সমযোজী বন্ধন (Covalent Bonds)
একটি ধাতব পরমাণু ও একটি অধাতব পরমাণু রাসায়নিক সংযোগের সময় ধাতু তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন অধাতব পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরে স্থানান্তর করে ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন তৈরির মাধ্যমে আয়নিক বন্ধনের সৃষ্টি করে।
যদি দুটি অধাতব পরমাণুর মধ্যে রাসায়নিক সংযোগ করাতে চাই তাহলে সেটি কীভাবে ঘটবে?
অধাতুর বেলায় পরমাণুর শেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন ত্যাগ বা গ্রহণ করা সহজ নয় বলে তাদের ভেতর বন্ধন তৈরি করা কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দুটি অধাব পরমাণু বন্ধন গঠন করে। যেমনঃ দুটি ক্লোরিন (অধাতু) পরমাণুকে যখন কাছাকাছি রাখা হয় তখন তাদের মধ্যে একধরনের রাসায়নিক বন্ধন গঠিত হয়ে ক্লোরিন অণুতে পরিণত হয়।
প্রশ্ন হলো কীভাবে দুটি অধাতব ক্লোরিন পরমাণু একে অপরের সাথে বন্ধন তৈরি করে? এদের তো সর্বশেষ শক্তিস্তরে সাতটি করে ইলেকট্রন আছে।
ক্লোরিনের ইলেকট্রন বিন্যাস হলোঃ Cl(17)=1s22s22p63s23p5
Cl এর সর্বশেষ শক্তিস্তরে সাতটি ইলেকট্রন থাকায় ক্লোরিন পরমাণু সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন প্রদান করতে চাইবে না বরং গ্রহণের প্রবণতা দেখাবে। কিন্তু দাতা পরমাণু না থাকায় গ্রহণ প্রক্রিয়াও ঘটবে না। তাই দুটি ক্লোরিন পরমাণু কাছাকাছি এলে প্রত্যেকটি পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তর থেকে 1টি করে ইলেকট্রন এসে জোড়বদ্ধ হয় এবং ঐ ইলেকট্রন জোড় উভয় পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তর থেকে 1 টি করে ইলেকট্রন এসে জোড়বদ্ধ হয় এবং ঐ ইলেকট্রন জোড় উভয় পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মাঝামাঝি অবস্থান করে। একে ইলেকট্রনের ভাগাভাগি বা ইলেকট্রনের শেয়ারিং বলে। এর ফলে উভয় পরমাণু তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরে আটটি করে ইলেকট্রন লাভ করে অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় গ্যাস এর ইলেকট্রন বিন্যাস লাভ করে। ফলস্বরূপ দুটি ক্লোরিন পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে না। অর্থাৎ এরা এক ধরনের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ ধরনের বন্ধনকে সমযোজী বন্ধন বলে।
অর্থাৎ দুটি অধাতব পরমাণুর রাসায়নিক সংযোগের সময় অধাতব পরমাণুদ্বয় তাদের সর্বশেষ শক্তিস্তরের (এক বা একাধিক) একটি ইলেকট্রনকে সরবরাহ করে এক জোড়া ইলেকট্রন তৈরি করে। এরপর এই এক জোড়া ইলেকট্রন উভয় পরমাণু শেয়ারের মাধ্যমে যে বন্ধন গঠিত হয় তাকে সমযোজী বন্ধন বলে।
যে যৌগে সমযোজী বন্ধন থাকে তাকে সমযোজী যৌগ বলে। প্রতিটি সমযোজী বন্ধনে দুটি ইলেকট্রন অংশগ্রহণ করে। সমযোজী বন্ধনকে একটি রেখার (-) চিহ্ন বা ক্রস (⤬) চিহ্ন দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
ক্লোরিন অণুতে দুটি ক্লোরিন পরমাণু বিদ্যমান। ক্লোরিন অণুর সংকেত হলোঃ Cl2। অনেক অধাতু অণু আকারে থাকে। যেমনঃ হাইড্রোজেন (H2), অক্সিজেন (O2), নাইট্রোজেন (N2), সালফার (S8), ফসফরাস (P4), ব্রোমিন (Br2), আয়োডিন (I2), ফ্লোরিন (F2) ইত্যাদি।
H2 অণুতে সমযোজী বন্ধন
হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস হলোঃ H(1): 1s1
দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু যখন কাছাকাছি আসে তখন উভয় পরমাণুই একটি করে ইলেকট্রন শেয়ার করে নিষ্ক্রিয় গ্যাস এর মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে 2 টি ইলেকট্রন গঠন করে। এর ফলে (H-H) সমযোজী বন্ধনের সৃষ্টি হয়।
O2 অণুতে সমযোজী বন্ধন
অক্সিজেন পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস হলোঃ O(8): 1s22s22p4
অক্সিজেন পরমাণুর সর্বশেষ শক্তিস্তরে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস (অষ্টক) অপেক্ষা দুটি ইলেকট্রন কম আছে। এরূপ দুটি অক্সিজেন পরমাণু কাছাকাছি এলে তাদের উভয় পরমাণুই নিষ্ক্রিয় গ্যাস এর মতো ইলেকট্রন বিন্যাস অর্জন করে অর্থাৎ সর্বশেষ শক্তিস্তরে 8 টি ইলেকট্রন গঠন করে। ফলে তাদের মধ্যে (O=O) সমযোজী বন্ধন গঠিত হয়।
এক্ষেত্রে উভয় পরমাণু দুটি করে মোট চারটি ইলেকট্রন শেয়ার করায় সমযোজী বন্ধনের সংখ্যা হয় 2 (দুই)। যেমনঃ
O + O → O = O বা O2
একই ধাতব পরমাণু দ্বারা গঠিত অণু তথা মৌলিক অণুসমূহের মধ্যে সমযোজী বন্ধন গঠন ছাড়াও একাধিক ভিন্ন অধাতব পরমাণু দ্বারা গঠিত যৌগিক অণুতেও সমযোজী বন্ধন দেখা যায়।
যেমনঃ পানির অনুতে অক্সিজেন পরমাণু তার সর্বশেষ শক্তিস্তরের একটি করে ইলেকট্রন প্রত্যেক হাইড্রোজেন পরমাণুর একটি করে ইলেকট্রনের সাথে শেয়ার করে। এভাবে (O – H) সমযোজী বন্ধন গঠনের মাধ্যমে পানির অণু গঠিত হয়।
H2O অণুতে O পরমাণুর 2 জোড়া ইলেকট্রন অর্থাৎ 4 টি ইলেকট্রন এখানে কোনো বন্ধন গঠন করে নি। কিন্তু প্রয়োজন হলে এই চারটি ইলেকট্রন বন্ধন গঠন করতে পারে।
O পরমাণু সমযোজী এবং আয়নিক উভয় প্রকার যৌগ গঠন করলেও Na পরমাণু কখনোই সমযোজী যৌগ গঠন করে না। Na পরমাণু সব সময় আয়নিক যৌগ গঠন করে। কারণ হিসেবে বলা যায়, O পরমাণু কোনো মৌল থেকে 2 টি গ্রহণ করলেও ঐ মৌলের সাথে সমযোজী বন্ধন তৈরি করতে পারে। Na পরমাণু সব সময় ইলেকট্রন ত্যাগ করে কোনো মৌলের সাথে আয়নিক বন্ধন তৈরি করে। কিন্তু Na পরমাণু কোনো মৌলের সাথেই ইলেকট্রন শেয়ার করে সমযোজী বন্ধন তৈরি করে না।
সমযোজী বন্ধনবিশিষ্ট মৌলিক পদার্থের অণুকে (যেমনঃ N2, O2, Cl2, Br2, I2) সমযোজী অণু এবং সমযোজী বন্ধনবিশিষ্ট যৌগকে সমযোজী যৌগ অণু বলা হয়। (যেমনঃ CH4, CO2, HCl, NH3 ইত্যাদি)।
অনেক সমযোজী অণু স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও চাপে গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। যেমনঃ CO2, NH3, O2, N2, Cl2 ইত্যাদি। আবার কিছু সমযোজী অণু স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও চাপে তরল অবস্থায় বিরাজ করে। যেমনঃ H2O (পানি), C2H5OH (ইথানল) ইত্যাদি এবং কিছু কঠিন অবস্থায় থাকে, যেমনঃ ন্যাপথালিন (C10H8), সালফার (S8), আয়োিডন (I2) ইত্যাদি।
দুটি সমযোজী অণু যখন খুবই নিকটবর্তী হয় তখন তাদের মধ্যে একধরনের দুর্বল আকর্ষণ বল কাজ করে, এই আকর্ষণ বলকেই ভ্যান্ডারওয়ালস আকর্ষণ বল বলে। সমযোজী অণুগুলো পরস্পরের সাথে এই দুর্বল ভ্যান্ডারওয়ালস আকর্ষণের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। তাই এদেরকে বিচ্ছিন্ন করতে সামান্য শক্তির প্রয়োজন হয়। ফলে এদের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক অনেক কম হয়।
আবার গ্যাসীয় সমযোজী অণুর মধ্যে (যেমনঃ CO2, NH3, O2 ইত্যাদি) ভ্যান্ডারওয়ালস আকর্ষণ বল নেই বললেই চলে, যার কারণে এরা একক অণু হিসেবে গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে।