দুরুদ শরীফ এর অর্থ সহ এর বাংলা অনুবাদ ও ফযিলত।
দুরুদ শরীফ
এই দুরুদ শরীফ একটি সম্ভাষণ যা মুসলিম সম্প্রদায় নির্দিষ্ট বাক্যাংশ পড়ে ইসলামের সর্বশেষ নবী মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর শান্তি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে পাঠ করে থাকে।
দুরুদ শব্দটিকে আরবিতে সালাওয়াত বলা হয় (আরবি: صَلَوَات) একবচনে এটি হবে সালাত।
সালাওয়াত মানেই হলো সালাত। যেখানে সালাত হলো একবচন এবং সালাওয়াত এর একটি বহুবচন এবং “সোয়াদ-লাম-ওয়াও” (ص ل و) এই আরবি বর্ণসমূহের ত্রিবাক্ষিক মূল (স্-ল্-ওয়্ ) থেকে আগত। যার অর্থ মূলত “প্রার্থনা” বা “অভিবাদন”।
প্রত্যেক নামাজে তাশাহ্হুদের পর আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর উপর শান্তি প্রার্থনা করে দুরূদ শরীফ পাঠ করতে হয়।কেননা দুরূদ শরীফ পাঠ করা ব্যাতীত নামাজ সম্পন্ন হয় না। তাই আমাদের সকল মুসলমানের উচিত বুঝে শুনে শুদ্ধ ও সহিহ ভাবে দুরূদ শরীফ পাঠ করা।
দূরূদ শরীফ আরবি-
اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدٍ. وَّعَلٰى اٰلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلٰى اِبْرَاهِيْمَ وَعَلٰى اٰلِ اِبْرَاهِيْمَ’ اِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ. اَللّٰهُمَّ بَارِكْ عَلٰى مُحَمَّدٍ. وَّعَلٰى اٰلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلٰى اِبْرَاهِيْمَ وَعَلٰى اٰلِ اِبْرَاهِيْمَ. اِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ.
দুরুদ শরীফের বাংলা অনুবাদ-
“আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন, কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহীমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মদিউ, ওয়া আলা আলি মুহাম্মদিম, কামা বারাকতা আলা ইবরাহীমা, ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা, ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।
দুরুদ শরীফের বাংলা অর্থ-
হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর বংশধরের প্রতি রহমত নাযিল করো যেমন রহমত নাযিল করেছিলে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তাঁর বংশধরের প্রতি। নিশ্চয় তুমি প্রশংসনীয় ও মর্যাদাবান। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর বংশধরের প্রতি বরকত নাযিল করো যেমন বরকত নাযিল করেছিলে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তাঁর বংশধরের প্রতি। নিশ্চয় তুমি প্রশংসনীয় ও মর্যাদাবান। (সহীহ বুখারী, হাদীস:২৯৭০)
ছোট দুরুদ শরীফ-
নিম্মে কিছু ছোট দরুদ শরীফ এবং এর বাংলা অনুবাদ ও অর্থ উল্লেখ করা হলো। যা মূলত নামাজে ব্যবহার করা হয় না। তবে অন্য যেকোনো সময় তা পাঠ করা যেতে পারে।
ছোট দুরুদ সম্পর্কে যায়েদ ইবনু খারিজাহ (রা) বলেন, “আমি নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে (দুয়া ও দুরুদের ব্যাপারে) প্রশ্ন করলাম। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমরা আমার উপর সালাত (দরূদ) পড় এবং অনেক বেশী দুয়া করার জন্য চেষ্টা কর। (আমার জন্য দুরুদ পড়ার জন্য তোমরা) এইভাবে বলোঃ
১। ছোট দরুদ শরীফ আরবি
الَّلهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা সল্লি আ’লা মুহাম্মাদিওঁ-ওয়া আ’লা আলি মু’হাম্মাদ।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনি মুহা’ম্মদ এবং তাঁর পরিবার-পরিজনদের উপর রহমত বর্ষণ কর।
(সুনানে নাসায়ীঃ হাদীস নং-১২২৫)
২। ছোট দুরুদ আরবি-
اللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ عَلَى نَبَيِّنَا مُحَمَّدٍ
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা সল্লি ওয়া সাল্লিম আ’লা নাবিয়্যিনা মুহা’ম্মাদ।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনি আমাদের নবী মুহাম্মাদের উপর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন।
৩। সবচাইতে ছোট যেই দুরুদ
صلى الله عليه وسلم
উচ্চারণঃ সল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম।
অর্থঃ আল্লাহ তাঁর (মুহা’ম্মদের) প্রতি সালাত (দয়া) ও সালাম (শান্তি) বর্ষণ করুন।
পাঠের সময়-
১। আজানের পর দোয়ার আগে দুরুদ পাঠ করা হয়। ২। অজুর শেষ করে দুরুদ পাঠ করতে হয়।
৩। চিঠিপত্র বা অন্য কিছু লিখার আগে।
৪। কুরআন তিলাওয়াত বা অন্য কোনো বইপুস্তক পাঠের আগে।
৫। দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ ও সব রকমের বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সব সময় বেশি করে দরুদ পাঠ উত্তম ।
পাঠের নিয়ম-
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি দুরুদ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। কুরআনে এসেছে ‘অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি দুরুদ প্রেরণ করেন। হে মুমিনরা! তোমরাও তাঁর প্রতি যথাযথ দুরুদ ও সালাম পেশ করো’ (সূরা : আহজাব, আয়াত : ৫৬)।
জীবনে একবার দুরুদে-সালাম পাঠ করা ফরজে আইন।
১। দুরুদ-সালাম অত্যন্ত আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সঙ্গে খুব ধীরস্থিরভাবে চুপি চুপি পড়া শ্রেয়।
২। দুরুদ পড়ার সময় অধিক নড়াচড়া, মাথা দুলানো, চিৎকার করা বা উচ্চ স্বরে আওয়াজ করা যাবে না।
৩। একই বৈঠকে একের অধিক বার নবী (সা.)-এর নাম উচ্চারিত হলে প্রথমবার সবার জন্য দুরুদ পাঠ করা আবশ্যক (ওয়াজিব)।
৪। অজু ছাড়া যে কোনো অবস্থায় দুরুদ পড়া যায়। তবে অজু অবস্থায় এবং আদবের সহিত দুরুদ পড়া উত্তম।
৫। জুমা বা ঈদের খুতবায় নবী (সা.)-এর নাম এলে মনে মনে দুরুদ পড়তে হবে, মুখে উচ্চারণ করা যাবে না।
৬। নবীজির রওজা শরিফ জিয়ারত ও তার নাম বলা বা শোনার সময় দুরুদ পড়তে হবে।
৭। মসজিদে প্রবেশের সময় ও বের হওয়ার সময়।
৮। কোনো বৈঠক থেকে ওঠার সময়।
৯। দোয়া বা মোনাজাতের আগে ও পরে।
দুরুদ পাঠের নিষিদ্ধ সময়-
কয়েকটি অবস্থায় রাসূল (সাঃ) এর নাম শুনেও দুরূদ পড়া যাবে না। যথা-
১। সহবাসের সময়।
২। প্রশ্রাব বা পায়খানার সময়।
৩। হাঁচির সময়।
৪। প্রাণী জবাই করার সময়।
৫। কুরআন তিলাওয়াতের মাঝে রাসূল (সাঃ) এর নাম আসলেও দুরূদ পড়া লাগবে না।
প্রথমোক্ত ৩ অবস্থাতেই দুরূদ পড়া নিষিদ্ধ কারণ এতে করে দুরূদের অপমান হয়।
আর ৪র্থ অবস্থায় দুরূদ পড়লে শিরকের সম্ভাবনা থাকায় দরূদ পড়া নিষিদ্ধ।
আর ৫ম অবস্থায় পড়া লাগবে না কারণ এতে করে কুরআন তিলাওয়াত কে অপমান করা হয়। এমন সব অপমানজক অবস্থায় দরূদ পড়া নিষিদ্ধ।
দুরুদ শরীফ পাঠের ফজিলত-
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু মানব জাতিই নয়, সমগ্র বিশ্ব জাহানের জন্য রহমত স্বরূপ।
আল্লাহ তা’আলা সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতে বলেন-আমিআমি আপনাকেই শুধুমাত্র সমগ্র বিশ্ব জাহানের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।
হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কিয়ামতের দিন আমার সঙ্গী হওয়ার সবচেয়ে অধিক উপযুক্ত ওই ব্যক্তি যে আমার প্রতি সবচেয়ে বেশি দরুদ পাঠ করে। (তিরমিজী শরিফ)
ওই সাহাবি হতে বর্ণিত, হজরত রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আল্লাহ পাকের মনোনীত কিছুসংখ্যক ফেরেশতা রয়েছে যারা জমিনের বুকে সফর করছেন। তাদের কাজ হলো উম্মতের দুরুদ আমার নিকট পৌঁছে দেওয়া। (নাসায়ী শরিফ)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহপাক তার প্রতি দশটি রহমত নাজিল করেন, তার দশটি গুনাহ মিটিয়ে দেওয়া হয় এবং তার জন্য দশটি মর্তবা বুলন্দ করা হয়। (নাসায়ী শরিফ)।
হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) বলেন, নিশ্চয় বান্দার দোয়া-মোনাজাত আসমান ও জমিনের মাঝখানে ঝুলানো থাকে, তার কোনো কিছু আল্লাহপাকের নিকট পৌঁছে না যতক্ষণ না বান্দা তোমার নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করবে। (তিরমিজী শরিফ)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দুরুদ শরিফের আমল কাল কিয়ামতের পুলসিরাতের অন্ধকারে আলোর কাজ করবে।
জুমার দিনে দুরুদ পাঠের ফজিলত-
যে ব্যক্তি জুমার দিন আমার প্রতি ৮০ বার দরুদ পাঠ করবে আল্লাহপাক তার ৮০ বছরের ছগিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।
হযরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষের যে দল কোনো মজলিসের কাজ শেষ করে আল্লাহপাকের জিকর ও দুরূদ পাঠ না করে সেখান থেকে উঠে পড়বে তাদের ওই মজলিস তাদের জন্য দুঃখ-কষ্টের কারণ হবে।
হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কৃপণ ওই ব্যক্তি যার নিকট আমার নাম উচ্চারিত হলো, কিন্তু সে আমার নাম শুনে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল না। (তিরমিজি শরিফ)
আব্দুল্লাহ্ বিন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত- তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেছেন: যখন তোমরা মুয়াজ্জিনের আযান শুনবে, তখন তোমরাও তার সাথে অনুরূপ বলবে। তারপর আমার উপর দরূদ পাঠ করবে। কেননা, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে, তার উপর আল্লাহ্ দশটি রহমত বর্ষণ করেন। [মুসলিম: ৮৪৯]
আশা করছি আজকের এই দুরুদ শরীফ এর বাংলা অর্থ ও ফজিলত ও যাবতীয় বিষয় নিয়ে লিখা আর্টিকেলটি আপনাদের কাজে লাগবে। যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে তা পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ