বাংলা ব্যাকরণ ও এর আলােচ্য বিষয়

ব্যাকরণ (= বি + আ + vকৃ + অন) শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ বিশেষভাবে বিশ্লেষণ।

যে শাস্ত্রে কোনাে ভাষার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃতি ও স্বরূপের বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় এবং বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়ােগবিধি বিশদভাবে আলােচিত হয়, তাকে ব্যাকরণ বলে।

ব্যাকরণ পাঠের প্রয়ােজনীয়তা:

ব্যাকরণ পাঠ করে ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠন প্রকৃতি ও সেসবের সুষ্ঠু ব্যবহারবিধি সমপর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় এবং লেখায় ও কথায় ভাষা প্রয়ােগের সময় শুন্ধাশুদ্ধি নির্ধারণ সহজ হয়।

বাংলা ব্যাকরণ : যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠনপ্রকৃতি ও স্বরূপ বিশ্লেষিত হয় এবং এদের সম্পর্ক ও সুষ্ঠু প্রয়ােগবিধি আলােচিত হয়, তাই বাংলা ব্যাকরণ।

বাংলা ব্যাকরণে আলােচ্য বিষয়

প্রত্যেক ভাষারই চারটি মৌলিক অংশ থাকে। যেমন-

  1. ধ্বনি (Sound)
  2. শব্দ (Word)
  3. বাক্য (Sentence)
  4. অর্থ (Meaning)

সব ভাষার ব্যাকরণেই প্রধানত নিম্নলিখিত চারটি বিষয়ের আলােচনা করা হয়।

  • ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology)
  • শব্দত্ত্ব বা রূপত্ত্ব (Morphology)
  • বাক্যতত্ত্ব বা পদক্রম (Syntax) এবং
  • অর্থত্ত্ব (Semantics)

এ ছাড়া অভিধানত্ত্ব (Lexicography) ছন্দ ও অলংকার প্রভৃতিও ব্যাকরণের আলােচ্য বিষয়।

১. ধ্বনিতত্ত্ব

ধ্বনি : মানুষের বাক প্রত্যঙ্গ অর্থাৎ কণ্ঠনালি, মুখবিবর, জিহ্বা, আল-জিহ্বা, কোমল তালু, শক্ত তালু, দাঁত, মাড়ি, চোয়াল, ঠোট ইত্যাদির সাহায্যে উচ্চারিত আওয়াজকে ধ্বনি বলা হয়। বাক প্রত্যঙ্গজাত ধ্বনির সূক্ষ্মতম মৌলিক অংশ বা একককে (Unit) ধ্বনিমূল (Phoneme) বলা হয়।

বর্ণ : বাক প্রত্যক্তাজাত প্রত্যেকটি ধ্বনি এককের জন্য প্রত্যেক ভাষায়ই লেখার সময় এক একটি প্রতীক বা চিহ্ন (Symbol) ব্যবহৃত হয়। বাংলায় এ প্রতীক বা চিহ্নকে বলা হয় বর্ণ (Letter)।

যেমন-বাংলায় বক কথাটির প্রথম ধ্বনিটির প্রতীক রূপে ব্যবহার করা হয়েছে ব, ইংরেজিতে সে ধ্বনির জন্য ব্যবহ্ৃত হয় B বা b (বি); আবার আরবি, ফারসি ও উর্দুতে একই ধ্বনির জন্য ব্যবহ্ৃত হয় (বে)।

ধ্বনির উচ্চারণপ্রণালী, উচ্চারণের স্থান, ধ্বনির প্রতীক বা বর্ণের বিন্যাস, ধ্বনিসংযােগ বা সন্ধি, ধ্বনির পরিবর্তন ও লােপ, গত্ব ও ষত্ব বিধান ইত্যাদি বাংলা ব্যাকরণে ধ্বনিতত্ত্বের আলােচ্য বিষয়।

২. রূপত্ত্ব

এক বা একাধিক ধ্বনির অর্থবােধক সম্মিলনে শব্দ তৈরি হয়, শব্দের ক্ষুদ্রাংশকে বলা হয় রূপ (morpheme)। বূপ গঠন করে শব্দ। সেই জন্য শব্দতত্ত্বকে রূপত্ত্ব (Morphology) কলা হয়।

৩. বাক্যতত্ব

মানুষের বাক্প্রত্যক্তাজাত ধ্বনি সমন্বয়ে গঠিত শব্দসহযােগে সৃষ্ট অর্থবােধক বাক প্রবাহের বিশেষ বিশেষ অংশকে বলা হয় বাক্য (Sentence)। বাক্যের সঠিক গঠনপ্রণালী, বিভিন্ন উপাদানের সংযােজন, বিয়ােজন, এদের সার্থক ব্যবহারযােগ্যতা, বাক্যমধ্যে শব্দ বা পদের স্থান বা ক্ৰম, পদের রূপ পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় বাক্যতত্ত্বে আলােচিত হয়। বাক্যের মধ্যে কোন পদের পর কোন পদ বসে, কোন পদের স্থান কোথায় বাক্যতত্বে এসবের পূর্ণ বিশ্লেষণ থাকে। বাক্যতত্ত্বকে পদক্রমও বলা হয়।

৪. অর্থত্ত্ব

শব্দের অর্থবিচার, বাক্যের অর্থকিচার, অর্থের বিভিন্ন প্রকারতেদ, যেমন-মুখ্যার্থ, গৌণার্থ, বিপরীতার্থ ইত্যাদি অর্থতত্ত্বের আলােচ্য বিষয়।

বাংলা ব্যাকরণের আলােচনায় ব্যবহ্ৃত কতিপয় পারিভাযিক শব্দ : বাংলা ব্যাকরণের আলােচনার জন্য পণ্ডিতেরা কতিপয় পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ ধরনের প্রয়ােজনীয় কিছু পারিতাষিক শব্দের পরিচয় নিম্নে প্রদান করা হলাে :

প্রাতিপদিক: বিভক্তিহীন নাম শব্দকে প্রাতিপদিক বলে। যেমন- হাত, বই, কলম ইত্যাদি।

সাধিত শব্দ : মৌলিক শব্দ ব্যতীত অন্য সব শব্দকেই সাধিত শব্দ বলে। যথা- হাতা, গরমিল, ইত্যাদি।

সাধিত শব্দ দুই প্রকার :

  • নাম শব্দ ও
  • ক্রিয়া।

প্রত্যেকটি বা নামশব্দের ও ক্রিয়ার দুটি অংশ থাকে।

  • প্রকৃতি ও
  • প্রত্যয়।

প্রকৃতি : যে শব্দকে বা কোনাে শব্দের যে অংশকে আর কোনাে ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা যায় না, তাকে প্রকৃতি বলে।

প্রকৃতি দুই প্রকার :

  • নাম প্রকৃতি ও
  • ক্রিয়া প্রকৃতি বা ধাতু।

নাম প্রকৃতি : হাতল, ফুলেল, মুখর- এ শব্দগুলাে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই – হাত + ল = হাতল (বাঁট), ফুল + এল = ফুলেল (ফুলজাত) এবং মুখ + র = মুখর (বাচাল)। এখানে হাত, ফুল ও মুখ শব্দগুলােকে বলা হয় প্রকৃতি বা মূল অংশ। এগুলাের নাম প্রকৃতি।

ক্রিয়া প্রকৃতি : আবার চলন্ত, জমা ও লিখিত- এ শব্দগুলাে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই চল+অন্ত= চলন্ত (চলমান), জমা (সঞ্চিত) এবং Vলিখ + ইত = লিখিত (যা লেখা হয়েছে)। এখানে চল, জম্ ও লিখ – এ তিনটি ক্রিয়ামূল বা ক্রিয়ার মূল অংশ। এগুলােকে বলা হয় ক্রিয়া প্রকৃতি বা ধাতু।

প্রত্যয় : শব্দ গঠনের উদ্দেশ্যে নাম প্রকৃতির এবং ক্রিয়া প্রকৃতির পরে যে শব্দাংশ যুক্ত হয় তাকে প্রত্যয় বলে। কয়েকটি শব্দের প্রকৃতি ও প্রত্যয় বিশ্লেষণ করে দেখানাে হলাে।

বাংলা শব্দ গঠনে দুই প্রকার প্রত্যয় পাওয়া যায় :

  1. তদ্ধিত প্রত্যয় ও
  2. কৃৎ প্রত্যয়।

১. তদ্ধিত প্রত্যয় : শব্দমূল বা নাম প্রকৃতির সঙ্গে যে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়, তাকে বলে তন্ধিত প্রত্যয়।

যেমন-হাতল, ফুলেল ও মুখর শব্দের যথাক্রমে ল, এল এবং র তদ্ধিত প্রত্যয়।

২. কৃৎ প্রত্যয় : ধাতু বা ক্রিয়া প্রকৃতির সাথে যে প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়, তাকে বলে কৃৎ প্রত্যয়। উদাহরণে চলন্ত, জমা ও লিখিত শব্দের যথাক্রমে অন্ত, আ এবং ইত কৃৎ প্রত্যয়।

তন্ধিত প্রত্যয় সাধিত শব্দকে বলা হয় তদ্ধিতান্ত শব্দ এবং কৃৎ প্রত্যয় সাধিত শব্দকে বলা হয় কৃদন্ত শব্দ। যেমন- হাতল, ফুলেল ও মুখর তদ্খিতান্ত শব্দ এবং চলন্ত, জমা ও লিখিত কৃদন্ত শব্দ।

উপসর্গ : শব্দ বা ধাতুর পূর্বে কতিপয় সুনির্দিষ্ট অব্যয় জাতীয় শব্দাংশ যুক্ত হয়ে সাধিত শব্দের অর্থের পরিবর্তন, সম্প্রসারণ ও সংকোচন ঘটিয়ে থাকে। এগুলােকে বলা হয় উপসর্গ।

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত উপসর্গুলাের নিজস্ব কোনাে অর্থ না থাকলেও শব্দ বা ধাতুর পূর্বে ব্যবহ্ৃত হলেই অর্থবাচকতা সূচিত হয়। যেমন – “পরা’ একটি উপসর্গ, এর নিজস্ব কোনাে অর্থ নেই। কিন্তু “‘জয় শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়ে হলাে পরাজয়। এটি জয়ের বিপরীতার্থক। সেইরুূপ দর্শন অর্থ দেখা। এর আগে উপসর্গ যুক্ত হয়ে হলাে প্রদর্শন অর্থাৎ সম্যকরূপে দর্শন বা বিশেষভাবে দেখা।

বাংলা ভাষায় তিন প্রকারের উপসর্গ দেখা যায় :

  • সংকৃত
  • বাংলা
  • বিদেশি উপসর্গ।

১. সংস্কৃত উপসর্গ : প্র, পরা, অপ-এরূপ বিশটি সৎকৃত বা তৎসম উপসর্গ রয়েছে।

তৎসম উপসর্গ তৎসম শব্দ বা ধাতুর পূর্বে ব্যবস্থৃত হয়। যেমন, পূর্ণ একটি তৎসম শব্দ। পরি উপসর্গযােগে হয়পরিপূর্ণ। হ্ (হর)+ঘঞ = হার-এ কৃদন্ত শব্দের আগে উপসর্গ যােগ করলে কীরূপ অর্থের পরিবর্তন হলাে লক্ষ কর : আ+হার = আহার (খাওয়া),বি + হার = বিহার (ভ্রমণ), উপ+হার-উপহার (পারিতােষিক), পরি+হার-পরিহার (বর্জন) ইত্যাদি।

২। বাংলা উপসর্গ : অ, অনা, অঘা, অজ, আ, আব, নি ইত্যাদি অব্যয় জাতীয় শব্দাংশ বাংলা উপসর্গ। খাঁটি অ+কাজ-অকাজ, অনা+ছিফ্টি (সৃষ্টি শব্দজাত) = অনাছিষ্টি বাংলা শব্দের আগে এগুলাে যুক্ত হয়। যেমন ইত্যাদি।

৩। বিদেশি উপসর্গ : কিছু বিদেশি শব্দ বা শব্দাংশ বাংলা উপসর্গরূপে ব্যবহ্ৃত হয়ে অর্থের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। বিদেশি উপসর্গ বিদেশি শব্দের সঙ্গেই ব্যবহৃত হয়। যথা : বেহেড, লাপাত্তা, গরহাজির ইত্যাদি।

(পরে উপসর্গ অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে)।

অনুসর্গ : বাংলা ভাষায় দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক, চেয়ে, থেকে, উপরে, পরে, প্রতি, মাঝে, বই, ব্যতীত, অবধি, হেতু, জন্য, কারণ, মতাে, তবে ইত্যাদি শব্দ কখনাে অন্য শব্দের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে স্বাধীনভাবে পদরূপে বাক্যে ব্যবহৃত হয়; আবার কখনাে কখনাে শব্দবিভক্তির ন্যায় অন্য শব্দের সঙ্গে প্রযুক্ত হয়ে অর্থবৈচিত্র্য ঘটিয়ে থাকে। এগুলােকে অনুসর্গ বলা হয়। যেমন-কেবল আমার জন্য তােমার এ দুর্ভোগ। মনােযােগ দিয়ে শােন, শেষ পর্যন্ত সবার কাজে আসবে।

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top