ভূমির ধারণা | ভূমির বৈশিষ্ট্য | ভূমির গুরুত্ব

ভূমির ধারণা (Concept of Land)

সাধারণভাবে পৃথিবীর উপরিভাগকে ভূমি বলে। কিন্তু শুধুমাত্র পৃথিবীর উপরিভাগই ভূমির অন্তর্ভূক্ত নয়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য এ পৃথিবীতে মাটি, মাটির উর্বরাশক্তি, আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, জলবায়ু, তাপ, পানি, বাতাস, সূর্যের আলো, খনিজ সম্পদ, বনজ সম্পদ, মৎস্য ক্ষেত্র, নদ-নদী ইত্যাদি অকাতরে দান করেছেন। সৃষ্টিকর্তার এসকল দানই হলো ভূমি।

অর্থাৎ ভূমি বলতে শুধুমাত্র পৃথিবীর উপরিভাগ অর্থাৎ জমিকে না বুঝিয়ে প্রাকৃতিক সকল সম্পদকে বুঝায়। ভূমি উৎপাদনের একটি আদি ও মৌলিক উপাদান।

 

ভূমির বৈশিষ্ট্য (Feature of Characteristic of Land)

উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে ভূমি বলতে শুধুমাত্র পৃথিবীর উপরিভাগকেই বুঝায় না। ভূমি বলতে প্রকৃতি প্রদত্ত সকল সম্পদকেই বুঝায়। প্রকৃতি প্রদত্ততা ছাড়াও ভূমির আরো কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। নিম্নে ভূমির বৈশিষ্ট্যাবলি আলোচনা করা হলোঃ

১. ভূমি প্রকৃতির দান (Gift of nature): ভূমি প্রকৃতির অবাধ দান, সৃষ্টিকর্তার দেওয়া শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। মানুষ ভূমি সৃষ্টি করতে পারে না। মাটির উর্বরাশক্তি, সূর্যালোক, বৃষ্টিপাত, আবহাওয়া, খনিজ সম্পদ, বনজ সম্পদ সবই প্রকৃতি মানুষকে মুক্তহস্তে দান করেছে। প্রকৃতির এরূপ অমূল্য দানের সাহায্যে মানুষ উৎপাদন কার্য সম্পাদন করে।

২. ভূমির যোগান সীমিত (Limited supply): ভূমির যোগান সীমিত। সৃষ্টির শুরুতে সৃষ্টিকর্তা যে পরিমাণ ভূমি আমাদের দান করেছেন, আজও সেই পরিমাণ ভূমিই বিদ্যমান আছে। কোন অবস্থাতেই তার হ্রাস বা বৃদ্ধি হয়নি। আবার ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন কার্যে ব্যবহৃত ভূমির যোগান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।

 

৩. ভূমি বিভিন্ন জাতীয় (Various nature): এক স্থানের ভূমির সাথে অন্য স্থানের ভূমির উর্বরাশক্তির তারতম্য ঘটে। এক স্থানের উৎপাদিত ফসলের সাথে অন্য স্থানে উৎপাদিত ফসলের মধ্যে পার্থক্য হয়, আবার সকল কয়লা খনি থেকে একই মানের কয়লা পাওয়া যায় না। কোন কোন ভূমি অবস্থানগত কারণে উদ্যোক্তাদের নিকট লোভনীয় হয়, আবার কোন কোন ভূমি তাদের নিকট ততটা আগ্রহের সৃষ্টি করে না। ভূমির প্রকৃতি, অবস্থান, জলবায়ু ইত্যাদির উর্বরাশক্তি নির্ভর করে।

৪. অস্থানান্তরযোগ্যতা (Nontransferability): ভূমি একটি অস্থানান্তরযোগ্য উৎপাদনের উপাদান। তবে ভূমিকে এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা না গেলেও উৎপাদনের অন্যান্য উপাদানকে ভূমিতে এনে উৎপাদন কার্য সম্পাদন করা যায়।

৫. ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধির কার্যকারিতা (Effectiveness of law of diminishing marginal returns): ভূমির ক্ষেত্রে প্রধানত ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধিটি প্রযোজ্য হয়। ভূমির যোগান সীমিত বলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য একই জমিতে অধিক পরিমাণে শ্রম ও মূলধন নিয়োগ করতে হয়। এর ফলে মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পায় বটে, তবে তা ক্রমহ্রাসমান হারে।

 

৬. ভূমি অবিনশ্বর (Land is permanent): ভূমির ক্ষয় নাই। অর্থাৎ ভূমি চিরন্তন অস্তিত্বসম্পন্ন। অবশ্য আবাদী জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেতে পারে। যাকে ভূমি ক্ষয় বলা হলেও তা ধ্বংস হয় না। তাই বলা যায়, উৎপাদনের অন্যান্য উপাদান নশ্বর হলেও ভূমিই একমাত্র উপাদান যা অবিনশ্বর।

৭. যোগান দাম নেই (No supply cost): উৎপাদনের অন্যান্য উপাদানের যোগান দাম থাকলেও ভূমিই একমাত্র উপাদান যার কোন যোগান দাম নেই। এর মূল কারণ হলো ভূমি সৃষ্টি কর্তার দান, মানুষ তা সৃষ্টি করতে পারে না, একারণে ভূমির যোগান দাম দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। তবে জমির খাজনা বা ভাড়া মূল্য আছে। মূলধন ও শ্রম যেহেতু মানব সৃষ্ট তাই এদুটো উপাদানের যোগান দাম দিতে হয়।

পরিশেষে বলা যায়, ভূমি উৎপাদনের একটি উপাদান হলেও এর এমন কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যা ভূমিকে উৎপাদনের অন্যান্য উপাদান হতে স্বতন্ত্রতা দিয়েছে।

 

ভূমির গুরুত্ব (Importance of Land)

ভূমি উৎপাদনের প্রাকৃতিক, আদি ও মৌলিক উপাদান। অর্থনীতিতে ভূমি বলতে যেহেতু মাটির উর্বরাশক্তি, আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, তাপ, জল, বাতাস, সূর্যের আলো, খনিজ সম্পদ, বনজ সম্পদ, মৎস্য ক্ষেত্র, নদ-নদী ইত্যাদিকে বুঝায়, আর এগুলো ছাড়া কোনো কিছুর উৎপাদনই সম্ভব নয়। নিম্নে ভূমির গুরুত্ব আলোচনা করা হলোঃ

১. আদি ও মৌলিক উপাদান (Ancient and basic factors): ভূমি যেহেতু উৎপাদনের আদি ও মৌলিক উপাদান, তাই এটি ছাড়া যেকোনো প্রকারের উৎপাদন সম্ভব নয়। কৃষি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে জমিই মূখ্য। তাছাড়া শিল্প পণ্য, ভোগ্য পণ্য, সেবা পণ্যসহ যে ধরনের পণ্যই হোক না কেন তা উৎপাদনে ভূমির গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। যেমনঃ কৃষক ফসল উৎপাদন করতে গেলে সর্বপ্রথম তাকে ভূমিকেই বেছে নিতে হবে। ঠিক তেমনি ভাবে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে জমির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম প্রয়োজন হলেও তা বাদ দেওয়ার কোন অবকাশ নেই।

 

২. কাঁচামালের যোগানদাতা (Supplier of raw-materials): মানুষ কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। তারা শুধু প্রকৃতি প্রদত্ত পণ্যকে রূপান্তর করে মাত্র। আমরা যা কিছু ভোগ করি তার কোন কোনটি সরাসরি ভূমি হতেই পেয়ে থাকি, আবার কোনো কোনোটি ভূমি হতে নিয়ে তার আকার-আকৃতি বা গুণাগুণ পরিবর্তন করে ভোগ করি। যেমনঃ আসবাবপত্রের প্রয়োজন হলে প্রকৃতি প্রদত্ত গাছ হতে কাঠ সংগ্রহ করি, যা আসবাবপত্রের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার খাদ্যদ্রব্য অনেকটা সরাসরি ভূমি হতেই পেয়ে থাকি।

৩. জীবনাপোকরণের আঁধার (Source of living elements): বিশ্বের সকল প্রাণীর জীবন ধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবগুলোই ভূমি হতে পাওয়া যায়। তাছাড়া মানুষের মৌলিক চাহিদাসহ যাবতীয় চাহিদার যোগান এ ভূমি হতেই পাওয়া যায়। মানুষের অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সকল প্রকার প্রয়োজন মেটানোর জন্য সে সকল উপকরণ প্রয়োজন হয়, তা কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমরা এ ভূমি হতেই পেয়ে থাকি। তাই বলা যায়, প্রয়োজনীয় সকল উপকরণের আঁধার হলো ভূমি।

 

৪. অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমি (To economics development): ভূমির প্রকৃতি, অবস্থান, পরিমাণ ইত্যাদি যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সমতল ও সমুদ্র তীরবর্তী স্থানে অবস্থিত দেশে যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব হয়, বন্ধুর ও মরুভূমিতে অবস্থিত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ততটা সহজ হয় না। আবার খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ কোনো দেশে যেভাবে শিল্প কারখানা গড়ে উঠে,খনিজ সম্পদ হীন কোনো দেশে সেভাবে কারখানা গড়ে উঠে না। আবার অর্থনীতির জন্য অনুকূল জলবায়ুতে যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে, প্রতিকূল জলবায়ুতে তা অনেকটা কষ্টসাধ্য।

৫. উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের উৎস (Source of all other factors of production): ভূমি উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ যেমনঃ শ্রম, মূলধন ও সংগঠন ইত্যাদির উৎস হিসেবে গণ্য হয়। শ্রম মানুষের শারীরিক ও মানসিক প্রচেষ্টা। আর শ্রমের জন্য মানুষের একদিকে যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, অন্যদিকে তেমন শ্রম প্রদানের ক্ষেত্রই হলো ভূমি। আবার মূলধন হলো শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত অর্থের সঞ্চিত রূপ, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমির উপরই নির্ভরশীল। আর সংগঠনের কাজই হলো উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণকে ভূমিতে নিয়ে উৎপাদন কার্য পরিচালনা করা। তাই বলা যায়, উৎপাদনের সকল উপাদানের যোগানদাতা বা উৎস হলো ভূমি।

 

পরিশেষে বলা যায়, উৎপাদনের আদি ও স্থায়ী উপাদান হিসেবে ভূমির গুরুত্ব এত বেশি যে, এটি ছাড়া শুধুমাত্র উৎপাদন কার্যই ব্যাহত হয় না। বরং এটি ছাড়া পুরো পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের সকলের উচিত প্রকৃতির দান হিসেবে প্রাপ্ত উৎপাদনের এ উপাদানটিকে আমাদের বাসযোগ্য হিসেবে রক্ষা করা।

Similar Posts