পদ কাকে বলে? পদ কত প্রকার ও কি কি?

বাক্যে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দকে পদ বলে।

বাক্যে যখন শব্দ ব্যবহৃত হয়, তখন শব্দগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য প্রতিটি শব্দের সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত শব্দাংশ যুক্ত হয়। এগুলোকে বলে বিভক্তি। যে সব শব্দে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় কোন বিভক্তি যুক্ত হয়নি, সে সব শব্দেও একটি বিভক্তি যুক্ত হয়। একে প্রথমা বিভক্তি বা শূণ্য বিভক্তি বলে।

আরো পড়ুন : সমার্থক শব্দ কাকে বলে?

ব্যাকরণ অনুযায়ী কোন শব্দ বাক্যে ব্যবহৃত হলে তাতে বিভক্তি যুক্ত হতে হয়। আর তাই কোন শব্দ বাক্যে বিভক্তি না নিয়ে ব্যবহৃত হলেও তার সঙ্গে একটি বিভক্তি যুক্ত হয়েছে বলে ধরে নিয়ে তাকে শূণ্য বিভক্তি বলা হয়।

অর্থাৎ, বিভক্তিযুক্ত শব্দকেই পদ বলে।

পদের প্রকারভেদ

পদ প্রধানত ২ প্রকার- সব্যয় পদ ও অব্যয় পদ।

সব্যয় পদ আবার ৪ প্রকার- বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম ও ক্রিয়া।

অর্থাৎ, পদ মোট ৫ প্রকার

১. বিশেষ্য

২. বিশেষণ

৩. সর্বনাম

৪. ক্রিয়া

৫. অব্যয়

[শব্দের শ্রেণীবিভাগ হলো- তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি। অন্যদিকে পদের শ্রেণীবিভাগ হলো- বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়া ও অব্যয়। দুইটিই ৫ প্রকার।]

যখন পর্যন্ত কোন শব্দ বাক্যে ব্যবহৃত হচ্ছে না, তখনো সেটি কোন পদ নয়। কোন শব্দ কোন পদ হবে তা নির্ভর করে বাক্যে কিভাবে ব্যবহৃত হলো তার উপর। তাই কোন শব্দকে আগেই বিশেষ্য বা বিশেষণ বলে দেয়া ঠিক নয়।

যেমন-

  • তোমার হাতে কি?
  • ডাকাত আমার সব হাতিয়ে নিয়েছে।
  • জঙ্গীরা হাত বোমা মেরে পালিয়ে গেলো।

প্রথম বাক্যে হাত শব্দটি বিশেষ্য। আবার দ্বিতীয় বাক্যে এই হাত শব্দটিই একটু পরিবর্তিত হয়ে ক্রিয়া হয়ে গেছে। আবার তৃতীয় বাক্যেই আবার হাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষণ হিসেবে।

[তবে প্রশ্নে শুধু শব্দ দিয়ে সেটি কোন পদ জিজ্ঞেস করলে সাধারণত শব্দটি যে পদ হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেটি দিতে হবে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিটি শব্দই সাধারণত একেক পদ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সময় একেক রূপ নেয়। যেমন, ‘হাত’ শব্দটি বিশেষণ হিসেবে কোন বিভক্তি নেয়নি, কিন্তু বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সময় বিভক্তি নিয়েছে। আবার ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সময় প্রত্যয় নিয়েছে। এভাবে প্রশ্নের শব্দটিকে বিভিন্ন বাক্যে ব্যবহার করে কোন পদ নির্ণয় করা যেতে পারে।]

১. বিশেষ্য পদ

কোন কিছুর নামকেই বিশেষ্য বলে।

যে পদ কোন ব্যক্তি, বস্ত্ত, প্রাণী, সমষ্টি, স্থান, কাল, ভাব, কর্ম, গুণ ইত্যাদির নাম বোঝায়, তাকে বিশেষ্য পদ বলে।

প্রকারভেদ

বিশেষ্য পদ ৬ প্রকার-

১. নামবাচক বা সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য

(ক) ব্যাক্তির নাম : নজরুল, ওমর, আনিস, মাইকেল

(খ) ভৌগোলিক স্থানের নাম : ঢাকা, দিলিল, লন্ডন, মক্কা

(গ) ভৌগোলিক নাম (নদী, পর্বত, সমুদ্র ইত্যাদির নাম) : মেঘনা, হিমালয়, আরব সাগর

(ঘ) গ্রন্থের নাম : গীতাঞ্জলি, অগ্নিবীণা, দেশেবিদেশে, বিশ্বনবী

২. জাতিবাচক বিশেষ্য :

(এক জাতীয় প্রাণী বা পদার্থের নাম) মানুষ, গরু, গাছ, পাখি, পর্বত, নদী, ইংরেজ

৩. বস্তুবাচক বা দ্রব্যবাচক বিশেষ্য :

বই, খাতা, কলম, থালা, বাটি, মাটি, চাল, চিনি, লবন, পানি

৪. সমষ্টিবাচক বিশেষ্য (ব্যক্তি বা প্রাণীর সমষ্টি) :

সভা, জনতা, পঞ্চায়েত, মাহফিল, ঝাঁক, বহর, দল

৫. ভাববাচক বিশেষ্য (ক্রিয়ার ভাব বা কাজের ভাব বা কাজের নাম বোঝায়) :

গমন, শয়ন, দর্শন, ভোজন. দেখা, শোনা, যাওয়া, শোয়া

৬. গুণবাচক বিশেষ্য :

মধুরতা, তারল্য, তিক্ততা, তারুণ্য, সৌরভ, স্বাস্থ্য, যৌবন, সুখ, দুঃখ

২. বিশেষণ পদ

যে পদ বাক্যের অন্য কোন পদের দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে, তাকে বিশেষণ পদ বলে।

অর্থাৎ, বিশেষণ পদ অন্য কোন পদ সম্পর্কে তথ্য বা ধারণা প্রকাশ করে, বা অন্য পদকে বিশেষায়িত করে।

কিছু বিশেষণ পদ : (‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতা থেকে)

  • সফেদ দেয়াল
  • শান্ত ফটোগ্রাফ
  • জিজ্ঞাসু অতিথি
  • ছোট ছেলে
  • নিস্পৃহ কণ্ঠস্বর
  • তিনটি বছর (সংখ্যাবাচক বিশেষণ)
  • রুক্ষ চর
  • প্রশ্নাকুল চোখ
  • ক্ষীয়মাণ শোক
  • সহজে হয়ে গেল বলা (ক্রিয়া বিশেষণ)

প্রকারভেদ

বিশেষণ পদ ২ প্রকার- নাম বিশেষণ ও ভাব বিশেষণ।

১. নাম বিশেষণ :

যে বিশেষণ পদ কোন বিশেষ্য বা সর্বনাম পদকে বিশেষায়িত করে, অর্থাৎ অন্য কোন পদ সম্পর্কে কিছু বলে, তাকে নাম বিশেষণ বলে। যেমন-

  • বিশেষ্যের বিশেষণ : নীল আকাশ আর সবুজ মাঠের মাঝ দিয়ে একটি ছোট্ট পাখি উড়ে যাচ্ছে।
  • সর্বনামের বিশেষণ : সে রূপবান ও গুণবান।

২. ভাব বিশেষণ :

যে বিশেষণ পদ বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ ছাড়া অন্য কোন পদকে বিশেষায়িত করে, অর্থাৎ অন্য কোন পদ সম্পর্কে কিছু বলে, তাকে ভাব বিশেষণ বলে। ভাব বিশেষণ ৪ প্রকার-

  • ক্রিয়া বিশেষণ : ধীরে ধীরে বায়ু বয়। পরে এক বার এসো।
  • বিশেষণের বিশেষণ (কোন বিশেষণ যদি অন্য একটি বিশেষণকেও বিশেষায়িত করে, তাকে বিশেষণের বিশেষণ বলে) :
  • নাম বিশেষণের বিশেষণ : সামান্য একটু দুধ দাও। এ ব্যাপারে সে অতিশয় দুঃখিত।
  • ক্রিয়া বিশেষণের বিশেষণ : রকেটি অতি দ্রুত চলে।
  • অব্যয়ের বিশেষণ (অব্যয় পদ বা অব্যয় পদের অর্থকে বিশেষায়িত করে) : ধিক তারে, শত ধিক নির্লজ্জ যে জন।
  • বাক্যের বিশেষণ (কোন পদকে বিশেষায়িত না করে সম্পূর্ণ বাক্যটিকেই বিশেষায়িত করে) :দুর্ভাগ্যক্রমে দেশ আবার নানা সমস্যাজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাস্তবিকই আজ আমাদের কঠিন পরিশ্রমের প্রয়োজন।

[না-বাচক ক্রিয়া বিশেষণ :

নি-

  • এখনো দেখ নি তুমি?
  • ফুল কি ফোটে নি শাখে?
  • পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন? রাখি নি সন্ধান
  • রহে নি, সে ভুলে নি তো

না-

  • বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?
  • রচিয়া লহ না আজও গীতি।
  • ভুলিতে পারি না কোন মতে।

নাই-

  • শুনি নাই, রাখি নি সন্ধান
  • নাই হল, না হোক এবারে
  • করে নাই অর্ঘ্য বিরুন?]

নির্ধারক বিশেষণ : দ্বিরুক্ত শব্দ ব্যবহার করে যখন একের বেশি কোনো কিছুকে বোঝানো হয় তাকে নির্ধারক বিশেষণ বলে। যেমন-

  • রাশি রাশি ভারা ভারা ধান (সোনার তরী)
  • লাল লাল কৃষ্ণচূড়ায় গাছ ভরে আছে।
  • নববর্ষ উপলক্ষে ঘরে ঘরে সাড়া পড়ে গেছে।
  • এত ছোট ছোট উত্তর লিখলে হবে না।

[বিশেষণবাচক ‘কী’

কী-শব্দটির একটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে বিশেষণ হিসেবে এর ব্যবহার।

যেমন, ‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতায় :

  • এই যে আসুন, তারপর কী খবর?
  • নিজেই চমকে, কী নিস্পৃহ, কেমন শীতল।
  • কী সহজে হয়ে গেল বলা। (ক্রিয়াবিশেষণের বিশেষণ/ বিশেষণের বিশেষণ)]

[বিশেষণ সম্বন্ধ

  • পাথরের টুকরো
  • আমাদের গ্রামের পুকুর
  • গ্রীষ্মের পুকুর
  • শোকের নদী
  • আমার সন্তান]

বিশেষণের অতিশায়ন (degree)

বিশেষণ পদ যখন দুই বা ততোধিক বিশেষ্য বা সর্বনাম পদের মধ্যে তুলনা বোঝায়, তখন তাকে বিশেষণের অতিশায়ন বলে। বাংলা ভাষায় খাঁটি বাংলা শব্দের বা তদ্ভব শব্দের একরকম অতিশায়ন প্রচলিত আছে, আবার তৎসম শব্দে সংস্কৃত ভাষার অতিশায়নের নিয়মও প্রচলিত আছে।

ক) বাংলা শব্দের বা তদ্ভব শব্দের অতিশায়ন

১. দুয়ের মধ্যে অতিশায়ন বোঝাতে দুইটি বিশেষ্য বা সর্বনামের মাঝে চাইতে, হইতে, হতে, থেকে, চেয়ে, অপেক্ষা, ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। প্রায়ই প্রথম বিশেষ্যটির সঙ্গে ষষ্ঠী বিভক্তি (র, এর) যুক্ত হয়। যেমন-

  • গরুর থেকে ঘোড়ার দাম বেশি।
  • বাঘের চেয়ে সিংহ বলবান।

ব্যতিক্রম : কখনো কখনো প্রথম বিশেষ্যের শেষের ষষ্ঠী বিভক্তিই হতে, থেকে, চেয়ে-র কাজ করে। যেমন-

  • এ মাটি সোনার বাড়া। (সোনার চেয়েও বাড়া)

২. বহুর মধ্যে অতিশায়নে বিশেষণের পূর্বে সবচাইতে, সর্বাপেক্ষা, সবথেকে, সবচেয়ে,সর্বাধিক, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন-

  • তোমাদের মধ্যে করিম সবচেয়ে বুদ্ধিমান।
  • পশুর মধ্যে সিংহ সর্বাপেক্ষা বলবান।

৩. দুয়ের মধ্যে অতিশায়নে জোর দিতে গেলে মূল বিশেষণের আগে অনেক, অধিক, বেশি, অল্প, কম অধিকতর, ইত্যাদি শব্দ যোগ করতে হয়। যেমন-

  • পদ্মফুল গোলাপের চাইতে বেশি সুন্দর।
  • ঘিয়ের চেয়ে দুধ বেশি উপকারী।
  • কমলার চাইতে পাতিলেবু অল্প ছোট।

খ) তৎসম শব্দের অতিশায়ন

১. দুয়ের মধ্যে তুলনা বোঝালে বিশেষণের শেষে ‘তর’ যোগ হয়

বহুর মধ্যে তুলনা বোঝালে বিশেষণের শেষে ‘তম’ যোগ হয়। যেমন-

  • গুরু- গুরুতর- গুরুতম
  • দীর্ঘ- দীর্ঘতর- দীর্ঘতম

[তবে কোনো বিশেষণের শেষে ‘তর’ যোগ করলে সেটা যদি আবার শ্রচতিকটু হয়ে যায়, শুনতে খারাপ লাগে, তখন বিশেষণটির শেষে ‘তর’ যোগ না করে বিশেষণের আগে ‘অধিকতর’ শব্দটি যোগ করা হয়। যেমন- ‘অধিকতর সুশ্রী’।]

২. আবার, দুয়ের মধ্যে তুলনা বোঝালে বিশেষণের শেষে ‘ঈয়স’ প্রত্যয় যুক্ত হয়

বহুর মধ্যে তুলনা বোঝালে বিশেষণের শেষে ‘ইষ্ঠ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়। যেমন-

  • লঘু- লঘীয়ান- লঘিষ্ঠ
  • অল্প- কনীয়ান- কনিষ্ঠ
  • বৃদ্ধ- জ্যায়ান- জ্যেষ্ঠ
  • শ্রেয়- শ্রেয়ান- শ্রেষ্ঠ

[দুয়ের তুলনায় এই নিয়মের ব্যবহার বাংলায় হয় না। অর্থাৎ, বাংলায় লঘীয়ান, কনীয়ান, জ্যায়ান, শ্রেয়ান, ইত্যাদি শব্দগুলোর প্রচলন নেই। তবে ‘ঈয়স’ প্রত্যয়যুক্ত কতোগুলো শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ বাংলায় প্রচলিত রয়েছে। যেমন- ভূয়সী প্রশংসা।]

৩. সর্বনাম পদ

বিশেষ্য পদের পরিবর্তে যে পদ ব্যবহৃত হয়, তাকেই সর্বনাম পদ বলে।

অনুচ্ছেদে বা প্যারাগ্রাফে একই বিশেষ্য পদ বারবার আসতে পারে। সেক্ষেত্রে একই পদ বারবার ব্যবহার করলে তা শুনতে খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। এই পুনরাবৃত্তি রোধ করার জন্য বিশেষ্য পদের পরিবর্তে অনুচ্ছেদে যে বিকল্প শব্দ ব্যবহার করে সেই বিশেষ্য পদকেই বোঝানো হয়, তাকে সর্বনাম পদ বলে।

[সর্বনাম পদগুলো সব বিশেষ্য বা নামের পরিবর্তে বসতে পারে বলে এদেরকে ‘সর্বনাম’ বলে।]

‘বাংলাদেশ অত্যন্ত সুন্দর একটি দেশ। এই দেশটি যেমন সুন্দর, এই দেশের মানুষগুলোও তেমনি ভালো।তারা এতোটাই ভদ্র ও মার্জিত যে, তাদের কাছে ভিখারি ভিক্ষা চাইতে আসলে তারা তাদের বিতাড়িত করে না। বরং মার্জিতভাবে বলে, মাফ করেন।’

উপরের অনুচ্ছেদে মূলত ৩টি বিশেষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশের মানুষ’ ও ‘ভিখারি’। এবং প্রথমবার উল্লেখের পর দ্বিতীয়বার কোন বিশেষ্যই আর উল্লেখ করা হয়নি। পরের বার থেকে ‘বাংলাদেশ’-র বদলে ‘এই দেশ’; ‘বাংলাদেশের (এই দেশের) মানুষ’-র বদলে ‘তারা’ ও ‘তাদের’ এবং ‘ভিখারি’-র বদলে ‘তাদের’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ্য পদের বদলে ব্যবহৃত এই শব্দগুলোই হলো সর্বনাম পদ।

প্রকারভেদ

সর্বনাম পদগুলোকে মূলত ১০ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

১. ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক     : আমি, আমরা, তুমি, তোমরা, সে, তারা, তাহারা, তিনি, তাঁরা, এ, এরা, ও, ওরা

২. আত্মবাচক             : স্বয়ং, নিজ, খোদ, আপনি

৩. সামীপ্যবাচক        : এ, এই, এরা, ইহারা, ইনি

৪. দূরত্ববাচক             : ঐ, ঐসব, সব

৫. সাকল্যবাচক         : সব, সকল, সমুদয়, তাবৎ

৬. প্রশ্নবাচক                 : কে, কি, কী, কোন, কাহার, কার, কিসে

৭. অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক   : কোন, কেহ, কেউ, কিছু

৮. ব্যতিহারিক               : আপনা আপনি, নিজে নিজে, আপসে, পরস্পর

৯. সংযোগজ্ঞাপক          : যে, যিনি, যাঁরা, যাহারা

১০. অন্যাদিবাচক          : অন্য, অপর, পর

সাপেক্ষ সর্বনাম : কখনও কখনও পর্সপর সম্পর্কযুক্ত একাধিক সর্বনাম পদ একই সঙ্গে ব্যবহৃত হয়ে দুটি বাক্যের সংযোগ সাধন করে থাকে। এদেরকে বলা হয় সাপেক্ষ সর্বনাম। যেমন-

  • যত চাও তত লও (সোনার তরী)
  • যত চেষ্টা করবে ততই সাফল্যের সম্ভাবনা।
  • যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা।
  • যত গর্জে তত বর্ষে না।
  • যেই কথা সেই কাজ।
  • যেমন কর্ম তেমন ফল।
  • যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল।

৪. ক্রিয়া পদ

যে পদ দিয়ে কোন কাজ করা বোঝায়, তাকে ক্রিয়া পদ বলে।

অর্থাৎ, বাক্যের অন্তর্গত যে পদ দ্বারা কোন কাজ সম্পাদন করা বা কোন কাজ সংঘটন হওয়াকে বোঝায়, তাকে ক্রিয়া পদ বলে।

ক্রিয়ামূল বা ধাতুর সঙ্গে পুরুষ ও কাল অনুযায়ী ক্রিয়াবিভক্তি যুক্ত হয়ে ক্রিয়াপদ গঠিত হয়। যেমন, ‘পড়্’ একটি ধাতু। এর সঙ্গে উত্তম পুরুষ ও সাধারণ বর্তমান কাল অনুযায়ী ‘ই’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে গঠিত হয় ‘পড়ি’ ক্রিয়াপদটি। আবার মধ্যম পুরুষের জন্য হবে ‘পড়ো’। নাম পুরুষের জন্য হবে ‘পড়ে’। আবার উত্তম পুরুষের জন্য ঘটমান বর্তমান কালের জন্য হবে ‘পড়ছি’। সাধারণ অতীত কালের জন্য হবে ‘পড়েছি’।

[ক্রিয়া পদ বাক্যের অপরিহার্য অঙ্গ। শুধু ক্রিয়াপদ নিয়ে একটি বাক্য গঠিত হতে পারে। কিন্তু ক্রিয়া পদ ছাড়া কোন বাক্য গঠিত হতে পারে না। তবে মাঝে মাঝে অনেক বাক্যের ক্রিয়াপদটি উহ্য থাকে। যেমন- ‘রমেশ আমার ভাই (হয়)।’ এই বাক্যে ‘হয়’ ক্রিয়াটি উহ্য থাকে, এটি না লিখলেও সবাই বুঝতে পারে। আর তাই এটি লেখাও হয় না। কিন্তু এটা আবার ইংরেজি করলে ‘হয়’-র ইংরেজি লেখা হয়- Ramesh is my brother.

সাধারণত, ‘হ্’ ও আছ্’ ধাতু বা ক্রিয়ামূল দ্বারা গঠিত ক্রিয়া পদগুলো উহ্য থাকে।]

ক্রিয়ার প্রকারভেদ

১. সমাপিকা-অসমাপিকা ক্রিয়া

বাক্যের ভাব প্রকাশের উপর ভিত্তি করে ক্রিয়াপদকে সমাপিকা ক্রিয়া ও অসমাপিকা ক্রিয়া, এই দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে।

সমাপিকা ক্রিয়া : যে ক্রিয়া পদ বাক্যের ভাবের পরিসমাপ্তি ঘটায়, তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে। অর্থাৎ, যে ক্রিয়া পদ বাক্যকে সম্পূর্ণ করে, আর কিছু শোনার আকাঙ্ক্ষা বাকি থাকে না, তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে।

একটি বাক্যে একটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকতেই হয়। এবং একটি বাক্যে একটার বেশি সমাপিকা ক্রিয়া থাকতে পারে না। যেমন-

  • ছেলেরা খেলছে। ছেলেরা খেলা করছে।

দ্বিতীয় বাক্যে ‘খেলা’ সমাপিকা ক্রিয়া নয়। এ জন্য ‘করছে’ সমাপিকা ক্রিয়া আনতে হয়েছে। নয়তো বাক্যটি সম্পূর্ণ হচ্ছে না।

অসমাপিকা ক্রিয়া : যে ক্রিয়া পদ দ্বারা বাক্যের ভাবের পরিসমাপ্তি ঘটে না, তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে। অর্থাৎ, যে ক্রিয়া দ্বারা বাক্য সম্পূর্ণ হয় না, আরো কিছু শোনার আকাঙ্ক্ষা থেকেই যায়, তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে।

অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহারের পরও বাক্যে সমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার করতে হয়। শুধু অসমাপিকা ক্রিয়া দিয়ে বাক্য গঠিত হয় না।

একটি বাক্যে যতোগুলো ইচ্ছা অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার করা যায়। কিন্তু একটি সমাপিকা ক্রিয়া আনতেই হয়। যেমন-

  • ছেলেরা খেলা।

এখানে খেলা একটি অসমাপিকা ক্রিয়া। ক্রিয়া পদ হলেও এটি দিয়ে বাক্যটি সম্পূর্ণ হয়নি, আরো কিছু শোনার আকাঙ্ক্ষা থেকেই যাচ্ছে। এর সঙ্গে আরেকটি সমাপিকা ক্রিয়া ‘করছে’ যোগ করলেই কেবল বাক্যটি সম্পূর্ণ হবে।

  • ছেলেরা খেলা করছে।

সাধারণত অসমাপিকা ক্রিয়ার শেষে ইয়া, ইলে, ইতে, এ, লে, তে বিভক্তিগুলো যুক্ত থাকে।

২. সকর্মক-অকর্মক-দ্বিকর্মক ক্রিয়া

বাক্যে ক্রিয়ার কর্মের উপর ভিত্তি করে ক্রিয়াপদকে অকর্মক, সকর্মক ও দ্বিকর্মক- এই ৩ ভাগে ভাগ করা হয়।

কর্ম পদ : যে পদকে আশ্রয় করে ক্রিয়া পদ তার কাজ সম্পাদন বা সংঘটন করে, তাকে কর্ম পদ বলে। অর্থাৎ, ক্রিয়া পদ কাজ করার জন্য যেই পদকে ব্যবহার করে, তাকে কর্ম পদ বলে।

ক্রিয়া পদকে ‘কী/ কাকে’ দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, সেটিই কর্মপদ। আর যদি উত্তর না পাওয়া যায়, তবে সেই ক্রিয়ার কোন কর্মপদ নেই। যেমন-

  • মেয়েটি কলম কিনেছে।
  • মেয়েটি হাসে।

এখানে প্রথম বাক্যে ক্রিয়াপদ ‘কিনেছে’কে ‘কী’ দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায় ‘কলম’। (কী কিনেছে?- কলম) অর্থাৎ, প্রথম বাক্যের ক্রিয়ার কর্মপদ কলম।

আবার দ্বিতীয় বাক্যের ক্রিয়াপদ ‘হাসে’কে ‘কী/ কাকে’ কোনটা দিয়ে প্রশ্ন করলেই কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং, এই বাক্যের ক্রিয়াপদের কোন কর্ম নেই।

অকর্মক ক্রিয়া : যে ক্রিয়াপদের কোন কর্ম নেই তাকে অকর্মক ক্রিয়া বলে।

সকর্মক ক্রিয়া : যে ক্রিয়াপদের কর্ম পদ আছে তাকে সকর্মক ক্রিয়া বলে।

দ্বিকর্মক ক্রিয়া : কখনো কখনো একটি বাক্যে একই ক্রিয়াপদের দুটি কর্ম পদ থাকে। তখন সেই ক্রিয়াপদকে দ্বিকর্মক ক্রিয়া বলে। এক্ষেত্রে, বস্তুবাচক কর্মপদকে প্রধান বা মুখ্য কর্ম বলে এবং ব্যক্তিবাচক কর্মপদকে গৌণ কর্ম বলে। অর্থাৎ, বস্তুবাচক কর্মটিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। যেমন- ‘বাবা আমাকে একটি ল্যাপটপ কিনে দিয়েছেন।’

এখানে ‘কিনে দিয়েছেন’ ক্রিয়ার কর্মপদ দুটি, ‘আমাকে’ (কাকে কিনে দিয়েছেন?) ও ‘ল্যাপটপ’ (কী কিনে দিয়েছেন?)। এখানে বস্ত্তবাচক কর্মপদ ‘ল্যাপটপ’, আর ব্যক্তিবাচক কর্মপদ ‘আমাকে’। সুতরাং এখানে মুখ্য বা প্রধান কর্মপদ ‘ল্যাপটপ’ আর গৌণ বা অপ্রধান কর্ম ‘আমাকে’।

সমধাতুজ কর্ম : বাক্যের ক্রিয়াপদ ও কর্মপদ যদি একই ধাতু বা ক্রিয়ামূল থেকে গঠিত হয়, তবে তাকে সমধাতুজ কর্মপদ বলে। অর্থাৎ, ক্রিয়াপদ ও কর্মপদ একই শব্দমূল থেকে গঠিত হলে তাকে সমধাতুজ কর্মপদ বলে। যেমন-

  • আজ এমন ঘুম ঘুমিয়েছি।

এখানে ক্রিয়াপদ ‘ঘুমিয়েছি’, আর কর্মপদ ‘ঘুম’ (কী ঘুমিয়েছি?)। আর এই ‘ঘুমিয়েছি’ আর ‘ঘুম’ দুটি শব্দেরই শব্দমূল ‘ঘুম্’। অর্থাৎ, শব্দ দুইটি একই ধাতু হতে গঠিত (ক্রিয়ার মূলকে ধাতু বলে)। সুতরাং, এই বাক্যে ‘ঘুম’ কর্মটি একটি সমধাতুজ কর্ম। এরকম-

  • আজ কী খেলা খেললাম। (খেল্)
  • আর মায়াকান্না কেঁদো না। (কাঁদ্)
  • এমন মরণ মরে কয়জনা? (মর্)

৩. প্রযোজক ক্রিয়া

যে ক্রিয়া একজনের প্রযোজনায় আরেকজন করে তাকে প্রযোজক ক্রিয়া বলে।

প্রযোজক ক্রিয়ার দু’জন কর্তা থাকে। এরমধ্যে একজন কর্তা কাজটি আরেকজন কর্তাকে দিয়ে করান। অর্থাৎ, একজন যখন আরেকজনকে দিয়ে কোন কাজ করিয়ে নেয়, তখন সেই ক্রিয়াপদটিকে বলে প্রযোজক ক্রিয়া। [সংস্কৃত ব্যাকরণে এরই নাম ণিজন্ত ক্রিয়া।]

প্রযোজক ক্রিয়ার দুইজন কর্তার মধ্যে যিনি কাজটি করান, তাকে বলে প্রযোজক কর্তা। আর যিনি কাজটি করেন, তাকে বলে প্রযোজ্য কর্তা। তাকে দিয়ে কাজটি প্রযোজ্য করা হয় বলে তাকে প্রযোজ্য কর্তা বলে। যেমন-

  • মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন।

এখানে চাঁদ দেখার কাজটি করছে ‘শিশু’, কিন্তু চাঁদ দেখাচ্ছেন ‘মা’। অর্থাৎ, ‘মা’ কাজটি প্রযোজনা করছেন। তাই ‘মা’ এখানে প্রযোজক কর্তা। আর চাঁদ দেখার কাজটি আসলে ‘শিশু’ করছে, তাই ‘শিশু’ এখানে প্রযোজ্য কর্তা। এরকম-

  • সাপুড়ে সাপ খেলায়। (এখানে সাপুড়ে প্রযোজক কর্তা, আর সাপ প্রযোজ্য কর্তা)

৪. নামধাতুর ক্রিয়া

বিশেষ্য, বিশেষণ ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের পরে ‘আ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে যে সব ধাতু গঠিত হয়, তাদেরকে নামধাতু বলে। নামধাতুর সঙ্গে ক্রিয়াবিভক্তি যুক্ত হয়ে যেসব ক্রিয়াপদ গঠন করে, তাদেরকেই নামধাতুর ক্রিয়া বলে।

যেমন-

  • বিশেষ্য = বেত+আ = বেতা, ক্রিয়াপদ = বেতানো, বেতাচ্ছেন, বেতিয়ে
  • বিশেষণ = বাঁকা+আ = বাঁকা, ক্রিয়াপদ = বাঁকানো, বাঁকাচ্ছেন, বাঁকিয়ে
  • ধ্বন্যাত্মক অব্যয় = কন কন+আ = কনকনা, ক্রিয়াপদ = কনকনাচ্ছে, কনকনিয়ে

বাক্যে প্রয়োগ- লোকটি ছেলেটিকে বেতাচ্ছে।

  • কঞ্চিটি বাঁকিয়ে ধর।
  • দাঁত ব্যথায় কনকনাচ্ছে। অজগরটি ফোঁসাচ্ছে।

ব্যতিক্রম : কয়েকটি নামধাতু ‘আ’ প্রত্যয় ছাড়াই ধাতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন-

  • ফল = বাগানে এবার অনেক আম ফলেছে।
  • টক = তরকারি বাসি হলে টকে।
  • ছাপা = প্রকাশক তার বইটা এবার মেলায় ছেপেছে।

 ৫. যৌগিক ক্রিয়া

একটি সমাপিকা ক্রিয়া ও একটি অসমাপিকা ক্রিয়া পাশাপাশি বসে যদি কোন বিশেষ বা সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে, তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে। অর্থাৎ, একটি সমাপিকা ও একটি অসমাপিকা ক্রিয়া মিলে যদি তাদের সাধারণ অর্থ প্রকাশ না করে কোন বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে। যেমন-

  • ঘটনাটা শুনে রাখ। (শোনার বদলে তাগিদ দেয়া অর্থ বুঝিয়েছে)
  • তিনি বলতে লাগলেন। (বলার অর্থ সম্প্রসারণ করে নিরন্তর বলা বুঝিয়েছে)
  • ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়ল। (শোওয়ার পাশাপাশি দিনের কার্যসমাপ্তিও বোঝাচ্ছে)
  • সাইরেন বেজে উঠল। (আকস্মিক সাইরেন বাজার কথা বলা হচ্ছে)
  • শিক্ষায় মন সংস্কারমুক্ত হয়ে থাকে। (অভ্যস্ততা অর্থে, ধীরে ধীরে সংস্কারমুক্ত হয় বোঝাচ্ছে)
  • এখন যেতে পার। (যাওয়ার বদলে অনুমোদন অর্থে)

৬. মিশ্র ক্রিয়া

বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের সঙ্গে কর্, হ্, দে, পা, যা, কাট্, গা, ছাড়্, ধর্, মার্, প্রভৃতি ধাতু যোগ হয়ে ক্রিয়াপদ গঠন করে কোন বিশেষ অর্থ প্রকাশ করলে তাকে মিশ্র ক্রিয়া বলে। যেমন-

বিশেষ্যের পরে :

  • আমরা তাজমহল দর্শন করলাম।
  • গোল্লায় যাও।

বিশেষেণের পরে :

  • তোমাকে দেখে বিশেষ প্রীত হলাম।

ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের পরে :

  • মাথা ঝিম ঝিম করছে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।

[খেয়াল রাখতে হবে, যৌগিক ক্রিয়া দুইটি ক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়, যার একটি সমাপিকা ক্রিয়া আরেকটি অসমাপিকা ক্রিয়া। অন্যদিকে, মিশ্র ক্রিয়া বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের পরে ক্রিয়াপদ বসে গঠিত হয়।]

পুরুষভেদে ক্রিয়ার রূপ

পুরুষ সাধারণ সম্ভ্রমাত্মক তুচ্ছার্থক/ ঘনিষ্ঠার্থক
উত্তম পুরুষ আমি যাইআমরা যাই ——— ——
মধ্যম পুরুষ তুমি যাওতোমরা যাও আপনি যানআপনারা যান তুই যাতোরা যা
নাম পুরুষ সে যায়তারা যায় তিনি যানতাঁরা যান এটা যায়এগুলো যায়

[উত্তম পুরুষ : বাক্যের বক্তাই উত্তম পুরুষ। অর্থাৎ, যেই ব্যক্তি বাক্যটি বলেছে, সেই উত্তম পুরুষ। উত্তম পুরুষের সর্বনামের রূপ হলো- আমি, আমরা, আমাকে, আমাদের, ইত্যাদি।

মধ্যম পুরুষ : বাক্যের উদ্দিষ্ট শ্রোতাই মধ্যম পুরুষ। অর্থাৎ, উত্তম পুরুষ যাকে উদ্দেশ্য করে বাক্যটি বলে, এবং পাশাপাশি বাক্যেও উল্লেখ করে, তাকে মধ্যম পুরুষ বলে। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষভাবে উদ্দিষ্ট শ্রোতাই মধ্যম পুরুষ। মধ্যম পুরুষের সর্বনামের রূপ হলো- তুমি, তোমরা, তোমাকে, তোমাদের, তোমাদিগকে, আপনি, আপনার, আপনাদের, ইত্যাদি।

নামপুরুষ : বাক্যে বক্তা অনুপস্থিত যেসব ব্যক্তি, বস্ত্ত বা প্রাণীর উল্লেখ করেন, তাদের নামপুরুষ বলে। অর্থাৎ, বক্তার সামনে নেই এমন যা কিছুর কথা বক্তা বাক্যে বলেন, সবগুলোই নামপুরুষ। নাম পুরুষের সর্বনামের রূপ হলো- সে, তারা, তাহারা, তাদের, তাহাকে, তিনি, তাঁকে, তাঁরা, তাঁদের, ইত্যাদি।]

 ৫. অব্যয় পদ

অব্যয় শব্দকে ভাঙলে পাওয়া যায় ‘ন ব্যয়’, অর্থাৎ যার কোন ব্যয় নেই।

যে পদের কোন ব্যয় বা পরিবর্তন হয় না, তাকে অব্যয় পদ বলে। অর্থাৎ, যে পদ সর্বদা অপরিবর্তনীয় থাকে, যার সঙ্গে কোন বিভক্তি যুক্ত হয় না এবং পুরুষ বা বচন বা লিঙ্গ ভেদে যে পদের রূপের বা চেহারারও কোন পরিবর্তন হয় না, তাকে অব্যয় পদ বলে।

অব্যয় পদ বাক্যে কোন পরিবর্তন ছাড়াই ব্যবহৃত হয় এবং বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে কখনো বাক্যকে আরো শ্রচতিমধুর করে, কখনো একাধিক পদ বা বাক্যাংশ বা বাক্যের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করে।

বাংলা ভাষায় ৩ ধরনের অব্যয় শব্দ ব্যবহৃত হয়-

১. বাংলা অব্যয় শব্দ : আর, আবার, ও, হাঁ, না

২. তৎসম অব্যয় শব্দ : যদি, যথা, সদা, সহসা, হঠাৎ, অর্থাৎ, দৈবাৎ, বরং, পুনশ্চ, আপাতত, বস্ত্তত।

‘এবং’ ও ‘সুতরাং’ এই দুটি অব্যয় শব্দও তৎসম, অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। তবে এ দুটি অব্যয় শব্দের অর্থ বাংলা ভাষায় এসে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সংস্কৃতে ‘এবং = এমন’ আর ‘সুতরাং = অত্যন্ত, অবশ্য’

বাংলায় ‘এবং = ও’     আর ‘সুতরাং = অতএব’

৩. বিদেশি অব্যয় শব্দ : আলবত, বহুত, খুব, শাবাশ, খাসা, মাইরি, মারহাবা

অব্যয়ের প্রকারভেদ

অব্যয় পদ মূলত ৪ প্রকার-

১. সমুচ্চয়ী অব্যয় :

যে অব্যয় পদ একাধিক পদের বা বাক্যাংশের বা বাক্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে, তাকে সমুচ্চয়ী অব্যয় বলে। এই সম্পর্ক সংযোজন, বিয়োজন বা সংকোচন যে কোনটিই হতে পারে। একে সম্বন্ধবাচক অব্যয়ও বলে।

সংযোজক অব্যয় : উচ্চপদ ও সামাজিক মর্যাদা সকলেই চায়। (উচ্চপদ, সামাজিক মর্যাদা- দুটোই চায়)

তিনি সৎ, তাই সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। (তাই অব্যয়টি ‘তিনি সৎ’ ও ‘সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করে’ বাক্য দুটির মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছে।

এরকম- ও, আর, তাই, অধিকন্তু, সুতরাং, ইত্যাদি।

ক) বিয়োজক অব্যয় :

আবুল কিংবা আব্দুল এই কাজ করেছে। (আবুল, আব্দুল- এদের একজন করেছে, আরেকজন করেনি। সম্পর্কটি বিয়োগাত্মক, একজন করলে অন্যজন করেনি।)
মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। (‘মন্ত্রের সাধন’ আর ‘শরীর পাতন’ বাক্যাংশ দুটির একটি সত্য হবে, অন্যটি মিথ্যা হবে।)
এরকম- কিংবা, বা, অথবা, নতুবা, না হয়, নয়তো, ইত্যাদি।

খ) সংকোচক অব্যয় :

তিনি শিক্ষিত, কিন্তু অসৎ। (এখানে ‘শিক্ষিত’ ও ‘অসৎ’ দুটোই সত্য, কিন্তু শব্দগুলোর মধ্যে সংযোগ ঘটেনি। কারণ, বৈশিষ্ট্য দুটো একরকম নয়, বরং বিপরীতধর্মী। ফলে তিনি অসৎ বলে তিনি শিক্ষিত বাক্যাংশটির ভাবের সংকোচ ঘটেছে।)
এরকম- কিন্তু, বরং, তথাপি, যদ্যপি, ইত্যাদি।

২. অনন্বয়ী অব্যয় : যে সব অব্যয় পদ নানা ভাব বা অনুভূতি প্রকাশ করে, তাদেরকে অনন্বয়ী অব্যয় বলে। এগুলো বাক্যের অন্য কোন পদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক না রেখে স্বাধীনভাবে বাক্যে ব্যবহৃত হয়। যেমন-

উচ্ছ্বাস প্রকাশে                : মরি মরি! কী সুন্দর সকাল!

স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি প্রকাশে  : হ্যা, আমি যাব। না, তুমি যাবে না।

সম্মতি প্রকাশে                : আমি আজ নিশ্চয়ই যাব।

অনুমোদন প্রকাশে            : এতো করে যখন বললে, বেশ তো আমি আসবো।

সমর্থন প্রকাশে                 : আপনি তো ঠিকই বলছেন।

যন্ত্রণা প্রকাশে                  : উঃ! বড্ড লেগেছে।

ঘৃণা বা বিরক্তি প্রকাশে      : ছি ছি, তুমি এতো খারাপ!

সম্বোধন প্রকাশে               : ওগো, তোরা আজ যাসনে ঘরের বাহিরে।

সম্ভাবনা প্রকাশে               : সংশয়ে সংকল্প সদা টলে/ পাছে লোকে কিছু বলে।

বাক্যালংকার হিসেবে         : কত না হারানো স্মৃতি জাগে আজ মনে।

: হায়রে ভাগ্য, হায়রে লজ্জা, কোথায় সভা, কোথায় সজ্জা।

৩. অনুসর্গ অব্যয় :

যেসব অব্যয় শব্দ বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের বিভক্তির কাজ করে, এবং কারকবাচকতা প্রকাশ করে, তাকে অনুসর্গ অব্যয় বলে। অর্থাৎ, যেই অব্যয় অনুসর্গের মতো ব্যবহৃত হয়, তাকে অনুসর্গ অব্যয় বলে। যেমন-

ওকে দিয়ে এ কাজ হবে না। (এখানে ‘দিয়ে’ তৃতীয়া বিভক্তির মতো কাজ করেছে, এবং ‘ওকে’ যে কর্ম কারক, তা নির্দেশ করেছে। এই ‘দিয়ে’ হলো অনুসর্গ অব্যয়।)

[কারক ও বিভক্তি]    [অনুসর্গ]

৪. অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয় :

বিভিন্ন শব্দ বা প্রাণীর ডাককে অনুকরণ করে যেসব অব্যয় পদ তৈরি করা হয়েছে, তাদেরকে অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয় বলে।

মানুষ আদিকাল থেকেই অনুকরণ প্রিয়। তারা বিভিন্ন ধরনের শব্দ, প্রাকৃতিক শব্দ, পশুপাখির ডাক, যেগুলো তারা উচ্চারণ করতে পারে না, সেগুলোও উচ্চারণ করার চেষ্টা করেছে। এবং তা করতে গিয়ে সে সকল শব্দের কাছাকাছি কিছু শব্দ তৈরি করেছে। বাংলা ভাষার এ সকল শব্দকে বলা হয় অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয়। যেমন-

  • বজ্রের ধ্বনি- কড় কড়
  • তুমুল বৃষ্টির শব্দ- ঝম ঝম
  • স্রোতের ধ্বনি- কল কল
  • বাতাসের শব্দ- শন শন
  • নূপুরের আওয়াজ- রুম ঝুম
  • সিংহের গর্জন- গর গর
  • ঘোড়ার ডাক- চিঁহি চিঁহি
  • কোকিলের ডাক- কুহু কুহু
  • চুড়ির শব্দ-টুং টাং

শুধু বিভিন্ন শব্দই না, মানুষ তাদের বিভিন্ন অনুভূতিকেও শব্দের আকারে ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছে। ফলে বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি প্রকাশের জন্য তারা বিভিন্ন শব্দ তৈরি করেছে। এগুলোও অনুকার অব্যয়। যেমন-

  • ঝাঁ ঝাঁ (প্রখরতা)
  • খাঁ খাঁ (শূণ্যতা)
  • কচ কচ
  • কট কট
  • টল মল
  • ঝল মল
  • চক চক
  • ছম ছম
  • টন টন
  • খট খট

কিছু বিশেষ অব্যয়

১. অব্যয় বিশেষণ : কোন অব্যয় বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে বিশেষণের কাজ করলে, তাকে অব্যয় বিশেষণ বলে।

  • নাম বিশেষণ : অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।
  • ক্রিয়া বিশেষণ : আবার যেতে হবে।
  • বিশেষণীয় বিশেষণ : রকেট অতি দ্রচত চলে।

২. নিত্য সম্বন্ধীয় বিশেষণ : কিছু কিছু যুগ্ম অব্যয় আছে, যারা বাক্যে একসাথে ব্যবহৃত হয়, এবং তাদের একটির অর্থ আরেকটির উপর নির্ভর করে। এদের নিত্য সম্বন্ধীয় বিশেষণ বলে। যেমন- যথা-তথা, যত-তত, যখন-তখন, যেমন-তেমন, যে রূপ-সে রূপ, ইত্যাদি। উদাহরণ-

  • যত গর্জে তত বর্ষে না।
  • যেমন কর্ম তেমন ফল।

৩. ত প্রত্যয়ান্ত বিশেষণ : ত প্রত্যয়ান্ত কিছু তৎসম অব্যয় বাংলায় ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃততে প্রত্যয়টি ছিল ‘তস্’, বাংলায় তা হয়েছে ‘ত’। যেমন- ধর্মত, দুর্ভাগ্যবশত, অন্তত, জ্ঞানত, ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *