প্রাণিবিজ্ঞান

নিউক্লিয়াস কি, এর চিত্র ও গঠন এবং কাজ

1 min read

নিউক্লিয়াস কি

নিউক্লিয়াস হচ্ছে একটি আদর্শ কোষের দ্বিস্তরবিশিষ্ট অঙ্গাণু যা কোষের যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদন করে এবং প্রোটোপ্লাজমের অভ্যন্তরে অবস্থান করে প্রোটোপ্লাজমিক রস ও ক্রোমাটিন জালিকা ধারণ করে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন অর্কিড বা রাস্নার পত্রকোষ পর্যবেক্ষনের সময় সর্বপ্রথম ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন। রবার্ট ব্রাউন ল্যাটিন নাক্স (Nux যার অর্থ Nut) থেকে নিউক্লিয়াস নামটি দিয়ে থাকেন। একটি আদর্শ উদ্ভিদ কোষ বা প্রাণী কোষে একটি মাত্র নিউক্লিয়াস থাকে। তবে, আদি কোষে নিউক্লিয়াস হয় না। একটি কোষে শুধু যে একটি নিউক্লিয়াস থাকবে, তা নয়। পৃথিবীতে অনেক ধরণের শৈবাল ও ছত্রাকে প্রতি কোষে একাধিক নিউক্লিয়াস অবস্থান করে। একটি কোষে একাধিক নিউক্লিয়াস থাকার গাঠনিক প্রক্রিয়াকে সিনোসাইট বলা হয়। একটি প্রকৃত কোষে নিউক্লিয়াস কোষের মধ্যভাগে অবস্থান করে। নিউক্লিয়াস একটি কোষের ১০-১৫% জায়গা জুড়ে থাকে। তবে, মানবদেহের স্পার্ম বা শুক্রাণুতে শতকরা ৯০% নিউক্লিয়াস থাকে।

অন্যভাবে, ইউক্যারিউটিক কোষে অবস্থিত অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সর্বাপেক্ষা ঘন, গোলাকার যে অংশটি বংশগতি পদার্থ বহন করে ও সাইটোপ্লাজমের অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলি নিয়ন্ত্রণ করে তাকে নিউক্লিয়াস বলে।

আবিষ্কার (Discovery) : ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ফন্টানা নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন ও ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ব্রাউন-এর নিউক্লিয়াস নামকরণ করেন।

অবস্থান (Location) : সকল ইউক্যারিওটিক কোষে সুসংগঠিত নিউক্লিয়াস থাকে।

সংখ্যা (Number) : সাধারণত একটি কোষে একটি নিউক্লিয়াস থাকে। তবে কোন কোন কোষে এদের সংখ্যা ২-১০ পর্যন্ত হতে পারে।

আকৃতি (Shape) : এরা সাধারণত গোলাকার। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ডিম্বাকৃতি (oval) বা থলিকাকৃতির (vesicular) নিউক্লিয়াস দেখা যায়।

আয়তন (Size) : নিউক্লিয়াসের আয়তন DNA-এর পরিমাণের উপর নির্ভরশীল। তবে নিউক্লিয়াস সাধারণত ৫-৭ nm ব্যাসযুক্ত হয়ে থাকে।

উৎপত্তি (Origin) : একটি নিউক্লিয়াস বিভাজন পদ্ধতিতে সমগুণসম্পন্ন দুটো অপত্য নিউক্লিয়াসের সৃষ্টি করে।

নিউক্লিয়াস এর চিত্র ও গঠন

একটি আদর্শ নিউক্লিয়াসে চারটি অংশ থাকে ( যথা, ১। নিউক্লিয়াস এনভেলপ, ২। নিউক্লিয়োপ্লাজম, ৩। নিউক্লিয়োলাস, এবং ৪। নিউক্লিয়ার রেটিকুলাম বা ক্রোমাটিন তন্তু )। নিচে একটি নিউক্লিয়াস ও নিউক্লিয়াসের বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত করে দেখানো হল।

নিউক্লিয়াস এর চিত্র
নিউক্লিয়াস এর চিত্র

নিউক্লিয়াস দেখতে বৃত্তাকার হয়ে থাকে। তবে অনেক কোষে এর ব্যতিক্রম দেখতে মিলে (উপবৃত্তাকার, প্যাঁচানো, ইত্যাদি)। নিউক্লিয়াস কোষের আকার ও আয়তনে বড় অথবা ছোট হতে পারে। নিউক্লিয়াস সাধারণত দুটি স্তর বা মেমব্রেন দ্বারা আবৃত থাকে। নিউক্লিয়াসের এই আবরণীকে নিউক্লিয়ার এনভেলপ বলে। এই এনভেলপে বিশেষ ধরণের ছিদ্র থাকে যা নিউক্লিয়ার রন্ধ্র নামে পরিচিত। নিউক্লিয়ার এনভেলপ এর ভিতর আবরণীতে এক ধরণের স্বচ্ছ দানাদার পদার্থ থাকে, যাকে নিউক্লিয়োপ্লাজম বলা হয়। আবার, নিউক্লিয়াসে ভিতরে দিকে গোলাকার দানাদার পদার্থ দেখা যায়, এই পদার্থকেই নিউক্লিয়োলাস বলে। ক্রোমাটিন তন্তু নিউক্লিয়োলাসে জালিকার মতো ছড়িয়ে থাকে। নিউক্লিয়াসে ক্রোমাটিন তন্তু কোষ বিভাজনের সময় কুণ্ডলী আকার ধারণ করে ধীরে ধীরে মোটা ও খাটো হয়ে পৃথক হতে থাকে। ক্রোমাটিন তন্তুর এই পৃথক অবস্থাকে ক্রোমোসোম বলে

ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ইন্টারফেজ দশায় একটি সুস্থিত নিউক্লিয়াসে প্রাপ্ত বিভিন্ন অংশ নিয়ে বর্ণিত হল।

ক. নিউক্লিয়াস পর্দা (Nuclear membrane)

দ্বিস্তরী সজীব, সূক্ষ্ম ও অর্ধভেদ্য যে আবরণী নিউক্লিয়প্লাজমকে পরিবেষ্টিত করে তাকে নিউক্লিও পর্দা বলে। এই দ্বিস্তরী পর্দার প্রতিটি স্তর ৭০ ৮০Å পুরু। নিউক্লিয়ার আবরণীর দুটো স্তরের মধ্যবর্তী তরল পদার্থপূর্ণ স্থানকে পেরিনিউক্লিয়ার স্থান (Perinuclear space) বলে। এই স্থানটি প্রায় ১০-১৫ nm চওড়া। নিউক্লিয়ার আবরণীর বহিঃস্তর নানা স্থানে এন্ডোপ্লাজমিক জালিকার সাথে যুক্ত থাকে। নিউক্লিয়ার পর্দার কয়েকটি স্থানে ছিদ্র থাকে। এই সব ছিদ্রকে নিউক্লিয় ছিদ্র (nuclear pore) বলে যাদের ব্যাস প্রায় ৪০০ ৭০০। রাসায়নিক উপাদান হিসেবে নিউক্লিয় আবরণীতে প্রোটিন, ফসফোলিপিড, DNA ও RNA থাকে। এছাড়া নিউক্লিয়ার পর্দায় বিভিন্ন ধরনের এনজাইম থাকে।

নিউক্লিয়াস পর্দার কাজ

  • ১. নিউক্লিয় আবরণী সাইটোপ্লাজম ও নিউক্লিওপ্লাজমকে পৃথক করে।
  • ২. নিউক্লিয়াসের আকৃতি দান করে।
  • ৩. নিউক্লিয় রন্ধ্র পথে নিউক্লিয় ও সাইটোপ্লাজমের মধ্যে বিভিন্ন বস্তু যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করে।
  • 8. mRNA প্রোটিন সংশ্লেষণের উদ্দেশ্য নিউক্লিয় রন্ধ্র পথে বেরিয়ে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে প্রবেশ করে।
  • ৫. এই পর্দা কয়েক প্রকার জৈব অণু ও অজৈব আয়নের চলাচলে সহায়তা করে।

 খ. নিউক্লিওপ্লাজম (Nucleoplasm)

নিউক্লিয়ার আবরণী দ্বারা আবৃত স্বচ্ছ, সমসত্ত্ব, অর্ধতরল ও দানাদার ধাত্র বস্তুকে নিউক্লিওপ্লাজম বলা হয়। ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে নিউক্লিওপ্লাজমে আন্তঃক্রোমোটিন ম্যাট্রিক্স এবং ইন্টারক্রোমোটিন দানা দেখা যায়। এছাড়াও নিউক্লিওপ্লাজমে ক্রোমাটিন তন্ত্র ও নিউক্লিওলাস থাকে। রাসায়নিক গঠনের দিক থেকে দেখা যায় নিউক্লিওপ্লাজমের DNA, RNA, ক্ষারীয় প্রোটিন, অম্লীয় প্রোটিন, বিভিন্ন ধরনের এনজাইম ও খনিজ পদার্থ থাকে।

নিউক্লিওপ্লাজমের কাজ

  • ১. নিউক্লিওপ্লাজম RNA ও DNA প্রতিলিপি গঠনে সহায়তা করে।
  • ২. নিউক্লিওলাস ও ক্রোমাটিন বজ্র ধারণ করে।
  • ৩. নিউক্লিওপ্লাজম বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্রিয়াস্থল হিসেবে কাজ করে।
  • ৪. প্রোটিন জাতীয় পদার্থ তৈরি করে।
  • ৫. কোষ বিভাজনে নিউক্লিওপ্লামের ভূমিকা রয়েছে।

গ. নিউক্লিওলাস (Nucleolus)

নিউক্লিওপ্লাজমে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল, গোলাকার, ঘন ও RNA সমৃদ্ধ গঠনটিকে নিউক্লিওলাস বলা হয়। এটা একটি বিশেষ ক্রোমোজোম খণ্ডের সাথে যুক্ত থাকে। যে ক্রোমোজোম খণ্ডের সাথে নিউক্লিওলাস যুক্ত থাকে তাকে নিউক্লিওলাস অর্গানাইজার বলে। ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে নিউক্লিওলাসের দানাময় ও তন্ত্রময় এ দু’ধরনের গঠন দেখা যায়। সাধারণত কোষে একটি মাত্র নিউক্লিওলাস থাকে। কোষ চক্রের ইন্টারফেজ দশায় নিউক্লিওলাসকে স্পষ্ট দেখা যায় ও কোষ বিভাজন দশাগুলিতে এটা অদৃশ্য থাকে। রাসায়নিক দিক থেকে এর মুখ্য উপাদান RNA এবং প্রোটিন এছাড়া তন্ত্রময় গঠন বস্তুতে DNA থাকে।

নিউক্লিওলাসের কাজ

  • ১. নিউক্লিওলাসে প্রাক রাইবোজমীয় RNA সংশ্লেষিত হয়।
  • ২. এটাতে প্রোটিন ও রাইবোজোম সংশ্লেষণ হয়।
  • ৩. এখানে RNA সংরক্ষিত থাকে।
  • ৪. কোষ বিভাজনে নিউক্লিওলাসের ভূমিকা থাকতে পারে।

ঘ. ক্রোমাটিন তন্তু (Chromatin fibers)

নিউক্লিওপ্লাজমে বিদ্যমান দীর্ঘ সুতার মত প্যাঁচানো ও জালিকার ন্যায় অংশকে ক্রোমাটিন তন্ত্র বলে। ইন্টারফেজ দশায় ক্রোমাটিন তন্ত্রকে সূত্রাকারে নিউক্লিয়াসে ছড়ানো থাকতে দেখা যায়। পক্ষান্তরে কোষ বিভাজনকালে ক্রোমাটিন তন্তু মোটা হয়ে পুরু গঠন লাভ করে তখন এগুলিকে ক্রোমোজোম বলে। ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ক্রোমাটিনকে পুঁতির মালার মত দেখায়। এসব পুঁতির মত দানাগুলিকে নিউক্লিওসোম নামে অভিহিত করা হয়। নিউক্লিওসোমকে প্রকৃতপক্ষে ক্রোমাটিন তন্ত্রর একক বলা হয়। ক্রোমাটিন তন্ত্রকে বংশগতি পদাৰ্থ রৈখিক অনুক্রমে বিন্যস্ত থাকে। যেসব ক্রোমাটিন নিউক্লিয়ার পর্দার আন্তঃপ্তর সংলগ্ন ও ঘনসংঘবদ্ধভাবে থাকে এবং রঞ্জক পদার্থে তীব্রভাবে রঞ্জিত হয় তাদেরকে হেটেরোক্রোমাটিন বলে। পক্ষান্তরে নিউক্লিওপ্লাজমে বিক্ষিপ্তভাবে থাকা হালকা রঙে রঞ্জিত ক্রোমাটিন তম্ভগুলিকে ইউক্রোমাটিন বলে। প্রকৃত পক্ষে ইউক্রোমাটিন বংশগতির ক্ষেত্রে সক্রিয় DNA ধারণ করে। রাসায়নিক দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় ক্রোমাটিন তন্তুতে DNA, হিস্টোন ও ননহিস্টোন প্রোটিন থাকে। নিউক্লিওসোমের পৃষ্ঠে DNA সূত্র প্রায় ২ প্যাচসম্পন্ন করে বেরিয়ে অপর নিউক্লিওসোম থেকে বেরিয়ে আসা সূত্রের সঙ্গে মিলিত হয়। এভাবে ক্রমশ লম্বা ক্রোমাটিন সূত্রের সৃষ্টি করে।

ক্রোমাটিন তন্তুর কাজ

  • ১. কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমাটিন ক্রোমোজোমে পরিণত হয়।
  • ২. বংশগতির পদার্থ DNA ধারণ করে।
  • ৩. ক্রোমাটিন অর্থাৎ ক্রোমোজোমের মাধ্যমে বংশগতি পদার্থ DNA পরবর্তী অণুতে সঞ্চারিত হয়।

নিউক্লিয়াসের প্রধান কয়েকটি কাজ

  • কোষের পুষ্টি, জনন ও রেচনে অংশগ্রহণ করা।
  • সাইটোপ্লাজমের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে অভ্যন্তরীণ উপাদান যোগান দেওয়া।
  • কোষে প্রোটিন (ক্ষারীয় ও অম্লীয়), এনজাইম, কো-এনজাইম, অ্যাসিটাইল কো-এ যোগান দেওয়া ও সংরক্ষন করা।
  • কোষের RNA সংশ্লেষন করা।
  • কোষের বংশ বিস্তার, মিউটেশন, ও প্রকরন সৃষ্টি করা।
  • কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করা।

নিউক্লিয়াসকে কোষের প্রাণকেন্দ্র বা মস্তিষ্ক বা কেন্দ্রিকা বলা হয় কেন

নিউক্লয়াসকে একত্রে একটি কোষের প্রাণকেন্দ্র, কোষের মস্তিষ্ক, এবং কোষের কেন্দ্রিকা বলা হয়ে থাকে। কারণ, একটি কোষের যাবতীয় কার্যাবলী এবং সবধরনের জৈবিক কাজ ঐ কোষে অবস্থিত নিউক্লিয়াস দ্বারাই সম্পাদিত হয়। নিউক্লিয়াস পুষ্টি ও জননের উপাদান যোগান দেওয়ার মাধ্যমেই কোষকে প্রানবন্ত ও সজীব রাখে, তাই নিউক্লিয়াসকে কোষের প্রাণকেন্দ্র বলা হয়। আবার, নিউক্লিয়াস একটি কোষের এনজাইম, কো-এনজাইম, লিপিড এবং হরমোন সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রন রাখে, যার জন্য নিউকিয়াসকে কোষের মস্তিষ্ক বলা হয়। নিউক্লিয়াস কোষের মাঝখানে অবস্থান করে কোষকে সঠিকভাবে কার্যাবলী সম্পাদন করে বলে, নিউক্লিয়াসকে কোষের কেন্দ্রীকাও বলা হয়।

Rate this post
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x