মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, ভারতে ধর্মীয় স্থানগুলোতে আক্রমণ বেড়েই চলেছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় বৈচিত্রের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ভারত। অথচ, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থানগুলো এখন নিরাপদ নয়। ধর্মীয় বিবেচনায় মানুষের ওপর আক্রমণ বেড়ে চলেছে।

বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মার্কিন কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন এ কথা বলেন।

মার্কিন সরকারের প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটিতে গুজরাটের কসাই হিসেবে পরিচিত কট্টর হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের শাসনামলে মুসলমানদের ওপর জুলুমের চিত্র তুলে ধরা হয়। একই সাথে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ওপরও বিজেপির নির্যাতনের পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, মুসলমান ধর্মীয় বিবেচনায় কোভিড আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এক সময় পরিচিত ছিল। দেশটির আনুমানিক জনসংখ্যা ১.৩ বিলিয়নেরও বেশি। যার মধ্যে ৭৯.৮ শতাংশ হিন্দু, ১৪.২ শতাংশ মুসলিম, ২.৩ শতাংশ খ্রিস্টান এবং ১.৭ শতাংশ শিখ।

এছাড়া, ছোট ছোট ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ, জৈন, বাহাই, ইহুদি, জরথুস্ট্রিয়ান (পার্সি) এবং অধার্মিক ব্যক্তিরা।

ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রটিকে ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সমস্ত ব্যক্তিকে ধর্ম পালন ও প্রচার করার অধিকার নিশ্চিত করা আছে। কিন্তু বরাবরই ভারতে সংখ্যালঘু হিসাবে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চলছে। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই এই নিপীড়ন অব্যাহত আছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত সরকারের নেতৃত্বে রয়েছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায়।

দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের বিরুদ্ধে মুসলমানসহ সংখ্যালঘু অন্যান্য ধর্মের জনগণের ওপর জুলুমের চিত্র তুলে প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতকে একটি সম্পূর্ণ হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দলীয় সাম্প্রদায়িক নীতিগুলি বাস্তবায়ন করে চলেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। জাতীয়, রাজ্য ও স্থানীয় স্তরের নেতারা এবং ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়ে উঠা হিন্দু-জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলি এসবের সমর্থন করছে।

মোদী ক্ষমতারোহণের পর থেকেই হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে বিজেপি সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর এমন কোনো জুলুম নেই, যা করছে না। এর প্রথম শিকার হয়েছেন ভারতের মুসলমানেরা।

মার্কিন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা গুরুতর বিপদের মধ্যে রয়েছেন।

বিজেপির আমলে করা ধর্মীয়ভাবে বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন (সিএএ)  এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) এর সমালোচনাও করা হয়েছে প্রকাশিত প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈষম্যমূলক এসব আইনের ফলে মূলত মুসলমান জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রহীনতার শিকার হবে। দেশ থেকে বের করে দেয়া বা দীর্ঘস্থায়ী আটকের সম্মুখীন হতে পারেন।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ধর্মীয়ভাবে বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন (সিএএ) পাশ করা হয়। যা কার্যকর করা হয় ২০২০ সালে।

বৈষম্যমূলক এই আইনের ফলে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আসা শুধুমাত্র অমুসলিমদেরই নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়।

অপরদিকে আসামে বৈষম্যমূলক এনআরসি’র মাধ্যমে বিজেপি সেখানকার মুসলমান জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

মূলত মুসলমানদেরকে নিজ ভূমি থেকে বের করে দিতে তথাকথিত নাগরিকপঞ্জির আড়ালে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চেষ্টা করছে কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ধর্মীয়ভাবে বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন (সিএএ) পাশ করা হয়। যা কার্যকর করা হয় ২০২০ সালে।

বৈষম্যমূলক এই আইনের ফলে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আসা শুধুমাত্র অমুসলিমদেরই নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়।

অপরদিকে আসামে বৈষম্যমূলক এনআরসি’র মাধ্যমে বিজেপি সেখানকার মুসলমান জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

মূলত মুসলমানদেরকে নিজ ভূমি থেকে বের করে দিতে তথাকথিত নাগরিকপঞ্জির আড়ালে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চেষ্টা করছে কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে আসামের এনআরসি তালিকা থেকে প্রায় ১৯ লাখ (১.৯ মিলিয়ন) লোককে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া, আসামের প্রায় সাত লাখ মুসলিম অধিবাসী নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাদ পড়াদের কীভাবে পুনর্বহাল করা যেতে পারে তা স্পষ্ট নয়।

মার্কিন কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই প্রক্রিয়াটি আসামের (মুসলিম) পরিবারগুলিকে ভয় ও অশান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর ফলে তারা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

আসামের মুসলমানদের নিয়ে ২০২১ সালেও একই ধরনের উদ্বেগের কথা তুলে ধরা হয়েছিল মার্কিন কমিশনের আরেকটি প্রতিবেদনে।

মে মাসে আসাম সরকার কিছু জেলায় এনআরসি তালিকা ফের যাচাই করার জন্য বলেছিল। বিজেপির এমন উদ্যোগে আরও বেশি মুসলমানকে বাদ দেওয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামের এনআরসি প্রক্রিয়া সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার কারণে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী সহিংসভাবে হাজার হাজার প্রধানত মুসলিম গ্রামবাসীকে উচ্ছেদ করেছে। যার ফলে কমপক্ষে দুইজনের নৃশংস মৃত্যু হয়েছে।

মসজিদেও গো-রক্ষার ছদ্মবেশে হামলা যেভাবে:

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিম ও খ্রিস্টান এবং তাদের আশেপাশের এলাকা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ও ইবাদতখানা গুলোতে অসংখ্য হামলা চালানো হয়। এই ঘটনাগুলির মধ্যে অনেকগুলি ছিলো হিংস্র, বিনা প্ররোচনায় এবং সরকারি কর্মকর্তাদের প্ররোচনায়।

এসব হামলার নেপথ্য কারিগরেরা সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এবং অন্যান্য ধরণের যোগাযোগকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (বিশেষ করে মুসলমান) বিরুদ্ধে ভয় দেখানো এবং ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছেন। অনলাইনে ভুল তথ্যের দ্রুত বিস্তার সহিংস আক্রমণে অবদান রেখেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের অক্টোবরে  উন্মত্ত জনতা (হিন্দুত্ববাদী) বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ত্রিপুরায় মসজিদে হামলা চালায় এবং মুসলিম বাসিন্দাদের সম্পত্তি পুড়িয়ে দেয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতের সংবিধান ও ২০টি রাজ্যে (এবং ক্রমবর্ধমান) বিভিন্ন ভাবে গো-হত্যাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন করার পর গরু রক্ষার ছদ্মবেশে সারা দেশে (মুসলমানদের ওপর) সহিংস হামলা চালানো হয়েছে।

মার্কিন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে, গরুর মাংস খাওয়া, গরু জবাই করা বা জবাই করার জন্য গবাদি পশু পরিবহনের সন্দেহে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং দলিতসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালানো হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালের জুন মাসে, ত্রিপুরায় গরু চোরাচালানের সন্দেহে তিনজন মুসলিম পুরুষকে হত্যা করা হয়েছিল। গবাদি পশু পাচারের অভিযোগে দু’জনকে মারধর করা হয়েছিল। মারধরের ফলে একজনের মৃত্যু হয় এবং অন্যজনকে মধ্যপ্রদেশে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

অন্যান্য ঘটনা:

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে ভারতের অভ্যন্তরে কোভিড রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক বৃদ্ধির সময় অক্সফাম ইন্ডিয়া দ্বারা পরিচালিত একটি জরিপে বলা হয়েছিল যে ৩৩ শতাংশ মুসলিম হাসপাতালে ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।

সূত্রঃ আমার দেশ uk

Rate this post

By Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.