চলিত ভাষা কাকে বলে?

চলিত ভাষা কাকে বলে?

যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ সংক্ষিপ্ত আকারে বিদ্যমান থাকে, তাকে চলিত ভাষা বলে।

যেমন : তারা কাজ করছে।

চলিত বাংলা গদ্যরীতির প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে যার নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন তিনি শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়। বয়সের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমসাময়িক। বাংলা সাধু গদ্যরীতির আঁটোসাঁটো বন্ধন থেকে ভাষাকে সহজ স্বাভাবিক করে তোলার বাসনায় তিনি ‘ক্যালকাটা রিভিউ’তে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ঐ প্রবন্ধে তিনি প্রস্তাব করেন যে –

১) বাংলায় স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ রাখার প্রয়োজন নেই;

২) বহুবচনে গণ প্রত্যয় বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাভাবিক নয়;

৩) বাংলায় অযথা সন্ধির ভার বাক্যের পক্ষে ক্ষতিকর;

৪) অবিকৃত সংস্কৃত (অর্থাৎ তৎসম) শব্দের তুলনায় রূপান্তরিত (অর্থাৎ তদ্ভব) এবং দেশজ শব্দের ব্যবহারই বাংলায় স্বাভাবিক।

শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এসব প্রস্তাবে, তাঁর কালের তুলনায়, অনেক বেশি আধুনিক চিন্তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত চলিত বাংলার সঙ্গে সাধু বাংলার প্রধান যে পার্থক্য অর্থাৎ সর্বনাম পদের ও ক্রিয়াপদের, সে সম্পর্কে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কোন প্রস্তাব নেই। তারপরও বলা যায়, শ্যামাচরণেল ঐ প্রস্তাবসমূহ চলিত বাংলা প্রবর্তনে বা ভাষাকে, সরল ও সাবলীল করে তোলার আন্দোলন বেগবান করেছিল।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসের লেখক প্যারীচাঁদমিত্র তাঁর লেখায় তৎকালীন কলিকাতার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে সাহিত্য মর্যাদা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে প্যারীচাঁদের ঐ ভাষাভঙ্গি অন্যদের দ্বারা অনুসৃত হয়ে বিকাশ লাভ করেনি; এমনকি প্যারীচাঁদ মিত্র নিজেও সে ভাষাভঙ্গি পরিত্যাগ করেছিলেন। হয়তো এর অন্যতম কারণ, সমকালের মানুষের সাহিত্য রুচির সঙ্গে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ – এর ভাষায় খুব বেশি ঐক্য সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ফলে ‘আলালীভাষা’র অকাল মৃত্যু ঘটে।

বর্তমানে যাকে আমরা চলিত ভাষা বলে চিনি তার প্রবর্তনেরও প্রয়োগের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রমথ চৌধুরীর বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপের জন্য। ১৯১৪ সালে ‘সবুজপত্র’ নামে একটি উঁচুমানের পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন তিনি। ঐ পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই চলিত বাংলার প্রায়োগিক প্রকাশ ঘটতে থাকে। প্রমথ চৌধুরীর এ প্রচেষ্টা খুব সহজসাধ্য ছিল না কিন্তু অসীম সাহসিকতায় চলিত বাংলার পক্ষে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেনাপতির ভূমিকায়। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘কথার কথা’, ‘বঙ্গভাষা বনাম বাবু বাংলা ওরফে সাধুভাষা, সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা, আমাদের ভাষা সংকট প্রভৃতি প্রবন্ধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘কথার কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমার ইচ্ছে বাংলা সাহিত্য বাংলা ভাষাতেই লেখা হয়।’ তার কারণ স্বাধীন হয়ে, স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টাতেও সুখ আছে। সংস্কৃতের মৃতদেহ স্কন্ধে নিয়ে বা সংস্কৃতের অঞ্চল ধরে বেড়ানো’তে বাংলা ভাষার কোন কল্যাণ নেই। তারপর তিনি প্রশ্ন করেছেন, কাকে বলে বাংলা ভাষা? উত্তর দিচ্ছেন এভাবে, যে ভাষা আমরা সকলে জানি শুনি বুঝি যে ভাষায় ভাবনা চিন্তা সুখ-দুঃখ বিনা আয়াসে বিনা ক্লেশে বহুকাল হতে প্রকাশ করে আসছি, এবং সম্ভবত আরো বহুকাল পর্যন্ত প্রকাশ করব, সেই ভাষাই বাংলা ভাষা। তাই চলিত বাংলার প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মতামত হচ্ছে, আসল কথাটা কি এই নয় যে, লিখিত ভাষায় আর মুখের ভাষায় মূলে কোনো প্রভেদ নেই। ভাষা দুয়েরই এক, শুধু প্রকাশের উপায় ভিন্ন। একদিকে স্বরের সাহায্যে অপরদিকে অক্ষরের সাহায্যে। বাণীর বসতি রসানায়। শুধু মুখের কথাই জীবন্ত।

যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়। আমাদের প্রধান চেষ্টার বিষয় হওয়া উচিত কথায় ও লেখায় ঐক্য রক্ষা করা, ঐক্য নষ্ট করা নয়। ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমে মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।

চলিত বাংলা সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী এই মানসিকতা ও সবুজপত্রকে কেন্দ্র করে তাঁর কুশলতায় আধুনিক বাংলায় চলিত গদ্যরীতি বিকশিত হবার সুযোগ পেয়েছে। তা ছাড়া প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে সব সময় ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকুণ্ঠ সমর্থন। ফলে প্রমথ চৌধুরীর প্রচেষ্টা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহ ও পৃষ্টপোষকতায় বাংলা গদ্যে চলিত রীতি আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বাভাবিক কারণে পিছিয়ে পড়েছে সাধুভাষা এবং সম্প্রতি তা সম্পূর্ণ বর্জিত হবারও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

5/5 - (28 votes)

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.