নগরায়ন কাকে বলে?
নগরায়ন কাকে বলে?
প্রায়শ আমরা ‘শহর’ ও ‘নগর’ শব্দদুটিকে সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করি। গ্রিক, মেসোপটেমিয়া ও সুমেরীয় সভ্যতার যুগে শহুরে (civitus) কথাটি পরিবার ও উপজাতির ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে বোঝাত। নগর ছিল জনসমাবেশ বা পারিবারিক সংগঠনের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট স্থান।
সপ্তদশ শতাব্দীর পর থেকে শহর শব্দটি অন্য অর্থে ব্যবহার করা শুরু হয়। শহর বলতে বোঝানো হয় একটি বিশেষ ধরনের জায়গা। আর শহরে যে ধরনের জীবনযাত্রা প্রচলিত তাকে নাগরিক জীবন বলা হয়। লোকবসতি প্রকৃতি ও সাংগঠনিক জটিলতার ওপর ভিত্তি করে গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে বড় শহর এবং বড় শহর থেকে মহানগরেকে পৃথক করা হয়।
গর্ডন চাইল্ড, ম্যাকস ওয়েবা -এর মতো সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, শহরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বাজারের অবস্থান ও সেখানে বিশেষ শ্রেণির ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি। এছাড়া ব্যবসা – বাণিজ্যের পরিপূরক হিসাবে অন্যান্য ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠান, জটিল শাসন পরিকাঠামো, ধর্মীয় স্থানের উপস্থিতি শহরে দেখা যায়। এটি বাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি রূপ।
বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এবং বিবিধ উৎস থেকে আগত মানুষকে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই জায়গায় নিয়ে আসতে পারে। তারা সকলেই এক সঙ্গে বাস করতে শেখে। বিভিন্ন প্রয়োজন ও আগ্রহ পূরণের জন্য, নাগরিকরা নিজেদের অপেক্ষাকৃত জটিল প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসের মধ্যে সংগঠিত করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অপ্রত্যক্ষ (indirect) সম্পর্ক ও যুক্তি নির্ভর পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় কার্যপদ্ধতি গড়ে ওঠে। শহরের মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলি হলো জটিল দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ, জনবসতির অসমতা, নামহীনতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা।
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীরা নগরায়নের নানা সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন। সকল সংজ্ঞা থেকে পাওয়া নগরায়ন সম্পর্কে যে মূল সত্য হলো – নগরায়ণ হল গ্রাম্য মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে অকৃষি পেশার জন্য যেখানে শিল্প ব্যবসা গড়ে উঠেছে সেসব স্থানে আস্তানা বা বসবাস গড়ে তোলা। ব্যাপক অর্থে নগরায়ণ হল একটি প্রক্রিয়া। তাই এই প্রক্রিয়া বোঝার জন্য আমাদের তিনটি দিক আলোচনা করতে হবে:
১) জনসংখ্যা ও ব্যাপনস্থল দিক
২) অর্থনৈতিক দিক এবং
৩) সামাজিক – সাংস্কৃতিক দিক।
১) জনসংখ্যা ও ব্যাপনস্থল দিকঃ নগরায়ণের জনসংখ্যা ও ব্যাপনস্থল দিক আলোকপাত করে গ্রাম্য এলাকা থেকে জনগণ শহরে এলাকায় অনুপ্রবেশ, শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব, জমির ব্যবহারের পরিবর্তন অর্থাৎ কৃষিজমির ব্যবহারের হার হ্রাস এবং কৃষি জমি, শিল্প, কলকারখানায় ব্যবহৃত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
২) অর্থনৈতিক দিকঃ নগরায়নের অর্থনৈতিক দিক হলো কৃষি পেশা থেকে শিল্প পেশায় পরিবর্তন। স্বাধীনতার পর যেসব স্থানে কলকারখানা স্থাপিত হচ্ছে সেইসব শিল্পঞ্চলকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন শিল্পনগরী গড়ে উঠেছে। গ্রাম থেকে নগরে বসতি স্থাপন করার প্রবণতাকে সমাজতত্ত্ববিদগণ নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। তাদের প্রদত্ত ব্যাখ্যা মোটামুটি দুটি শ্রেণির অন্তর্গত। অনেক সময় গ্রামের প্রতিকূল পরিবেশ কিছু সংখ্যক মানুষকে গ্রাম ছেড়ে আসতে বাধ্য করে। সমাসতত্ত্ববিদগণ এই জাতীয় কারণকে Push factor বলে অভিহিত করেন। আবার অনেক সময় শহরে নানারকম সুযোগ-সুবিধে কিছু সংখ্যক গ্রামবাসীকে শহরে আকর্ষণ করে আনে। এই জাতীয় কারণকে সমাজতত্ত্ববিদগণ Pull factor বলে অ্যাখ্যা দেন।
৩) সামাজিক – সাংস্কৃতিক দিকঃ নগরায়ণের সামাজিক – সাংস্কৃতিক দিক শহরের বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা দিক আলোচনা করে। নগরায়নের ফলে শহরে ধর্ম, বর্ণ এবং কৃষ্টির ভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়।