রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু

আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, রাষ্ট্রই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয়। এদিক দিয়ে বলা যায়, রাষ্ট্রের কার্যাবলী যতদূর বিস্তৃত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু/পরিধি ততদূর বিস্তৃত ও প্রসারিত। রাষ্ট্র বা অন্য যা কিছু মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করে তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত বলে পরিগণিত হয়। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্র বা পরিধি অনেক ব্যাপক।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবীর মতে, “রাষ্ট্র, সরকার এবং আইন হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়।” অধ্যাপক বার্জেস আরও দুটি বিষয় সংযোগ করে বলেন যে, “স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচনার বিষয়বস্তু।”

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক গার্নার বলেন, “রাষ্ট্রকে নিয়েই রষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও সমাপ্তি।” (Political Science begins and ends with the state.) রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে আপন কক্ষপথে আবর্তন করে।

অধ্যাপক গেটেলের মতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রধানত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যথা:-

  • রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র এবং সংগঠনগুলোর বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করে;
  • অতীতে রাষ্ট্রের কার্যক্রম ও রূপ কি রকম ছিল তার পর্যালোচনা করে;
  • ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের কার্যক্রম কেমন হবে এবং কি রূপ লাভ করবে সে বিষয়ে আলোচনা করে।

 

গেটেল, লাস্কি প্রমুখ চিন্তাবিদগণ বাস্তব দৃষ্টিকোন থেকে স্বীকার করেন যে, রাষ্ট্র ও সরকার উভয়ই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়। সরকার ছাড়া রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না। আবার রাষ্ট্র ছাড়া সরকার চিন্তা করা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান একদিকে যেমন রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে অন্যদিকে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ও এর আলোচনার অন্তুর্ভুক্ত।

 

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র ও সরকার উভয়কে নিয়েই আলোচনা করে। রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও জন্ম ইতিহাস জানতে হলে সরকারের রূপ, প্রকৃতি ও জন্ম ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হয়। তাই বলা যায় রাষ্ট্র ও সরকার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিষ্টটল যথার্থই বলেছেন, ‘‘মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।’’ মানুষকে উন্নততর জীবন ব্যবস্থা দান করার লক্ষ্যেই রাষ্ট্র সক্রিয় থাকে। মানব জীবনের উপর রাষ্ট্রের প্রভাব সুদূর প্রসারী। অন্য কোন প্রতিষ্ঠানই অনুরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

মানব ইতিহাসের রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের সংগঠন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, নাগরিক অধিকার, শাসনতন্ত্রইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

 ইউনেস্কোর (UNESCO) অভিমত

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বা পরিধি সংক্রান্তবিতর্ক দূর করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (UNESCO) একটি সম্মেলনে আলোচনা করে এ অভিমত ব্যক্ত করে যে নিম্নলিখিত চারটি বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিৎ। যথা:-

  • রাষ্ট্রতত্ত্ব এবং এর ইতিহাস;
  • রাষ্ট্রের সংবিধান, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সরকার, প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসন প্রণালী এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের তুলনামূলক আলোচনা;
  • রাজনৈতিক দল, উপদল, শাসনকার্যে নাগরিকের অংশগ্রহণ ও জনমত;
  • আন্তর্জাতিক আইন ও আর্ন্তজাতিক সংস্থা।

 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্র ব্যাপক। রাষ্ট্রের আদর্শ ও উদ্দেশ্য, ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, সরকারের গঠন ও কার্যাবলী, নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পারিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে যুক্তি নির্ভর আলোচনা ও মতামত সবকিছুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনাসহ সমাজের নৈতিক সমস্যা সম্পর্কে আলোকপাত করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রীতি-নীতির মধ্যে গুণাগুণের বিচারে কোনগুলো কাম্য তার অনুসন্ধানও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাজ। সামাজিক সংগঠনগুলো কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তা আলোচনা করে থাকে। বিভিন্নরাজনৈতিক পদ্ধতিগুলোর তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে জনগণের অধিকতর কল্যাণ হবে তা নির্ধারণ করা যায়। অধ্যাপক রবসন যথার্থই বলেছেন,“It is concerned both with what it is and what it should be.” “রাষ্ট্রজ্ঞিান শুধু কি আছে তা নিয়ে ব্যস্তথাকেনা, কি হওয়া উচিৎ তাও আলোচনা করে।”

একথা সত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান শুধু রাষ্ট্র নিয়েই এর আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখে না। রাষ্ট্রের সদস্যদের আর্থ-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপাদানসমূহ যা তাদের কার্যাবলীকে প্রভাবিত করে তা নিয়েও পর্যালোচনা করে।

 

রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের উৎপত্তি, কার্যাবলী সংক্রান্তবিভিন্ন মতবাদ নিয়ে আলোচনা করে। বিভিন্ন সরকারী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন, সরকারী কাঠামো, সরকারী কর্মচারীদের কার্যাবলী ও দায়িত্বশীলতা, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া, আইনের শাসন, বিচার বিভাগ, বন্টন প্রক্রিয়া, নীতি, যুদ্ধ ও শান্তিপ্রভৃতি এ শাস্ত্রেগভীরভাবে বিশ্লেষিত হয়। সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, সাম্য, জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, গণতন্ত্র, ক্ষমতা, রাজনৈতিক আচরণ, রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের ধ্যানধারণা প্রভৃতি বিষয়গুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু।

 

শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।

Similar Posts