জাতীয়তাবাদ: উৎপত্তি, বৈশিষ্ট্য ও প্রকার

জাতীয়তাবাদ হল একটি মতাদর্শ বা অনুভূতি যা একই জাতি, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি বা সামাজিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদী আদর্শ একটি জাতি বা জাতি-রাষ্ট্রের প্রতি ভক্তি বা আনুগত্যের উপর জোর দেয় এবং যারা অন্যন্য জাতি থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র মনে করে।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য দেশের জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, নিজেদের শাসন করার অধিকার লাভ করা—এবং আধুনিক বৈশ্বিক অর্থনীতির দ্বারা সৃষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক চাপ মোকাবেলা করা।

জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি

জাতীয়তাবাদের উত্থান ঐতিহাসিকভাবে সুনির্দিষ্ট। জাতীয়তাবাদ আঠারো শতকের শেষভাগে প্রথমে ইউরোপে, তারপর উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় আবির্ভূত হয়। বিংশ শতাব্দীতে, জাতীয়তাবাদ এশিয়ার অনেক দেশে এবং আফ্রিকার সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
১৮ শতকে, আমেরিকান বিপ্লব এবং ফরাসি বিপ্লব জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রভাবশালী উদ্ভব হিসেবে মনে করা হয়। ১৯ শতকে, জাতীয়তাবাদ ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে প্রবেশ করে এবং এর ধারাবাহিকতায় মধ্য, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এশিয়া ও আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে।
তবে, ১৭ শতকের মাঝামাঝি পিউরিটান বিপ্লবের (Puritan Revolution) সময় ইংল্যান্ডে জাতীয়তাবাদের প্রথম সত্যিকারের প্রকাশ ঘটেছিল। ফলস্বরুপ, ইংল্যান্ড বিজ্ঞান, বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক তত্ত্বের বিকাশে বিশ্বনেতা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল।
ইংল্যান্ডের জাতীয়তাবাদ, জন লক এবং জিন জ্যাক রুসোর “সামাজিক চুক্তি” বইতে প্রকাশ করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে আমেরিকান এবং ফরাসি জাতীয়তাবাদকেও প্রভাবিত করেছিল।
জন লক, রুশো এবং অন্যান্য সমসাময়িক ফরাসি দার্শনিকদের স্বাধীনতার ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, উত্তর আমেরিকার ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে আমেরিকান জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছিল। আমেরিকান বিপ্লব (1775-83) এবং ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতার ঘোষণার প্রভাব ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।
২০ শতকে জাতীয়তাবাদের নতুন রূপের উত্থান দেখা যায় যা মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে অধিকাংশ উপনিবেশিক শাসনের অবসান হয় এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিস্তার লাভ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, অ্যাডলফ হিটলার জাতিগত বিশুদ্ধতা, কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং জার্মানির অতীতের পৌরাণিক গৌরবের উপর ভিত্তি করে জার্মানিতে ধর্মান্ধ জাতীয়তাবাদের একটি নতুন ব্র্যান্ড তৈরি করেছিলেন।
২০ শতকে এশিয়া ও আফ্রিকায় উদীয়মান জাতীয়তাবাদ তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক, ভারতে মহাত্মা গান্ধী এবং চীনে সান ইয়াত-সেনের মতো ক্যারিশম্যাটিক বিপ্লবী নেতা তৈরি করেছিল।

জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য

জাতীয়তাবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহ নিম্মে দেওয়া হল।
  • একক রাষ্ট্র: জাতীয়তাবাদ মূলত একটি একক জাতিকে অন্তর্ভুক্ত করে যারা অন্য রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে।
  • অনুভূতি: গ্রুপের বা দেশের প্রতিটি ব্যক্তির অভিন্ন অনুভূতি থাকবে।
  • অঞ্চল: একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল মানুষকে ঐক্যের অনুভূতি দেয়।
  • সাধারণ স্বার্থ: নিজ জাতির স্বার্থের প্রতি ভক্তি এবং সকলের একই সাধারণ স্বার্থের অস্তিত্বও জাতীয়তাবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
  • জাতিগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক মিলবন্ধন, এবং ভৌগলিক সীমানা জাতীয়তাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
  • ভাষা: একটি সাধারণ ভাষা জাতীয়তাবাদের একটি মূল উপাদান।
  • ইতিহাস: একটি সমৃদ্ধ অতীত ইতিহাস মানুষকে একটি গোষ্ঠী হিসাবে সংযুক্ত করে। এটি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
  • ধর্ম: একটি সাধারণ ধর্ম মানুষকে একত্রিত করতে সাহায্য করে।
  • আত্মনিয়ন্ত্রণ: প্রতিটি জাতি নিজেকে পরিচালনা করার অধিকার থাকবে। বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত একটি জাতির জন্য প্রাকৃতিক এবং আদর্শ ভিত্তি।
  • ক্ষমতার উৎস: জাতীয়তাবাদ হল রাজনৈতিক ক্ষমতার একমাত্র সঠিক উৎস।

জাতীয়তাবাদের প্রকারভেদ

জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে রয়েছে যেমন, জাতিগত জাতীয়তাবাদ, নাগরিক জাতীয়তাবাদ, সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদ, সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ, উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ, বামপন্থী জাতীয়তাবাদ, উদার জাতীয়তাবাদ, এবং ভাষাগত জাতীয়তাবাদ অন্যতম।
১. জাতিগত জাতীয়তাবাদ (Ethnic Nationalism)
জাতিগত জাতীয়তাবাদ জাতিকে জাতিগত পরিপ্রেক্ষিতে সংজ্ঞায়িত করে, যা সর্বদা পূর্ববর্তী প্রজন্মের বংশধরের কিছু উপাদান (সংস্কৃতির ধারণা এবং সাধারণত ভাষা) অন্তর্ভুক্ত করে।
২. নাগরিক জাতীয়তাবাদ (Civic Nationalism)
নাগরিক জাতীয়তাবাদ হল জাতীয়তাবাদের একটি রূপ যেখানে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করে, যেখানে এটি “জনগণের ইচ্ছার” প্রতিনিধিত্ব করে। নাগরিক-জাতীয় আদর্শ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের মতো দেশে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বিকাশকে প্রভাবিত করেছিল।
৩. সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদ (Expansionist Nationalism)
সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদ হল জাতীয়তাবাদের একটি আক্রমনাত্মক এবং উগ্র রূপ যা সম্প্রসারণবাদে বিশ্বাসী। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ইউরোপীয় শক্তিগুলো জাতীয় গৌরবের নামে ‘স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা’-তে লিপ্ত হওয়ার কারণে এই শব্দটি তৈরি হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে ফ্যাসিবাদী ইতালি, নাৎসি জার্মানি, জাপান সাম্রাজ্য ইত্যাদি সামরিক সরকারগুলোও সম্প্রসারণবাদী জাতীয়তাবাদ সাথে যুক্ত ছিল।
৪. সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ (Cultural Nationalism)
সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ একটি যৌথ সংস্কৃতি দ্বারা জাতিকে সংজ্ঞায়িত করে। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে জাতীয়তাবাদ এর বৈচিত্র হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা সম্পূর্ণরূপে নাগরিক বা জাতিগত নয়। কাতালোনিয়া এবং কুইবেকের জাতীয়তাবাদকে সাংস্কৃতিক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
৫. বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ (Revolutionary Nationalism)
বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ, যা উগ্র জাতীয়তাবাদ নামেও পরিচিত। এটি সর্বপ্রথম বেনিটো মুসোলিনি দ্বারা প্রচারিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানিতে  “উগ্র জাতীয়তাবাদ এর ধারণা তৈরি হয়েছিল।
৬. উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ (Post-Colonial Nationalism)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, উপনিবেশকরণ বিলুপ্তির পর থেকে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ফলস্বরুপ, ঔপনিবেশিক ও শোষিত দেশগুলোতে উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে। উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ এর উদাহরণের মধ্যে রয়েছে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ এবং আরব জাতীয়তাবাদ। এছাড়াও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, এবং চীনা জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি।
৭. বামপন্থী জাতীয়তাবাদ (Left-Wing Nationalism)
বামপন্থী জাতীয়তাবাদ, সমাজতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ নামেও পরিচিত। এটি এমন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনকে বোঝায় যা জাতীয়তাবাদের সাথে বামপন্থী রাজনীতি বা সমাজতন্ত্রকে একত্রিত করে। বামপন্থী জাতীয়তাবাদের উদাহরণের মধ্যে রয়েছে ফিদেল কাস্ত্রোর ২৬শে জুলাই আন্দোলন যা ১৯৫৯সালে আমেরিকান-সমর্থিত ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে কিউবার বিপ্লব শুরু করেছিল।
৮. উদার জাতীয়তাবাদ (Liberal Nationalism)
উদার জাতীয়তাবাদ হল এক ধরনের জাতীয়তাবাদ যা সম্প্রতি রাজনৈতিক দার্শনিকদের দ্বারা উদ্ভব হয়েছে। যারা বিশ্বাস করে যে স্বাধীনতা, সহনশীলতা, সাম্য এবং ব্যক্তি অধিকারের উদার মূল্যবোধ একটি জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। জন স্টুয়ার্ট মিলকে প্রথম উদার জাতীয়তাবাদী বলে মনে করা হয়।
৯. ভাষাগত জাতীয়তাবাদ (linguistic nationalism)
ভাষাগত জাতীয়তাবাদ মূলত একটি অঞ্চলের বহুল ব্যবহৃত মানুষের ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। একই ভাষা একটি জাতিকে একত্রিত করতে সাহায্য করে এবং ঐক্যের অনুভূতির জন্ম দেয়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পেছনে ভাষাগত জাতীয়তাবাদ মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।