সেবা বলতে কি বুঝায়? সেবার প্রকারভেদ | সেবার বৈশিষ্ট্য | সেবার গুরুত্ব

সেবা বলতে কি বুঝায়?

সেবা এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Services। আর এই Services শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Servitium হতে এসেছে।

সেবা হচ্ছে এমন কিছু কার্যবলী যেগুলোর পৃথকভাবে অস্তিত্ব শনাক্তকরণযোগ্য কিন্তু স্পর্শযোগ্য নয়। এটি ক্রেতার প্রয়োজন ও অভাব পূরণে সক্ষম। যেমনঃ আইনী সহায়তা, শিক্ষা ও শিশুর পরিচর্যা।

সেবা হলো উপস্থাপিত কোনো কার্যাবলি বা সুযোগাদি অথবা সন্তুষ্টি, যা অবস্তুগত, অদৃশ্যমান এবং মালিকানা স্বত্বহীন।

 

Kotler and Armstrong বলেছেন, “সেবা হচ্ছে যে কোন কাজ বা সুবিধা যা একপক্ষ অন্য পক্ষকে প্রদান করে, যা অবশ্যই অস্পর্শনীয় এবং এতে মালিকানার পরিবর্তন ঘটে না।”

Zikmund and D. Amico বলেছেন, “সেবা হলো কোনো কাজ বা কার্যক্রম, যা ক্রেতার জন্য সম্পাদিত হয়ে থাকে।”

অতএব, সেবা সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে –

১) সেবা আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায়

২) সেবা ধরা বা ছোঁয়া যায় না, তবে উপলদ্ধি করা যায়

৩) এটি ভোক্তার অভাব মেটাতে পারে

৪) সেবা ও সেবাদানকারী পরস্পর অবিচ্ছিন্ন ও সম্পর্কযুক্ত এবং

৫) সেবা সংরক্ষণ করা যায় না, তবে সরবরাহ করা যায়।

 

পরিশেষে বলা যায়, মানুষের অভাব পূরণে সক্ষম অস্পর্শনীয়, তবে সনাক্তকরণযোগ্য কার্যাবলি যা মানুষের উপকারে ব্যবহৃত হয়, তাকে সেবা বলে গণ্য করা হয়। আর সেবা সরবরাহের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনে জড়িত ব্যবসায়কে সেবামূলক ব্যবসায় বলা হয়।

 

সেবার প্রকারভেদ

মানুষ বিভিন্ন পণ্য দ্রব্য ক্রয় করে সেই সাথে সেবাও আশা করে। পৃথকভাবে সেবা গ্রহণ করে অর্থ বা মূল্য পরিশোধ করে। কিছু সেবা পণ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যেমন- মোবাইলফোনের সাথে অথবা কম্পিউটারের সাথে বিক্রয়োক্তর সেবা। আবার, কিছু সেবা আছে পণ্যের সাথে সম্পর্ক নেই, যেমন ডাক্তারের পরামর্শ বা চিকিৎসা সেবা। সেবা খাতটি ক্রমাগতভাবে Stanton, Etzel and Walker – সেবা খাতকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করেন। যথাঃ

ক. মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানের সেবা

তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বর্তমান এ বিশ্বে বিপণনকারীকে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই ক্রেতাদেরকে সেবা প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। কেবল মুনাফা অর্জন করেই বর্তমান বাজারে টিকে থাকা সম্ভব নয়; বরং ক্রেতাদেরকে সেবা প্রদানের মাধ্যমেই মুনাফা অর্জন সম্ভব হয় এবং বাজারে টিকে থাকাও সহজ হয়। এক্ষেত্রে মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে সকল সেবা প্রদান করে সেগুলো নিচে আলোচনা করা হলো-

 

১. ক্যাটারিং ও বিনোদন সেবাঃ রেস্টুরেন্ট, ক্যাফেটারিয়া, ফাস্ট ফুড, সার্কাস, নাট্যমঞ্চ, নাচ, বিনোদন পার্ক ইত্যাদি।

২. ব্যক্তিগত পরিচর্যাঃ বিউটি পার্লার, সেলুন, জেন্টস্ পার্লার, ড্রাইক্লিনিং, লন্ড্রি, দর্জি, জিমনেসিয়াম ইত্যাদি।

৩. প্রাইভেট শিক্ষাঃ কিন্ডারগর্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, প্রাইভেট স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার, গৃহশিক্ষক ইত্যাদি।

৪. ব্যবসায় ও অন্যান্য পেশাদারি সেবাঃ আইন, উকিলের পরামর্শ ব্যবস্থাপনাগত পরামর্শ, বিপণন গবেষণা, বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইত্যাদি।

৫. ইন্সুরেন্স, ব্যাংকিং ও অন্যান্য আর্থিক সেবাঃ ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক বিমা, ব্যাংকিং ঋণ ও সেবা, বিনিয়োগ ইত্যাদি।

৬. পরিবহণঃ যাত্রী পরিবহণ, মালামাল বা পণ্য পরিবহণ, গাড়ি মেরামত ও ভাড়া, দ্রুত পার্সেল সার্ভিস (এস. এ. পরিবহণ)।

 

৭. যোগাযোগঃ মোবাইল ফোন, ল্যান্ড ফোন, ইন্টারনেট, ফ্যাক্স, ই-মেইল, কুরিয়ার সার্ভিস ইত্যাদি।

৮. আবাসনঃ হোটেল, মোটেল, এপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট ইত্যাদি।

৯. গৃহস্থালির কাজঃ গৃহ মেরামত, গৃহের যন্ত্রপাতি মেরামত, পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা বিষয়ক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।

খ. অব্যবসায়ী বা অমুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠানের সেবা 

যে সকল প্রতিষ্ঠান মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয়ে জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পাদন করে তাকে অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বলে। এরূপ অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ধরণের সেবা প্রদান করে থাকে যেগুলো নিচে আলোচনা করা হলো-

 

১. শিক্ষাগতঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়।

২. সাংস্কৃতিকঃ যাদুঘর, চিড়িয়াখানা, শিল্পকলা একাডেমি,থিয়েটার দল, ব্যান্ড দল প্রভৃতি।

৩. ধর্মীয়ঃ মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা প্রভৃতি।

৪. দাতব্য এবং মানবসেবাঃ রেড-ক্রিসেন্ট, সন্ধানী, বাঁধন, ক্যান্সার ফাউন্ডেশন, স্কাউটিং, গবেষণা ফাউন্ডেশন প্রভৃতি।

৫. সামাজিক কারণঃ পরিবার-পরিকল্পনা কার্যক্রমের সাথে জড়িত সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, ধূমপান বর্জনে নিয়োজিত সংগঠন (প্রত্যাশা), যৌতুক, এসিডবিরোধী সংগঠন ইত্যাদি।

৬. স্বাস্থ্য সেবাঃ হাসপাতাল, নার্সিং হোম, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, ডায়াবেটিক সোসাইটি, ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ইত্যাদি।

৭. পেশাগত ও ব্যবসায়ঃ শ্রমিক ইউনিয়ন, অফিসার্স কল্যাণ সমিতি, শিক্ষক-কর্মচারী সমিতি, ডক্টর এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ইত্যাদি।

৮. রাজনৈতিকঃ রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি।

 

পরিশেষে বলা যায়, ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরণের সেবার আয়োজন করেছে। উপরের তালিকায় কোনো কোনো উপাদানকে মুনাফা অর্জনকারী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আওতায় দেখানো হয়েছে। যেমন: স্কুল, হাসপাতাল। এক্ষেত্রে কতিপয় স্কুল, হাসপাতাল রয়েছে যারা মুনাফা অর্জনকারী আবার এমন কতিপয় স্কুল, হাসপাতালও রয়েছে যারা পুরোপুরি অব্যবসায়ী অর্থাৎ, মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

সেবার বৈশিষ্ট্য

সেবার প্রধান চারটি বৈশিষ্ট্য হলোঃ

১) অদৃশ্যমান (Intangibility): সেবার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর অদৃশ্যমানতা। সেবা দেখা যায় না বা ছোঁয়া যায় না, তবে অনুভব করা যায়।

২) অবিভাজ্যতা (Inseparability): সেবার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অবিভাজ্যতা। অর্থাৎ সেবা প্রদানকারী বস্তু বা ব্যক্তিকে প্রদত্ত সেবা থেকে আলাদা করা যায় না।

৩) পরিবর্তনশীলতা (Variability): সেবার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন সময়ে সেবার মধ্যে পরিবর্তন আসতে পারে আবার একজন ব্যক্তি বা বস্তু থেকে প্রাপ্ত সেবা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হতে পারে। সুতরাং সেবার মান সবসময়ই পরিবর্তনশীল।

৪) মজুদ অযোগ্যতা বা পচনশীলতা (Perishability): সেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ক্ষয়িঞ্চুতা। অর্থাৎ সেবাকে পণ্যের মতো মজুদ করে রাখা যায় না।

 

সেবার গুরুত্ব

সেবা বাজারজাতকরণের গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলছে। এর মাধ্যমে নতন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মনোন্নয়ন হচ্ছে এবং জীবন ধাঁচের পরিবর্তন হচ্ছে। যার কারণে হোটেল, মোটেল, শিশুপার্ক জনপ্রিয় হচ্ছে। প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্যে সেবামূলক পণ্য চাহিদা বাড়ছে। মাথাপিছু আয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের অবসর সময় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই বিনোদন বৃদ্ধি হচ্ছে। মানুষের অবসর সময় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই বিনোদন কেন্দ্রের গুরুত্ব বাড়ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেনতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কোচিং সেন্টার, বিউটি পার্লার, জিমনেসিয়াম ইত্যাদি সেবা প্রতিষ্ঠানের কদর বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বপরি বিশ্বায়নের কারণে সেবা খাতের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। সেজন্য বলা যায় যে, সেবার গুরুত্ব অপরিসীম।

Similar Posts