যুদ্ধাপরাধ কি?
যুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সামরিক বা ব্যক্তি কর্তৃক যুদ্ধের নীতিমালা লংঘন করাই হল সংক্ষেপে যুদ্ধাপরাধ। যুদ্ধের আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা জেনেভা কনভেনশন সমুহের মাধ্যমে বিশ্বের জাতিসমূহ গ্রহন করতে সম্মত হয়।
যুদ্ধাপরাধের মধ্যে যুদ্ধবন্দী হত্যা, বেসামরিক জনগন হত্যা, ধর্ষণ, আত্মসমর্পনকারী শত্রু সৈন্য হত্যা, গণহত্যা, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
যুদ্ধাপরাধের মধ্যে যুদ্ধের আইন বা রীতিনীতি লঙ্ঘন যেমন,
- কোন ব্যক্তি বা সম্পত্তির ধ্বংস।
- অধিকৃত ভূখণ্ডের বেসামরিক জনগোষ্ঠী হত্যা, দুর্ব্যবহার বা দাস শ্রম বা নির্বাসন।
- যুদ্ধবন্দী বা সমুদ্রে থাকা ব্যক্তিদের হত্যা বা দুর্ব্যবহার।
- জিম্মিদের হত্যা।
- জৈবিক পরীক্ষা সহ নির্যাতন বা অমানবিক আচরণ।
- সরকারি বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি লুণ্ঠন।
- শহর, টাউন বা গ্রাম ধ্বংস।
যুদ্ধাপরাধী কারা?
কেউ যদি যুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধবন্দী হত্যা, বেসামরিক জনগন হত্যা, ধর্ষণ, আত্মসমর্পনকারী শত্রু সৈন্য হত্যা, গণহত্যা ইত্যাদি অপরাধ করবে সেই যুদ্ধাপরাধী। অর্থাৎ যুদ্ধের নীতিমালা লংঘন করে যে যুদ্ধ করেছে সেই যুদ্ধাপরাধী।
যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা
যুদ্ধাপরাধ হলো কোন যুদ্ধ বা সামরিক সংঘাত চলাকালীন সময়ে কোন ব্যক্তি কর্তৃক বেসামরিক জনগণের উপর সংগঠিত ও নির্দিষ্ট সংজ্ঞায়িত অপরাধ কর্মকাণ্ডসমূহ যেমন, ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক মানুষ হত্যা বা যুদ্ধবন্দীদের হত্যা, নির্যাতন, জিম্মি, অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেসামরিক সম্পত্তি ধ্বংস করা, প্রতারণা, যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা, লুণ্ঠন ইত্যাদি।
জাতিসংঘের মতে, ‘‘যুদ্ধাপরাধ হলো আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘর্ষের সময় বেসামরিক নাগরিক বা “শত্রু যোদ্ধাদের” বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। যুদ্ধাপরাধ তখনই ঘটে যখন শত্রুর উপর অতিরিক্ত আঘাত বা অপ্রয়োজনীয় কষ্ট দেওয়া হয়।’’
ব্রিটানিকার মতে, ‘‘যুদ্ধাপরাধ হলো আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা নির্ধারিত যুদ্ধের আইনের লঙ্ঘন।’’
যুদ্ধাপরাধের ইতিহাস
যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আন্তর্জাতিক আইনে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। যুদ্ধাপরাধের ধারণা মূলত সাম্প্রতিক কালের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, যুদ্ধের ভয়াবহতা যুদ্ধের প্রকৃতির অংশ ছিল। সেনাবাহিনী প্রায়শই শত্রু সৈন্য এবং বেসামরিক লোকদের প্রতি একইভাবে নৃশংস আচরণ করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানি কয়েক মিলিয়ন লোক হত্যা (প্রধানত ইহুদি হত্যা), এবং জাপানিদের দ্বারা বেসামরিক এবং যুদ্ধবন্দীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়।
১৮৯৯ ও ১৯০৭ সালের হেগ কনভেনশন সর্বপ্রথম যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত আইনসমূহ লিপিবদ্ধ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংগঠিত হওয়া নূরেমবার্গের হত্যাকাণ্ড এর বিচার সবচেয়ে আলোচিত যুদ্ধাপরাধ বিচার। আধুনিক যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রে ১৯৪৫ সালের লন্ডন ঘোষণাকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়।
১৯৪৫-৪৬ এবং ১৯৪৬-৪৮ সালে যথাক্রমে নুরনবার্গ এবং টোকিওতে মিত্র বাহিনীর গঠিত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে জার্মান এবং জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছিল এবং ১৯৯০-এর দশকে রুয়ান্ডা এবং সাবেক যুগোস্লাভিয়ার সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যুদ্ধাপরাধকে জেনেভা কনভেনশন, নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের রূল, যুগোস্লাভিয়ার ট্রাইব্যুনাল, এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংবিধি দ্বারা সংজ্ঞায়িত করে শাস্তির আওতায় আনা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হল যুদ্ধকালীন সময়ে নৃশংসতা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্তদের বিচার করার জন্য প্রতিষ্ঠিত আইনের আদালত। যুদ্ধকালীন সময়ে নৃশংসতার মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণ ইত্যাদি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ হলো বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত একটি অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেখানে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য অপরাধের জন্য ব্যক্তিদের আটক, বিচার এবং শাস্তি প্রদানের জন্য গঠিত হয়েছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যার জবাবদিহির জন্য বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১০ সালে আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের সরকার মুক্তিযুদ্ধের পরপরই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আইনটি প্রণয়ন করে। এই ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্য হল ভিকটিমদের অভিযুক্তের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দেওয়া এবং অভিযুক্তকে তার ক্রিয়াকলাপ ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার এবং মিডিয়ার সামনে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেওয়া।