দ্বিরুক্ত শব্দগুলো বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। একই শব্দ পর পর দু’বার ব্যবহারের মাধ্যমে, সেই শব্দটির নতুন অর্থ ও ভাব তৈরি হয়। সেইসাথে শব্দের নতুন অর্থের ব্যাপকতা এবং প্রসারতাও বৃদ্ধি পায়।
দ্বিরুক্ত শব্দ কি?
দ্বিরুক্ত = ‘দ্বি + উক্ত’ অর্থাৎ যা দু’বার বলা হয়েছে বা উক্ত হয়েছে এমন। বাংলা ভাষায় কোন কোন শব্দ, পদ বা অনুকার শব্দ দু’বার ব্যবহার করলে অন্য সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে। এ ধরণের শব্দের বা পদের পরপর দু’বার ব্যবহৃত হওয়ায় কোন বিশেষ অর্থ প্রকাশ করলে, তাকে দ্বিরুক্ত শব্দ বলে।
সহজভাবে বলতে গেলে, কোন শব্দ বা পদের পরপর দু’বার ব্যবহার বা পুনরাবৃত্তিকেই দ্বিরুক্ত শব্দ বলে। যেমন –আমার জ্বর জ্বর লাগছে। অর্থাৎ, ঠিক জ্বর নয়, জ্বরের ভাব অর্থে এই প্রয়োগ।
উদাহরণ –
আমার শীত শীত লাগছে। এখানে শীত নয়, তবে শীতের ভাব অর্থটিই প্রকাশ পেয়েছে।
দেখে দেখে যেও। এখানে ক্রিয়ার বিশেষণ পদ প্রকাশ পেয়েছে।
কিচির মিচির। এখানে জীবজন্তুর ধ্বনি অনুকার অর্থ প্রকাশ পেয়েছে।
দ্বিরুক্ত শব্দের প্রকারভেদ
বাংলা ব্যাকরণে তিন প্রকারের দ্বিরুক্ত শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। যথা -শব্দের দ্বিরুক্তি, পদের দ্বিরুক্তি এবং অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি।
১. শব্দের দ্বিরুক্তি
একই শব্দ দু’বার ব্যবহার করার পর শব্দ দুটো অবিকৃত থেকে গেলে, তাকে শব্দের দ্বিরুক্তি বলে। শব্দের দ্বিরুক্তির সাথে বিভক্তি ব্যবহৃত হয় না।
শব্দের দ্বিরুক্তির গঠন
- একই শব্দ দুইবার ব্যবহার করা হয় এবং শব্দ দুটি অবিকৃত থাকে। যথা- ভালো ভালো ফল, বড় বড় বই, ফোঁটা ফোঁটা পানি ইত্যাদি।
- একটি শব্দের সাথে সমার্থক আরও একটি শব্দ যোগ করে ব্যবহৃত হয়। যথা- খেলা-ধূলা, খোঁজ-খবর, লালন-পালন, ধন-দৌলত ইত্যাদি।
- দ্বিরুক্ত শব্দে জোড়ার দ্বিতীয় শব্দের আংশিক পরিবর্তন হয়। যেমন- ফিট-ফাট, মিট-মাট, বকা-ঝকা, রকম-সকম, তোড়-জোড়, গল্প-সল্প ইত্যাদি।
- সমার্থক বা বিপরীতার্থক শব্দ যোগে। যেমন- লেন-দেন, দেনা-পাওনা, টাকা-পয়সা, ধনী-গরিব, আসা-যাওয়া ইত্যাদি।
২. পদের দ্বিরুক্তি
বিভক্তিযুক্ত পদের পরপর দু’বার ব্যবহারকে, পদের দ্বিরুক্তি বা পদাত্মক দ্বিরুক্তি বলে। সাধারণত দুই পদে একই বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। বাংলা ভাষায় সকল পদেরই দ্বিরুক্ত প্রয়োগ হয়ে থাকে। অনেক সময় বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়াপদ ও অব্যয় পদের দ্বিরুক্ত প্রয়োগের ফলে বহুবচনের অর্থ প্রকাশ করে।
পদের দ্বিরুক্তির ব্যবহার
- আধিক্য বোঝাতে: রাশি রাশি ধন, ধামা ধামা ধান।
- সামান্য বোঝাতে: আমি আজ জ্বর জ্বর বোধ করছি।
- পরস্পরতা বা ধারাবাহিকতা বোঝাতে: তুমি দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছ।
- বিশেষ্য রূপে: জিজ্ঞাসিব জনে জনে।
- ক্রিয়া বিশেষণ: ধীরে ধীরে যায়, ফিরে ফিরে চায়, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনলে কিভাবে।
- বিশেষণ বোঝাতে: তোমার নেই নেই ভাব আর গেল না।
- আগ্রহ বোঝাতে: ও দাদা দাদা বলে কাঁদছে।
- স্বল্পকাল স্থায়ী: দেখতে দেখতে আকাশ মেঘে ঢেকে গেলো।
- কালের বিস্তার: থেকে থেকে শিশুটি কাঁদছে।
- সর্বনামের বহুবচন বা আধিক্য বোঝাতে : কে কে এলো? কেউ কেউ বলে।
- সতর্কতা বোঝাতে; ছেলেটিকে চোখে চোখে রাখ।
- তীব্রতা বা সঠিকতা বোঝাতে: নরম নরম হাত, গরম গরম জিলাপি।
- পৌন:পুনিকতা: ডেকে ডেকে হয়রান, বার বার কামান গর্জে ওঠছে।
৩. অনুকার দ্বিরুক্তি
কোনো কিছুর স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতি বিশিষ্ট শব্দের রূপকে, অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি বলে। এ জাতীয় ধ্বন্যাত্মক শব্দের দুইবার প্রয়োগের নাম ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি। অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি শব্দ দ্বারা বহুত্ব, আধিক্য ইত্যাদি বোঝায়।
অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি গঠন
- একই (ধ্বন্যাত্মক) শব্দের অবিকৃত প্রয়োগ: ধব ধব, ঝন ঝন, পট পট।
- প্রথম শব্দটির শেষে আ-যোগ করে: গপাগপ, টপাটপ, পটাপট।
- দ্বিতীয় শব্দটির শেষে ই-যোগ করে: ধরাধরি, ঝনঝনি।
- যুগ্মরীতিতে গঠিত ধ্বন্যাত্মক শব্দ: কিচির মিচির (পাখি বা বানরের শব্দ), টাপুর টুপুর (বৃষ্টি পতনের শব্দ), হাপুস হুপুস (গোস্লাসে কিছু খাওয়ার শব্দ)।
- আনি প্রত্যয়যোগে: ছটফটানি, বকবকানি ইত্যাদি।
বিভিন্ন পদরূপে ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্ত শব্দের ব্যবহার
বিশেষ্য: বৃষ্টির ঝম ঝমানি আমাদের অস্থির করে তোলে।
বিশেষণ: নামিল নতে বাদল ছল ছল বেদনায়।
ক্রিয়া: কল কলিয়ে উঠল নারীর প্রতিবাদ।
ক্রিয়া বিশেষণ: চিক চিক করে বালি কোথাও নাই কাঁদা।