আইন ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় কর।

আইন ও স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় কর।

সাধারণভাবে স্বাধীনতা বলতে নিজের খুশিমত যা কিছু করবার অবাধ ক্ষমতাকে বোঝায়। অন্যদিকে আইন হলো মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী এবং সার্বভৌম শক্তির দ্বারা সমর্থিত ও প্রযুক্ত নিয়মাবলী।

সুতরাং আপাত দৃষ্টিতে আইন ও স্বাধীনতাকে পরস্পর বিরোধী বলেই মনে হয়। জন স্টুয়ার্ট মিল, হার্বাট স্পেনসার, লর্ড ব্রাইস প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, আইন ও স্বাধীনতার পরস্পর বিরোধী, একটির আধিক্য দেখা দিলে অপরটি সংকুচিত হয়ে পড়ে।

কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে আইন স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, বরং সহায়ক ও সংরক্ষক। অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত না হলে সবলের অত্যাচারে দুর্বলের স্বাধীনতা এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রের আক্রমণে দুর্বল রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়বে।

অবাধ স্বাধীনতা স্বীকৃত হলে সমাজে কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করবে, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ দুর্বল জনগণ আত্মবিকাশের উপযোগী সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই সকলের জন্য স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই প্রয়োজন।

রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে যথেচ্ছাচারের স্বাধীনতার ওপর বাধানিষেধ আরোপ করে জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করে।

আইন কেবল স্বাধীনতাকে রক্ষাই করে না, সম্প্রসারিতও করে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রে যে শ্রমিক কল্যাণকর আইনগুলি প্রচলিত হয়েছে এবং হচ্ছে, সেগুলি শ্রমিকদের স্বাধীনতাকে যথেষ্ট সম্প্রসারিত করেছে।

ফ্যাক্টরী আইন, শ্রমিক নিরাপত্তামূলক আইন প্রভৃতি প্রণয়ন করে রাষ্ট্র শ্রমিকের কাজের শর্ত নির্দিষ্ট করতে পারে, বৃদ্ধ, অসুস্থ ও অক্ষম অবস্থায় ভাতা দেবার ব্যবস্থা করতে পারে। এরূপ আইনের ফলে মালিকদের স্বাধীনতা কিছুটা সংকুচিত হয় সত্য, কিন্তু লক্ষ লক্ষ শ্রমিক মালিকদের শোষণ থেকে অনেকটা মুক্তি পায়।

আইনের দ্বারা ব্যবসায়ীর স্বাধীনতাকে খর্ব না করলে ভোক্তার স্বাধীনতা রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এইভাবে আইন স্বাধীনতাকে রক্ষা করে। এই প্রসঙ্গে বার্কার বলেছেন, বলেছেন, “প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অন্য সকলের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ”।

বস্তুতপক্ষে অবাধ স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রিত করে, সবলের অত্যাচার থেকে দুর্বলকে রক্ষা করে, শাসকগোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতাকে দমন করে আইন এমন এক পরিবেশ রচনা করে যেখানে ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের যথার্থ সুযোগ পায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রিচি-র ভাষায়, “স্বাধীনতা বলতে যদি আত্মবিকাশের জন্য আবশ্যক সুযোগ-সুবিধা বোঝায়, তবে তা অবশ্যই আইনের দ্বারা সৃষ্ট”।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। তাই বলা হয়, “আইন হলো স্বাধীনতার শর্ত”। তবে ল্যাস্কি (এবং মার্কসবাদীরা) বলেছেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তাই বলা যেতে পারে, একমাত্র শ্রেণীহীন, শোষণহীন, সাম্যভিত্তিক সমাজেই আইন স্বাধীনতার শর্ত হয়ে উঠতে পারে।

Similar Posts