তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কোথায় কোথায় ব্যবহার করা যায়?
ভূমিকা
আমরা খুবই সৌভাগ্যবান। কারণ ঠিক এই সময়টাতে সারা পৃথিবীতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কারণে একটা অসাধারণ বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে। আমরা সেই বিপ্লবটাকে ঘটতে দেখছি। সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে। আমরা ইচ্ছে করলে সেই নতুন জীবনে বসবাস করতে পারি কিংবা আমরা নিজেরাই পৃথিবীটাকে পাল্টে দেওয়ার কাজে লেগে যেতে পারি।
তথ্য ও প্রযুক্তির এই উন্নতির কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন হবে সেটি কেউ বলে শেষ করতে পারবে না। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দিয়ে আমরা কেবল তথ্যের আদান – প্রদান করি না। আমরা তথ্যগুলো বিশ্লেষণ বা প্রক্রিয়াও করি আর সেই কাজ করার জন্য কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয়। কম্পিউটার একটি অসাধারণ যন্ত্র, সেটা দিয়ে সম্ভব – অসম্ভব সব কাজ করে ফেলা যায়।
সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাটার হচ্ছে যে, কম্পিউটার এখন এত ছোট করে তৈরি করা সম্ভব যে, আমাদের মোবাইল ফোনের ভেতরেও সেটা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই আগে আমরা যে কাজগুলো শুধুমাত্র কম্পিউটার দিয়ে করতে পারতাম সেগুলো আমরা এখন মোবাইল টেলিফোন দিয়েও করতে পারি। এমনকি আমরা মোবাইল টেলিফোন দিয়ে ইন্টারনেটে পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে পারি।
ব্যবহারের ক্ষেত্রসমূহ
ব্যক্তিগত বা সামাজিকভাবে যোগাযোগ : শুধু মোবাইল ফোন দিয়েই আমরা আজকাল একে অন্যের সাথে অনেক বেশি যোগাযোগ করতে পারি। তার সাথে এস.এম.এস, ইমেইল, চ্যাটিং এমনকি সামাজিক যোগাযোগ যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখতে পাব যোগাযোগের বেলায় একটা অনেক বড় পরিবর্তন এসেছে। সবটুকুই যে ভালো তা কিন্তু নয় – নতুন প্রজন্মের কেউ এই ব্যাপারে বেশি সময় নষ্ট করছে, কেউ কেউ মনে করছে এই যোগাযোগটি বুঝি সত্যিকারের সামাজিক যোগাযোগ। কাজেই এগুলোতে বেশি নির্ভরশীল হয়ে কেউ কেউ খানিকটা অসামাজিকও হয়ে যেতে পারে।
বিনোদন : এখন বিনোদনও অনেকখানি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা থেকে শুরু করে কম্পিউটার গেম খেলায় পর্যন্ত এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। ক্রিকেট বা ফুটবল খেলাতে এই প্রযুক্তি কত চমৎকারভাবে ব্যবহার করা হয় আমরা সবাই সেটি দেখেছি। খেলার মাঠে না গিয়েও ঘরে বসে আমরা অনেক বড় বড় খেলা খুব নিখুঁতভাবে দেখতে পারি।
বিনোদন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করার বিষয়ে আমাদের একটু সতর্ক থাকার ব্যাপার আছে। একটি ছোট শিশুর শরীরটাকে ঠিকভাবে গঠন করর জন্য মাঠে ছোটাছুটি করে খেলতে হয়। অনেক জায়গাতেই দেখা যায়, বাবা মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের মাঠে ছোটাছুটি না করিয়ে ঘরে কম্পিউটারের সামনে দীর্ঘ সময় বিনোদনে ডুবে থাকতে দিচ্ছেন। সত্যিকারের খেলাধুলা না করে শিশুরা কম্পিউটার থেলায় মেতে উঠছে। একটা শিশুর মানসিক গঠনের জন্যে সেটা কিন্তু মোটেও ভালো নয়। সারা পৃথিবীতেই কিন্তু এই সমস্যাটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে : একজন শিক্ষার্থীর কাছে সবচেয়ে আনন্দের ধ্বনি কি, সেক্ষেত্রে অনেক অনেক কিছু বলতে পারে কিন্তু সবাই জানে শিক্ষার্থীর জন্যে সেটা হচ্ছে ছুটির ঘণ্টা। স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বাজলে পৃথিবীর সকল স্কুলের শিক্ষার্থীরা আনন্দ প্রকাশ করে। যাঁরা শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করে ভাবনা করেন তাঁরাও সেটা জানেন। তাই সব সময় চেষ্টা করেন কিভাবে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনটা একটু হলেও আনন্দময় করা যায়। লেখাপড়ার ব্যাপারে যখন আইসিটি ব্যবহার করতে শুরু করা হয়েছে তখন হঠাৎ করে সেই কাজটি সহজ হতে শুরু করেছে। এখন শুধু সারাক্ষণ শিক্ষকের বক্তৃতা শুনতে হবে না, মাথা গুঁজে কোনো কিছু মুখস্থ করতে হবে না। এখন মাল্টিমিডিয়াতে লেখাপড়ার অসংখ্য চমকপ্রদ বিষয় দেখানো যায়, বিজ্ঞানের বিষয়গুলো স্ক্রিনে প্রদর্শন করা যায়, এমনকি পরীক্ষার খাতায় কিছু না লিখে সরাসরি কম্পিউটারে পরীক্ষা দেওয়া যায়। এখন ব্যাগ বোঝাই করে পাঠ্য বই নিয়ে যেতে হয়। কিছুদিন পর আর হয়তো প্রয়োজন হবে না। একটা ই-বুক ডিভাইসে শিক্ষার্থীরা শুধু যে তার পাঠ্যবই রাখতে পারবে তা নয়; লাইব্রেরীর কয়েক হাজার বই পর্যন্ত রাখতে পারবে।
চিকিৎসা : আজকাল আইসিটি ব্যবহার না করে চিকিৎসার কথা কল্পনাও করা যায় না। আগে কারও অসুখ হলে ডাক্তাররা রোগীর নানা ধরনের উপসর্গ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে রোগ নির্ণয় করতেন। এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে নিখুঁতভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়। শুধু তাই নয়, কেউ যদি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যায়, তখন তার সব ধরনের তথ্য সংরক্ষণ থেকে শুরু করে তার চিকিৎসার বিভিন্ন খুঁটিনাটি আইসিটি ব্যবহার করে সংরক্ষণ করা সম্ভব। দূর থেকে টেলিফোন ব্যবহার করেও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায়। সেটার নাম দেওয়া হয়েছে টেলিমেডিসিন, সেটা আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে।
বিজ্ঞান ও গবেষণা : সম্ভবত আইসিটির সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বিজ্ঞানে এবং গবেষণায়। আইসিটির কারণে এখন বিজ্ঞানীরা গবেষণার অনেক জটিল কাজ অনেক সহজে করে ফেলতে পারেন। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরাও যখন পাটের জিনোম বের করেছিলেন তখন তাঁরা আইসিটির ব্যবহার করেছিলেন।
কৃষি : আমাদের দেশ হচ্ছে একটি কৃষিনির্ভর দেশ, আধুনিক উপায়ে চাষ করে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আইসিটি ব্যবহারের ফলে আমাদের দেশের চাষিরা কৃষিতে সুফল পাচ্ছে। রেডিও টেলিভিশনে কৃষি নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে, ইন্টারনেটে কৃষির ওপর ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে, এমনকি চাষিরা মোবাইল ফোনে কৃষি কল সেন্টারে ফোন করেও কৃষি সমস্যার সমাধান পেয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ আর আবহাওয়া : আমাদের দেশে এক সময় ঘুর্ণিঝড়ে অনেক মানুষ মারা যেত। ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী একটা ঘুর্ণিঝড়ে এই দেশে প্রায় ৫ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। বাংলাদেশে এখন ঘূর্ণিঝড়ে আগের মতো এতবেশি মানুষ মারা যায় না; তার কারণ আইসিটি ব্যবহার করে অনেক আগেই ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। আবার রেডিও টেলিভিশনে উপকূলের মানুষকে সতর্ক করে দেওয়া যায়।
প্রচার ও গণমাধ্যম : রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজ বা অনলাইন সংবাদ মাধ্যমকে আমরা বলি প্রচার ও গণমাধ্যম। এই বিষয়গুলো আজকাল অনেক উন্নত হয়েছে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো খবর শুধু যে মুহূর্তের মধ্যে আমরা পেয়ে যাই তা নয় তার ভিডিওটিও দেখতে পাই। এই ব্যাপারগুলো সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র আইসিটির কারণে।
প্রকাশনা : আমাদের দেশের স্কুলের ছেলেমেয়েদের সরকার থেকে প্রতিবছর নতুন বই দেওয়া হয়। এই নতুন বইয়ের সংখ্যা প্রায় পঁয়ত্রিশ কোটি। এই বিশাল সংখ্যক বই ছাপানো সম্ভব হয় শুধুমাত্র আইসিটির কল্যাণে আইসিটি ব্যবহার করে শুধু যে নির্ভুল আর আকর্ষণীয় করে বই ছাপানো যায় তাই নয় – বইগুলো ওয়েবসাইটে রেখেও দেওয়া যায়; যেন যে কেউ সেগুলো ডাউনলোড করে নিতে পারে। যেমন – এনসিটিবির ওয়েবসাইট (www.nctb.gov.bd) থেকে সকল পাঠ্যপুস্তকের সফটকপি বা ই-বুক ভার্সন পাওয়া যায়।
প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধাসমূহ
ব্যবসা বাণিজ্যে আইসিটির ব্যবহার হয়। সাধারণত দোকানপাটে যেরকম বেচাকেনা হয় – ইন্টারনেট ব্যবহার করেও সেরকম বেচাকেনা হয় বলে ই-কমার্স নামে একটা নতুন শব্দই তৈরি করা হয়েছে। অতীতে অফিসের কাজে অনেক সময় ব্যয় হতো। এখন আইসিটি ব্যবহার করে অফিসের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সাধারণত সেটাকে বলে ই-গভর্নেন্স। পুলিশ বাহিনী অপরাধী ধরার জন্য ব্যাপকভাবে আইসিটি ব্যবহার করে। দেশের প্রতিরক্ষার কাজে সেনাবাহিনীও আইসিটি ব্যবহার করে। কলকারখানা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এই বিষয়গুলোও আইসিটির ব্যবহার ছাড়া রাতারাতি অচল হয়ে যাবে।
আমরা যদি আমাদের কাজ কর্মগুলো তথ্য আর যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে না করি, তাহলে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়বো।
উপসংহার
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যে শুধুমাত্র আমাদের নিজের জীবনটাকে সহজ করতে পারি তা নয়, আমরা কিন্তু আমাদের দেশটাকেও পাল্টে ফেলতে পারি। একসময় মনে করা হতো তেলের খনি, লোহার খনি বা সোনা রূপার খনি কিংবা বড় বড় কলকারখানা হচ্ছে পৃথিবীর সম্পদ। তাই যে দেশে এগুলো বেশি তারা হচ্ছে সম্পদশালী দেশ। এখন কিন্তু এই ধারণা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন মনে করা হয় জ্ঞান হচ্ছে পৃথিবীর সম্পদ, আর যে দেশের মানুষজন লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত, যারা জ্ঞান চর্চা করে সেই দেশ হচ্ছে সম্পদশালী দেশ।