উনবিংশ শতাব্দীতে, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে আলীগড় আন্দোলন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র্য জাতীয়বােধের বিকাশ ঘটে।
এ আন্দোলনের ফলে ইংরেজদের সাথে মুসলমানদের সহযােগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। মুসলমানরা ইংরেজি ও পাশ্চাত্য-শিক্ষা গ্রহণ করে সরকারি চাকরির সুযােগ পায়। এ আন্দোলনের ফলেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ জন্মলাভ করে এবং পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতার পটভূমি তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
আলীগড় আন্দোলন কি?
মুসলমান সমাজে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে এবং স্বতন্ত্র্য জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ ভারতের উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে পরিচিত।
ইংরেজের দমন ও নির্যাতনে মুসলমানরা যখন চরমভাবে নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত তখন সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম জাতির ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত হন। তিনি ইংরেজ সরকারের অধীনে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন মুসলমান সমাজের দুঃখ, দুর্দশা দেখে চরমভাবে ব্যথিত হন।
তিনি উপলব্ধি করেন যে, মুসলমানদের পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি ঘৃণা ও উদাসীনতা তাদের দুঃখ-দুর্দশার প্রকৃত কারণ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজদের সঙ্গে সহযােগিতা এবং পাশ্চাত্য-শিক্ষা ব্যতিত মুসলমানদের উন্নতির কোনাে বিকল্প পথ নেই। পাশ্চাত্য-শিক্ষা রাজনৈতিক অধিকার লাভ করাও তাদের জন্য সম্ভব ছিল না। তাই, তিনি মুসলমানদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান বিস্তারে ব্রতী হন এবং বাস্তবমুখী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তাই তাকে আলীগড় আন্দোলনের প্রবক্তা বা নেতা বলা হয়।
তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৮৭৬ সালে, তিনি মোহামেডন আংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপন করেন যা পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় পাশ্চাত্য-শিক্ষা গ্রহণ ও ব্রিটিশ সহযােগিতার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। মুসলমান সমাজের মধ্যে ইংরেজ-শাসনের প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি করে এবং কংগ্রেসের প্রভাব থেকে মুসলমানদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে।
আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্য
সৈয়দ আহমদ খান আলীগড় আন্দোলনের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য উল্লেখ করেন। যেমন,
১. ভারতের মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা লাভে প্ররোচিত করা। কারণ তখন মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিল।
২. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের মধ্যে আনুগত্যের চেতনা জাগানো। সে সময় মুসলমানরা ব্রিটিশদের ভারতের শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
৩. ব্রিটিশদের বোঝানো যে মুসলমানরা ভারতের অনুগত নাগরিক। এছাড়াও আলীগড় আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ:
- ভারতের রাজনীতিতে মুসলিমদের অধিকার ও আধুনিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।
- মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানাে।
- ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত হওয়া এবং সরকারের কর্মকাণ্ডে সহযােগিতা করা।
- মুসলমানদের স্বতন্ত্র্য জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা।
- রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করা।
- বিশ্বসভ্যতায় মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে সচেতন করে তােলা।
- মুসলিম সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি, পর্দা প্রথার অপসারণ ও নারী শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে।
- মুসলিমদের আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।
আলিগড় আন্দোলনের প্রভাব
আলীগড় আন্দোলনের অগ্রগতিতে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের প্রভাব অপরিসীম। যেমন,
- ১৮৫৮ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান একটি ফার্সি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে ইংরেজি শিক্ষাও দেওয়া হয়।
- ১৮৬৩ সালে, তিনি বিখ্যাত ইংরেজি বইগুলোকে উর্দুতে অনুবাদ করার উদ্দেশ্যে গাজীপুরে একটি বৈজ্ঞানিক সমিতি (scientific society) প্রতিষ্ঠা করেন।
- ১৮৬৬ সালে, বিজ্ঞানীরা “আলিগড় ইনস্টিটিউট গেজেট” নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করতে শুরু করেন।
- মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে স্যার সৈয়দ “আঞ্জুমান-ই-তারকি-ই-মুসলমান হিন্দ” প্রতিষ্ঠা করেন।
- তিনি জীবনের বিভিন্ন দিক সংস্কারের জন্য “তেহজেব উল আখলাক (Tehzeb ul Akhlaq)” নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করেন।
- তিনি আঞ্জুমান মুহাম্মদান প্রতিষ্ঠা করেন।
- ১৮৭৫ সালে, অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে আলিগড়ে মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ (Muhammedan Anglo-Oriental College) প্রতিষ্ঠা করেন। সৈয়দ আহমদ কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন, পারেন নি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর, ১৯২১ সালে এটিকে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করে।
- ১৮৮৬ সালে মুহাম্মাডান এডুকেশনাল কনফারেন্স স্থাপিত হয়। এতে মুসলিম শিক্ষাবিদদের নিয়ে গঠিত যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের জন্য শিক্ষার মান নিশ্চিত করা,
- শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য গবেষণা পরিচালনা।
আলীগড় আন্দোলনের ফলাফল
আলীগড় আন্দোলন ছিলো ভারতের মুসলমানদের পরিবর্তনের আন্দোলন। এ আন্দোলনের ফলাফল ছিল সদূর প্রসারি। নিম্মে আলীগড় আন্দোলনের ফলাফল বর্ণনা করা হল।
- আলিগড় আন্দোলন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে তাদের আধুনিক যুগোপযোগী ভাবধারায় দীক্ষিত করেছিল।
- এই আন্দোলন ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে যুক্তিবাদের প্রসার ঘটিয়ে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি পরিত্যাগেও সাহায্য করেছিল।
- মুসলমানরা কোন না কোনভাবে ইংরেজী শিক্ষা লাভে রাজি হয়।
- আলীগড় আন্দোলন ছিল ভারতে মুসলিম নেতৃত্বের একটি বড় উৎস।
- মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের মনোভাব নরম হয়।
- ভারতীয় মুসলিম লীগ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
- আন্দোলনের মাধ্যমে দ্বি-জাতি তত্ত্ব শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং এর প্রতি আরও পাণ্ডিত্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়।
- পাকিস্তানের সৃষ্টির শিকড় আলিগড় আন্দোলনে খুঁজে পাওয়া যায়।