আজকে আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো কোষের নিউক্লিয়াস কি । আজকে আমরা জানবো কোষে নিউক্লিয়াস এর ভূমিকা কি? এর গঠন, কাজ ইত্যাদি। সুতরাং কোষের নিউক্লিয়াস কি এবং এর যাবতীয় প্রশ্নের ভান্ডার এবং উত্তর নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছি আজ।
নিউক্লিয়াস কি?
ইউক্যারিওটিক কোষের প্রোটোপ্লাজমীয় বস্তুতে পর্দা দিয়ে ঘেরা, ক্রোমাটিন বস্তু দিয়ে পূর্ন যে গোলাকার অঙ্গানু থাকে তাকে নিউক্লিয়াস বলে।নিউক্লিয়াস কোষের এমন একটি অঙ্গাণু যা বংশগতি উপাদানকে ধারণ ও রক্ষন করে এবং বিভাজনের মাধ্যমে তা অপত্য কোষে পাঠায় ।
কোষের প্রোটোপ্লাজমের মধ্যে পর্দা দ্বারা আবৃত কেন্দ্রীয় গঠনটিকে নিউক্লিয়াস বলা হয়। সাধারনত নিউক্লিয়াসকে বলা হয়ে থাকে কোষের প্রাণকেন্দ্র। একটি কোষের নিউক্লিয়াস কে যদি বাদ দেওয়া হয় তবে সে কোষ বিভাজিত হতে পারে না। যেমন- মানুষের পরিণত লোহিত রক্ত কণিকায় এই নিউক্লিয়াসটি না থাকায় ওই কোষ বিভাজিত হতে পারে না। সাইটোপ্লাজমীয় বস্তু হতে পর্দা দিয়ে পৃথক হওয়ার কারণেই নিউক্লিয়াসের একটি নিজস্ব জগৎ থাকে।
যে সকল জীবের দেহেে কোষে পর্দা দিয়ে আবৃত নিউক্লিয়াস থাকে তাদের ইউক্যারিওট বলা হয়।
আবার যাদের পর্দা দিয়ে ঘেরা নিউক্লিয়াস থাকে না তাদের বলা হয় প্রোক্যারিওট।
কোষ বিভাজনের সময় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অবস্থায় নিউক্লিয়াসের পরিবর্তন ঘটে।
নিউক্লিয়াসের আবিস্কারক:
বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন (Robert Brown) সর্বপ্রথম ১৮৩১ সালে অর্কিড পাতার কোষে নিউক্লিয়াস লক্ষ্য করেন এবং তিনি এর নামকরণ করেন।
নিউক্লিয়াস এর বিস্তৃতি কি
সাধারনত সকল প্রকার কোষ যারা ইউক্যারিওটিক তাদের কোষে নিউক্লিয়াস পাওয়া যায়। সাধারণত এটির কোষের কেন্দ্রে অবস্থান করে। তবে নানান কাজের সুবিধার জন্য এরা অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে ৷
সাধারণত একটি কোষে শুধুমাত্র একটি নিউক্লিয়াস থাকে। তবে কোন কোন উদ্ভিদ এবং প্রাণী কোষে একাধিক নিউক্লিয়াসও থাকতে পারে। অপরদিকে বহু নিউক্লিয়াস যুক্ত কোষকে বলা হয় সিনসিটিয়াল কোষ।
একটি কোষে একটি নিউক্লিয়াস থাকলে তাকে বলা হয় মোনোক্যারিয়ন। একটি কোষে একটি প্রজাতির বিশুদ্ধ নিউক্লিয়াস থাকলে তাকে মূলত ইউক্যারিয়ন বলে। একটি কোষে একটি প্রজাতির দুটিমাত্র নিউক্লিয়াস থাকলে তাকে ডাইক্যারিয়ন বলে।
একটি কোষে একটি প্রজাতির অনেকগুলি বা অসংখ্য নিউক্লিয়াস থাকলে তাকে পলিক্যারিয়ন বলে।
দুটি প্রজাতির দুটি নিউক্লিয়াস যদি একটি কোষের মধ্যে উপস্থিত থাকে তবে তাকে হেটেরোক্যারিয়ন বলে। যদি দুটি প্রজাতির নিউক্লিয়াস একসজ্ঞে যুক্ত হয়ে একটি নিউক্লিয়াস তৈরি করে তবে তাকে সিনক্যারিয়ন বলে।
নিউক্লিয়াস এর আকার ও আয়তন কি
কোষের নিউক্লিয়াস সাধারনত গোলাকার, ডিম্বাকার, থালার ন্যায় অথবা অনিয়মিত আকৃতির হতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন কোষের নিউক্লিয়াসের আকৃতি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। প্রত্যেক কোষের নিউক্লিয়াসের আকৃতি তার সাইটোপ্লাজমের আনুপাতিক হয়ে থাকে।
এরা ব্যাস সাধারণত ৫-৭ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে, তবে তা এর চাইতে ছোট বা বড়োও হতে পারে।ছোট আকারের নিউক্লিয়াসকে মাইক্রো নিউক্লিয়াস এবং বড় আকারের নিউক্লিয়াসকে ম্যাক্রো নিউক্লিয়াস বলে।
নিউক্লিয়াস এর গঠন কি
একটি সুগঠিত নিউক্লিয়াসকে মোট চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. নিউক্লিয়ার ঝিল্লি/ পর্দা/ এনভেলপ
২. নিউক্লিওপ্লাজম
৩. নিউক্লিওলাস
৪. নিউক্লিয়ার রেটিকুলাম/ ক্রোমাটিন জালিকা/নিউক্লিয় জালিকা
১. নিউক্লিয়ার ঝিল্লী কি?
নিউক্লিয়াসকে ঘিরে রাখে যে ঝিল্লি তাকে নিউক্লিয়ার ঝিল্লি বা নিউক্লিও পর্দা বলে। এটি দুুুই স্তর বিশিষ্ট একটি ঝিল্লি৷ এ ঝিল্লি লিপিড ও প্রোটিন এর সমন্বয়ে গঠিত ৷ এ ঝিল্লীতে মাঝে মাঝে কিছু ছিদ্র থাকে যাকে বলা হয় নিউক্লিয়ার রন্ধ্র ৷ এই ছিদ্রের মাধ্যমে কেন্দ্রিকা ও সাইটোপ্লাজম এর মধ্যে কিছু বস্তু চলাচল করতে পারে। এই ঝিল্লী সাইটোপ্লাজম থেকে কেন্দ্রিকার অন্যান্য বস্তুকে আলাদা করে রাখে এবং বিভিন্ন বস্তুর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে।
নিউক্লিয়ার ঝিল্লির কাজ:
১. নিউক্লিয়াসকে রক্ষণাবক্ষেণ করা এবং
২. অভ্যন্তরীণ অঙ্গাণুগুলোকে সাইটোপ্লাজম থেকে পৃথক করে রাখে এবং সেগুলোকে সংরক্ষন করে।
২. নিউক্লিওপ্লাজম কি?
নিউক্লিয়ার ঝিল্লি/পর্দা দ্বারা আবৃত স্বচ্ছ, ঘন ও দানাদার তরল পদার্থকে নিউক্লিওপ্লাজম বলে। নিউক্লিওপ্লাজমকে ক্যারিওলিম্ফ ও বলা হয় , এতে থাকে নিউক্লিক এসিড, প্রোটিন ও কতিপয় খনিজ লবন। নিউক্লিওলাস ও ক্রোমাটিন জালিকা এতে অবস্থান করে।
নিউক্লিওপ্লাজমের কাজঃ
১. নিউক্লিয়াস এর বিভিন্ন জৈবনিক ক্রিয়া বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
২. নিউক্লিওলাস ও ক্রোমাটিন জালিকা ধারণ করে রাখে।
৩. নিউক্লিয়াস এর বিভাজনের সময় ব্যবহারযোগ্য খাদ্য সঞ্চিত করে রাখে।
৩. নিউক্লিওলাস কি?
নিউক্লিয়াসের যে ঘন গোলাকার বস্তু এসিডিক রঞ্জকে রঞ্জিত থাকে তাকে নিউক্লিওলাস বলে। স্বাভাবিক ভাবে নিউক্লিয়াসে এক বা একাধিক নিউক্লিওলাস থাকতে পারে।
নিউক্লিওলাসের গঠন মূলত চারটি অংশে বিভক্ত
যথা-
১. দানাদার অংশ,
২. সূত্রাকার অংশ,
৩. অনিয়তাকার অংশ এবং
৪. ক্রোমাটিন।
নিউক্লিওলাসের বাইরের যে অংশ সেদিকে থাকে দানাদার অংশ ।
প্রত্যেকটি দানার ব্যাস প্রায় ১৫০-২০০Å ।
দানাদার অংশে রাইবো নিউক্লিওপ্রোটিন যুক্ত থাকে বলে এদেরকে রাইবোজোম দানাও বলা হয়ে থাকে। নিউক্লিওলাস এর বাইরে কোন আবরণী দেখা যায় না।
নিউক্লিওলাসের যেই সূত্রাকার অংশ থাকে তাকে নিউক্লিওলোনিমা বলে। এখানে ৫০-৮০ Å লম্বা সুতোর মতো বহু বস্তু দেখতে পাওয়া যায়। এই সূত্রগুলি মূলত রাইবোনিউক্লিও প্রোটিন দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে।
নিওক্লিওলাসের অনিয়তাকার অংশে ইলেকট্রনের ঘনত্ব কম থাকে এবং এই অংশে যেসব প্রোটিন থাকে তারা পেপসিন এনজাইম দিয়ে সহজে আর্দ্র বিশ্লিষ্ঠ হতে পারে।
তাছাড়াও নিউক্লিওলাস এর পরিধির দিকে একটি বহিঃনিউক্লিওলাস ক্রোমাটিন অবস্থান করে। এরা প্রধানত DNA দ্বারা তৈরি এবং এই DNA এবং RNA প্রস্তুতের ছাঁচ হিসেবে কাজ করে থাকে। বহিঃ ক্রোমাটিন আবার মাঝে মাঝে নলাকার নিউক্লিয়াসের ভিতরের দিক প্রবেশ করে অন্তঃ নিউক্লিওলার ক্রোমাটিন তন্তু গঠন করে।
৪. ক্রোমাটিন জালিকা কি?
নিউক্লিওপ্লাজম এ অবস্থিত এবং ক্ষারকীয় রঞ্জকে রঞ্জিত নিউক্লিওপ্রোটিন সূত্র জালিকাকে বলা হয় ক্রোমাটিন জালিকা
শুধুমাত্র কোষ বিভাজনের সময় এদের দেখতে পাওয়া যায়। কোষ বিভাজনের সময় এই ক্রোমাটিন জালিকার প্যঁাচ খুলে কতগুলি নির্দিষ্ট সংখ্যার সরু সুতোর মতো অংশে পরিণত হয়। এদের ক্রোমোজোম বলা হয়। ক্রোমোজোম তৈরী হয় ক্রোমাটিড নামের জৈব বস্তুর দিয়ে। ক্রোমাটিন বস্তু দুধরনের হয় —
১. হেটারোক্রোমাটিন
২. ইউক্রোমাটিন
১. হেটারোক্রোমাটিন:
যে ক্রোমাটিন স্থির এবং বিভাজন দশাতেই কুণ্ডলিত অবস্থায় থাকে এবং খুব গাড় রঙ ধারন করে থাকে তাকে হেটারোক্রোমাটিন বলে।
স্থির নিউক্লিয়াসে এরা ঘন পেঁচানো থাকে এবং কোষ বিভাজন হওয়া অবস্থাতেও এদের গঠনের কোনো পরিবর্তন হয় না।
এরা অতি ঘন সন্নিবিষ্ট ডিএনএ তন্তু দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে।
২. ইউক্রোমাটিন:
যে ক্রোমাটিন অংশ স্থির নিউক্লিয়াসে প্রসারিত অবস্থায় থাকে এবং খুব হালকা কালার ধারণ করে
কিন্তু বিভাজিত অবস্থায় কুণ্ডলিত থাকে এবং গাঢ় রং ধারণ করে তাকে ইউক্রোমাটিন বলে।
এই অংশও বিভাজন দশায় ঘন পেঁচানো অবস্থায় থাকে এবং স্থির নিউক্লিয়াস এর সরু ও প্রসারিত অবস্থায় থাকে।
নিউক্লিয়াস এর কাজ কি
১. কোষের সকল বিপাকীয় কাজ নিউক্লিয়াসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই একে কোষের মস্তিষ্ক বলা হয়ে থাকে।
২. যখন কোষের বিভাজন সম্পন্ন হয় তখন নিউক্লিওলাসও তাতে অংশ নেয়।
৩. এটি ক্রোমোজোমকে ধারণ ও বহন করে। আর এই ক্রোমোজোমই আমাদের ডিএনএ এর ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে।
৪. মূলত আমাদের দেহের প্রোটিন সংশ্লেষণ এর কাজ করে রাইবোজোম কিন্তু এই প্রোটিন সংশ্লেষন কে সংরক্ষণ করে রাখে এই নিউক্লিয়াস।
৫. এটি আরএনএ সংশ্লেষণ এর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে।
৬. একটি নিউক্লিয়াসে প্রধানত ক্রোমাটিন জালিকা, নিউক্লিওলাস, নিউক্লিওপ্লাজম, নিউক্লিয়ার মেমব্রেন ইত্যাদি অংশগুলো থাকে।
৭. এই নিউক্লিয়াসটি সাইটোপ্লাজম এর সঙ্গে বিভিন্ন বস্তুর আদান-প্রদান ও সংযোগ স্থাপন করে।
৮. তাছাড়াও এটি নিউক্লিক অ্যাসিড সঞ্চয়কারী হিসেবে কাজ করে থাকে।
আশা করি আজকে আপনাদের নিউক্লিয়াস কি? নিউক্লিয়াস এর গঠন ও কাজ সম্পর্কে ভালো একটি ধারণা দিতে পেরেছি।