটখাটো ব্যথা দেওয়া হতো যাতে সে আইন মেনে চলে।
চাবুক মারা (Flogging)
সাম্প্রতিক বছর পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে শাস্তির একটি সাধারণ পদ্ধতি হিসাবে বেত্রাঘাত বা চাবুক মারা ব্যবহার করা হয়েছিল। যাইহোক, এটি মাতাল প্রভৃতির মতো ছোটখাটো অপরাধের ক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
অঙ্গচ্ছেদ (Mutilation)
প্রাচীন ভারতে এর প্রচলন ছিল। চুরির ক্ষেত্রে অপরাধীর এক বা উভয় হাত কেটে ফেলা হয় এবং ধর্ষণের ক্ষেত্রে তার গোপনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়। তবে চুরির ক্ষেত্রে হাত কাটা এটি মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে অপরাধীর শাস্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
চেইনিং (Chaining)
এই শাস্তিতে অপরাধীদের স্বাধীনতা ও চলাফেরা সম্পূর্ণরূপে সীমিত করা হয়। অপরাধীদের হাত-পা লোহার রড দিয়ে বেঁধে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।
পাথর নিক্ষেপ (Pillory)
সাজা কার্যকর করার জন্য অপরাধীকে প্রকাশ্য স্থানে প্রকাশ্যে পাথর ছুড়ে মারা হতো। এটি এখনও ইসলামিক দেশগুলিতে যৌন-অপরাধীর শাস্তি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
জরিমানা এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা (Fines and confiscation of property)
যখন অপরাধগুলো গুরুতর হয় না, তখন জরিমানা দিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। জরিমানার একটি অংশ অপরাধের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রদান করা হতো। এছাড়া অপরাধীর বিভিন্ন অবৈধ সম্পত্তি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়।
কারাবাস (Imprisonment)
কারাদণ্ড সহজ বা কঠোর হতে পারে। এটি শাস্তির সবচেয়ে সাধারণ রূপ যা সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হয়।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড (Imprisonment for life)
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ১৪ বছর বা ২০ বছরের কারাদণ্ডের সমতুল্য নয় কারণ Cr PC-তে এর কোনও বিধান নেই।

Similar Posts