বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক ম্যাগনা কার্টা সাথে তুলনা করা হয়। এটাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়ে থাকে। ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান শাসনের দীর্ঘ ২৪ বছরের অত্যাচার, নিপীড়ন ও বাঙালির অধিকার আদায়ের কথা তুলে ধরা হয়। এই একটি ভাষণে ঘুমিয়ে থাকা বাঙালি জেগে ওঠে, হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। স্বাধিকার আন্দোলন থেকে রুপ নেয় স্বাধীনতার আন্দোলন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল জনসভা। যে জনসভা রূপ নেয় জনসমুদ্রে। সেদিন প্রায় দশ লক্ষ্য এর অধিক মানুষ জমায়েত হন। শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত এক ঐতিহাসিক ভাষণ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয় যা বিকেল ৩টা ০৩ মিনিটে শেষ হয়। বঙ্গবন্ধু ১৮ মিনিট ভাষণ দেন। তিনি সেদিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’
মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পাকিস্তান সরকারের কাছে চার দফা দাবি পেশ করেন। ৭ই মার্চের ভাষণে ৪ দফা দাবিগুলো হচ্ছে,
১. চলমান সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
২. অনতিবিলম্বে সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।
৩. গণহত্যার তদন্ত করা।
৪. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার করার অনুমতি দেয় নি। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, তৎকালীন পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এ.এইচ.এম সালাহউদ্দিন ও তৎকালীন ফরিদপুর জেলার ৫ আসনের সংসদ সদস্য এম আবুল খায়ের ভাষণটি ধারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাদের এ কাজে সাহার্য করেন চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা আবুল খায়ের, যিনি ভাষণের ভিডিও ধারণ করেন। সেই সাথে তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রযুক্তিবিদ এইচ এন খন্দকার ৭ মার্চের ভাষণের অডিও রেকর্ড করেন।
৩০শে অক্টোবর ২০১৭, ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইউনেস্কো ভাষণটিকে “ডকুমেন্টারি হেরিটেজ” (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পটভূমি
১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন বাকি, ২টি আসন পায় পিডিপি। সংরক্ষিত ৭টি আসনসহ আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ১৬৯টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা আওয়ামী লীগের এই বিজয় মেনে নিতে পারে নি। তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা ভুট্টো এবং পাকিস্তান সামরিক চক্র আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ফলে দেশব্যাপি বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়।
এই পরিস্থিতিতে, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে ১লা মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের এমন পরিস্থিতিকে একটি গভীর রাজনৈতিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করেন।
এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল কর্মসূচি পালিত হয়।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে, পাকিস্তান সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। সারাদেশে সরকারের বাহিনী হরতাল ঠেকাতে মাঠে নামে। স্বাধীনতাকামী জনগণ বিশাল মিছিল বের করে এবং রড ও লাঠি উচিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিন করে। বিক্ষোভ মিছিলে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ৫০ জনের মতো গুলিবিদ্ধ হন, যাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন মারা যান। শেখ মুজিবুর রহমান নিরস্ত্রদের উপর এমন গুলি বর্ষণের তীব্র নিন্দা জানায়।
পরদিন, বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে অর্ধদিবস (ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা) হরতালের ডাক দেন। ৩রা মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্বক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে, পাকিস্তান সামরিক সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে। সারা দেশে সরকারের বাহিনী হরতাল ঠেকাতে মাঠে নামে। স্বাধীনতাকামী জনগণ বিশাল মিছিল বের করে এবং রড ও লাঠি উচিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিন করে। বিক্ষোভ মিছিলে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ৫০ জনের মতো গুলিবিদ্ধ হন, যাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন মারা যান। শেখ মুজিবুর রহমান ও নিরস্ত্রদের উপর গুলি বর্ষণের তীব্র নিন্দা করা হয়। পরদিন ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে অর্ধদিবস (ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা) হরতালের ডাক দেন মুজিব।
এই পরিস্থিতিতে, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। এমন এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্সে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।”