বাস্তুসংস্থান কাকে বলে? | বাস্তুসংস্থানের প্রকারভেদ | স্থলজ বাস্তুসংস্থান | জলজ বাস্তুসংস্থান
বাস্তুসংস্থান(Ecosystem) কাকে বলে?
কোনো জীব এককভাবে তার পরিবেশ ছাড়া বাঁচতে পারে না। প্রতিটি জীবিত উদ্ভিদ, প্রাণি ও তাদের জড় পরিবেশ একে অন্যের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং এরা পরস্পরের উপর ক্রিয়া করে। জীব মাত্রই পরিবেশ থেকে যেসব উপাদান গ্রহণ করে তা আবার সম্পূর্ণভাবে পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়। পরিবেশে জড় ও জীব উপাদানের কোনো অভাব ঘটলে তার উপর নির্ভরশীল উদ্ভিদ ও প্রাণির বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের জড় পরিবেশ ও জীব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত এরূপ আন্তঃসম্পর্ককে বলা হয় বাস্তুসংস্থান। অতীতে মানুষ নিজেকে বাস্তুসংস্থানের বহির্ভূত মনে করলেও এখন আর সেরূপ মনে করা যায় না। কোনো মানুষের বিভিন্ন কার্যকারিতা বাস্তুসংস্থানের বিভিন্ন উপাদানের উপর প্রভাব বিস্তার করে। বাস্তুসংস্থানকে আবার বাস্তুতন্ত্র বা প্রকৃতি বলেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তবে বাস্তুসংস্থানকে সচরাচর প্রকৃতি বলা হয়।
বাস্তুসংস্থানের প্রকারভেদ
পরিবেশ অনুসারে বাস্তুসংস্থান প্রধানত দু’ধরনের। যথা –
স্থলজ বাস্তুসংস্থান ও জলজ বাস্তুসংস্থান। এছাড়া মানুষ কৃত্রিমভাবে বিভিন্ন ধরনের বাস্তুসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারে।
নিচে উদাহরণসহ স্থলজ, জলজ ও কৃত্রিম বাস্তুসংস্থান নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
স্থলজ বাস্তুসংস্থান (Terrestrial ecosystem)
স্থলজ বাস্তুসংস্থান আবার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন – তৃণভূমির বাস্তুসংস্থান, বনভূমির বাস্তুসংস্থান, মরুভূমির বাস্তুসংস্থান ইত্যাদি। এখানে বনভূমির বাস্তুসংস্থান নিয়ে আলোচনা করা হলো।
বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বনভূমির মধ্যে সিলেটের পাহাড়ী বনাঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী ম্যানগ্রোভ তথা সুন্দরবন অঞ্চল।
সুন্দরবন অঞ্চল স্থলজ বনাঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত হলেও এখানকার প্রকৃতি অন্যান্য স্থলজ বনাঞ্চল থেকে আলাদা। খুলনা ও পটুয়াখালী জেলার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত সমুদ্র উপকূলবর্তী এ বনাঞ্চল বঙ্গোপসাগর থেকে ভেতরের দিকে ১১২ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এ বনের আয়তন প্রায় ৬,০৬০ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনের মাটি এঁটেল ও কর্দমাক্ত। জোয়ার ভাঁটার প্রভাবের জন্য এ অঞ্চলের মাটির লবণাক্ততা অনেক বেশি। মাটির লবণাক্ততা অধিক হওয়ায় এ অঞ্চলে বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উদ্ভিদ জন্মায়। এ কারণে সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বলা হয়।
সুন্দরবনে সকাল ও বিকাল দুবার জোয়ারের লবণক্ত পানি বনের মাটিকে সিক্ত করে, এর ফলে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায় এবং এর পাশাপাশি পানির স্রোতে যেমন উদ্ভিদের গোড়া থেকে মাটি সরে যায় তেমনিভাবে পলিমাটি গাছের গোড়ায় জমা হয়। বনে পলিমাটি জমা হওয়ায় উদ্ভিদের শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হয়। এজন্য এসকল উদ্ভিদে পরিবর্তিত বিশেষ মূল সৃষ্টি হয়, একে শ্বাসমূল বা নিউটোফোর (Pneumatophore) বলে। এ ছাড়া উদ্ভিদে টেসমূল সৃষ্টি হয়। সুন্দরবনে জন্মানো প্রধান উদ্ভিদগুলির মধ্যে সুন্দরী, গরাণ, গেওয়া, কেওড়া, গোলপাতা, পশুর, কাঁকড়া, হিন্দোল উল্লেখযোগ্য। এখানে বসবাসকারী প্রধান প্রাণিগুলি হলো হরিণ, শুকর, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কচ্ছপ, কুমির, বানর, হনুমান প্রভৃতি এবং বক, সারস, মোরগ, মাছরাঙা ইত্যাদি পাখি। মাটির লবণাক্ততা বেশি এবং পানি স্রোতযুক্ত হওয়ায় মাটিতে পতিত উদ্ভিদ বীজ নষ্ট হয়ে যায়। একারণে এ বনাঞ্চলে উদ্ভিদের ফল গাছে থাকা অবস্থায় বীজ অঙ্কুরিত হয় এবং চারাযুক্ত বীঝ কর্দমাক্ত মাটিতে পড়ে আটকে যায় এবং সেখানেই নতুন গাছ সৃষ্টি করে। এভাবে ফল গাছে থাকা অবস্থায় অঙ্কুরোদগম কেবলমাত্র সুন্দরবন অঞ্চলে দেখা যায়। এ ধরনের ব্যতিক্রমী অঙ্কুরোদগমকে জরায়ুজ অঙ্কুরোদগম (Viviparous germination) বলে।
বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদই এ বনের প্রধান উৎপাদক। এখানে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া, গোলপাতা ও অন্যান্য বিভিন্ন উদ্ভিদ উৎপাদক হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়, মোরগ, মুরগি, হরিণ, বিভিন্ন ধরনের পাখি প্রথম শ্রেণির খাদক হিসেবে কাজ করে। দ্বিতীয় শ্রেণির খাদক হিসেবে কাজ করে সাপ, পাখি, গিরগিটি, শিয়াল, বনবিড়াল ইত্যাদি প্রাণিরা। অন্যদিকে বাঘ, কুমির হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণী তথা টারসিয়ারী খাদক। আবার শুয়োর, বানর, সারস, সর্বভুক প্রাণি। এ বনাঞ্চলে বিয়োজক হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন ধরনের অনুজীব। এগুলোর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অ্যাকটিনোমাইসিটিস, প্রোটোজোয়া উল্লেখযোগ্য।
সুন্দর বনের বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ |
জলজ বাস্তুসংস্থান (Aquatic ecosystem)
জলজ বাস্তুসংস্থান বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যথা – পুকুরের বাস্তুসংস্থান, নদ-নদী বাস্তুসংস্থান ও সমুদ্রের বাস্তুসংস্থান। জলজ বাস্তুসংস্থানের জ্ঞান লাভ সবচেয়ে উপযোগী স্থান হলো পুকুরের বাস্তুসংস্থান। কেননা জলজ বাস্তুসংস্থানের প্রায় সকল উপাদানই পুকুরের পানি ও তলদেশে থাকে। কেবলমাত্র বায়বীয় আকারে পানির উপরিভাগ থেকে কিছু পদার্থ বাইরে চলে যায়, তবে বাইরে থেকে বায়বীয় ও বৃষ্টিপাতের ফলে কিছু পানিতে যুক্ত হয়। এর ফলে পুকুরে বসবাসরত জীব ও জড় পদার্থের মধ্যে বিদ্যমান নিবিড় সম্পর্ক সুষ্ঠুভাবে অনুধাবন করা যায়। এজন্য বাস্তুসংস্থানে পরিবর্তন হলে বা কিছু ঘটলে তা সহজে জানা যায়, যা স্থলজ বাস্তুসংস্থানে প্রায় অসম্ভব।
একটি পুকুরের বাস্তুসংস্থান
পুকুরের বাস্তুসংস্থান হচ্ছে জলজ বাস্তুসংস্থানের আদর্শ উদাহরণ। এখানে পুকুরে বসবাসরত জীব ও জড় পদার্থের নিবিড় সম্পর্ক ভালোভাবে বুঝা যায়। এখানে জড় বা নির্জীব উপাদানগুলি হলো বিভিন্ন প্রকার জৈব ও অজৈব পদার্থ, পানি, সূর্যালোক, কার্বন ডাই-অক্সাইড, অক্সিজেন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি। সজীব উপাদানগুলির মধ্যে আছে উৎপাদক, প্রথম স্তরের খাদক, দ্বিতীয় স্তরের খাদক, তৃতীয় স্তরের খাদক ও বিভিন্ন ধরনের বিয়োজক জীব।
একটি পুকুরের বাস্তুসংস্থান |
উৎপাদকঃ উৎপাদক হচ্ছে পুকুরে বসবাসকারী সালোকসংশ্লেষণকারী বিভিন্ন প্রকার ভাসমান ও সঞ্চারমান ক্ষুদ্র জীব। পানিতে ভাসমান জীবদেরকে প্লাঙ্কটন (plankton) বলে। প্লাঙ্কটন জাতীয় ক্ষুদ্র উদ্ভিদকে উদ্ভিদ প্লাঙ্কটন বা ফাইটোপ্লাঙ্কটন (phytoplankton) বলে। এছাড়া পানিতে অবস্থিত সুবজ শেওলা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় নিজের খাদ্য তৈরি করতে পারে, এ সমস্ত উদ্ভিদকে উৎপাদক বলে।
প্রথম স্তরের খাদকঃ পানিতে ভাসমান বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রাকার পোকা, মশার শুককীট, প্রাণি প্লাঙ্কটন (zooplankton) ইত্যাদি প্রথম স্তরের খাদক হিসেবে কাজ করে। এ সমস্ত খাদক নিজে খাদ্য তৈরি করতে পারে না এবং সরাসরি উৎপাদককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
দ্বিতীয় স্তরের খাদকঃ এরা প্রথম স্তরের খাদককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। ছোট ছোট মাছ, জলজ পতঙ্গ, চিংড়ি, ব্যাঙ প্রভৃতি দ্বিতীয় স্তরের খাদকের অন্তর্ভূক্ত।
তৃতীয় স্তরের খাদকঃ শোল, বোয়াল, ভেটকি প্রভৃতি বড় আকারের মাছ, বক, গাংচিল প্রভৃতি তৃতীয় স্তরের খাদক। এরা দ্বিতীয় স্তরের খাদককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
বিয়োজকঃ পুকুরের পানিতে ভাসমান অথবা নিচের কাদায় বিভিন্ন ধরনের অনুজীব (যেমন : ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অ্যাকটিনোমাইসিটিস ইত্যাদি) বাস করে, এদেরকে বিয়োজক জীব বলা হয়। এরা জীবিত বা মৃত খাদক প্রাণিদের আক্রমণ করে ও পচন ঘটায়, ফলে উৎপাদকের ব্যবহার উপযোগী জৈব ও অজৈব রাসায়নিক পদার্থের সৃষ্টি হয়।
কৃত্রিম বাস্তুসংস্থান (Artificial Ecosystem)
প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যে কৃত্রিম পদ্ধতিতে উদ্ভিদ বা প্রাণি চাষাবাদের ব্যবস্থা করেন তাকে কৃত্রিম বাস্তুসংস্থান বলে।
কৃত্রিম বাস্তুসংস্থানের আদর্শ উদাহরণ হিসেবে এ্যাকোরিয়াম, চন্দ্রযান ইত্যাদি উল্লেখ করা যেতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা গবেষণাগার ছাড়াও বসতবাড়ি ও অফিস – আদালত এ্যাকোরিয়ামে সৌন্দর্য ও মনোরঞ্জনের জন্য বিশেষ ধরনের মাছ ও উদ্ভিদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিশালকার এ্যাকোরিয়াম তৈরি করে সেখানে বিভিন্ন ধরনের ছোট ও বড় মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
এ্যাকোরিয়াম সাধারণত কাচ নির্মিত এবং এতে পানি, বিশেষ জাতীয় জলজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড় ছাড়াও বিভিন্ন অজৈব উপাদান যুক্ত করা হয়। এছাড়া আলোক শক্তি, নিয়মিতভাবে বায়ুর সাথে অক্সিজেন সরবারাহ ও প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্য সরবরাহ করে মাছ চাষ করা হয়। এজন্য এতে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের সকল উপাদান অনুপস্থিত। কৃত্রিম বাস্তুসংস্থানে কৃত্রিমভাবে স্বল্পমেয়াদী মাছ চাষাবাদ ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হলেও এখানে স্বাভাবিক বাস্তুসংস্থানের ন্যায় বস্তুর পুনরজাতকরণ, বিষক্রিয়া দূরীকরণ, পুনঃবিয়োজন এবং শক্তিপ্রবাহ প্রভৃতি অনুপস্থিত।
শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “বাস্তুসংস্থান কাকে বলে? | বাস্তুসংস্থানের প্রকারভেদ | স্থলজ বাস্তুসংস্থান | জলজ বাস্তুসংস্থান” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।