কর্তব্য কী এবং কর্তব্য কত প্রকার ও কী কী | ব্যাখ্যাসহ আলোচনা

কর্তব্য কী

কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা নীতিবিদ্যার একটি অন্যতম বিষয়। সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্য একাধিক ব্যক্তির প্রয়োজন পড়ে। প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মোপলব্ধির জন্য কতকগুলো নৈতিক অধিকার আছে। আর এ অধিকারসমূহ যাতে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হয় সেদিকে লক্ষ রাখাও তার কর্তব্য।

কর্তব্য কাকে বলে

কর্তব্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে উইলিয়াম লিলি (Wiliam Lilly) বলেন, “জনকল্যাণের স্বার্থে কোন সম্প্রদায় বা সম্প্রদায়ের বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ অন্য কোন ব্যক্তির কাছে যা দাবি করে সেই দাবি মিটাবার বাধ্যতাবোধই হলো কর্তব্য।

মানুষ শুধু সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে অধিকার লাভ করেই ক্ষান্ত থাকতে পারে না, যথার্থ মানবোচিত জীবনযাপনের জন্য অধিকার লাভের সাথে সাথে সমাজ বা রাষ্ট্রের অপরাপর ব্যক্তির প্রতি তার কতকগুলো নৈতিক কর্তব্য রয়েছে, সেগুলোকে সে অস্বীকার করতে পারে না। অধিকার যেমন সমাজস্থ মানুষের সঙ্গে জড়িত, তেমনি কর্তব্যও সমাজস্থ মানুষের সঙ্গে জড়িত। আমরা যেসব নৈতিক অধিকার ভোগ করি সেই অধিকারগুলোই পরোক্ষভাবে আমাদের উপর কর্তব্য চাপিয়ে দেয়। আমার বাঁচার অধিকার যেমন আমার কাছে খুবই প্রয়োজনীয়, তেমনি আমার মতো অন্য ব্যক্তিও যাতে বাঁচতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখাও আমার এক মৌলিক কর্তব্য। তাই দেখা যায় যাদেরকে আমরা অধিকার বলে মনে করি তারাই বহন করে নিয়ে আসে কতকগুলো কর্তব্য।

সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের জন্য প্রযোজ্য। সমাজে মানুষকে বসবাস করতে হলে নৈতিক অধিকারের যেমন প্রয়োজন আছে, ঠিক তেমনি অধিকার সংরক্ষণ করাও মানুষের কর্তব্য। তাই বলা যায়, কর্তব্য সম্পর্কে মানুষ সচেতন না থাকলে সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়।

কর্তব্য কত প্রকার ও কী কী

মানুষ সামাজিক জীব। নীতিবিদ্যা মানুষের আচরণ সম্পর্কীয় বিজ্ঞান। নীতিবিদ্যায় দর্শনের বিভিন্ন শাখা নিয়ে আলোচনা করা হয়। কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা নীতিবিদ্যার একটি অন্যতম বিষয়। সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্য একাধিক ব্যক্তির প্রয়োজন পড়ে। প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মোপলব্ধির জন্য কতকগুলো নৈতিক অধিকার আছে। এ অধিকারগুলো যাতে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হয় সেদিকে লক্ষ রাখাও তার কর্তব্য।

কর্তব্যের শ্রেণিবিভাগ

কর্তব্য প্রধানত তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা
ক. আত্মকেন্দ্রিক কর্তব্য,
খ. পরকেন্দ্রিক কর্তব্য ও
গ. খোদায়ী কর্তব্য।

নিম্নে এ তিন শ্রেণির কর্তব্যের আলোচনা করা হলো।

ক. আত্মকেন্দ্রিক কর্তব্য (Duties of self-Central)

মানুষের নিজের প্রতি নিজের বিভিন্ন ধরনের কর্তব্য রয়েছে। যথা : ১. দৈহিক কর্তব্য, ২. অর্থনৈতিক কর্তব্য, ৩. জ্ঞানমূলক কর্তব্য, ৪. সৌন্দর্যমূলক কর্তব্য এবং ৫. নৈতিক কর্তব্য।

১. দৈহিক কর্তব্য : দেহধারী মানুষের দেহের প্রতি কতকগুলো কর্তব্য আছে। যেমন- আত্মত্মসংরক্ষণ, স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়া, বিশ্রাম, আমোদ-প্রমোদ ইত্যাদি।

২. অর্থনৈতিক কর্তব্য : মানুষের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তার দৈহিক ও মানসিক উন্নতির সহায়ক। মানুষকে অর্থ উপার্জন করতে হবে। কেননা অর্থের মাধ্যমে মানুষ অন্যান্য মূল্যবোধ উপলব্ধির পথে সহায়তা লাভ করে।

৩. জ্ঞানমূলক কর্তব্য : ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশ সাধনের জন্য বুদ্ধির অনুশীলন প্রয়োজন। বুদ্ধির বিকাশ সাধন করে জ্ঞান আহরণ করে আমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন করতে হবে।

৪. সৌন্দর্যমূলক কর্তব্য : মানুষের উচিত তার চেতনাকে শানিত করে অনুভূতিকে তীব্রতর করা। সৌন্দর্য সৃষ্টি করার জন্য সৌন্দর্যানুভূতি অনুশীলন করতে হবে।

৫. নৈতিক কর্তব্য : প্রবৃত্তি কামনা-বাসনাকে বিচারবুদ্ধির নিয়ন্ত্রণাধীন করে বুদ্ধিময় সত্তাকে উপলব্ধি করা মানুষের নৈতিক কর্তব্য।

খ. পরকেন্দ্রিক কর্তব্য (Duties to other)

মানুষের পরকেন্দ্রিক কিছু কর্তব্য আছে। পরকেন্দ্রিক কর্তব্যগুলো হলো :
১. পরিবারের প্রতি কর্তব্য,
২. সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির প্রতি কর্তব্য,
৩. দেশের প্রতি কর্তব্য,
৪. বিশ্বমানবের প্রতি কর্তব্য এবং
৫. উদ্ভিদ এবং পশুর প্রতি কর্তব্য।

১. পরিবারের প্রতি কর্তব্য : পরিবারের ছেলেমেয়েদের উচিত মাতাপিতাকে শ্রদ্ধা করা, তাদের নির্দেশ পালন করা, অসহায় অবস্থায় তাদের সেবাযত্ন করা। আবার মাতাপিতার কর্তব্য হলো সন্তানসন্ততির শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চরিত্র গঠনের দিকে খেয়াল রাখা। এগুলো আমাদের একটি পরিবারের কর্তব্য।

২. সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির প্রতি কর্তব্য : এ জাতীয় কর্তব্য তিন ধরনের সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণতা এবং পরহিতৈষণা। সকলের সুখে সুখী হওয়া এবং সকলের দুঃখে দুঃখ অনুভব করা সমাজ জীবনের আদর্শ।

৩. দেশের প্রতি কর্তব্য : দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের উন্নতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা, আক্রমণ হতে দেশকে রক্ষা করা, দেশের প্রতিটি মানুষকে আপনার স্বজন বলে মনে করা এবং তাদের উপকার করা আমাদের কর্তব্য।

৪. বিশ্বমানের প্রতি কর্তব্য : বিশ্বের সব মানুষকে খোলার বান্দা মনে করে অবহেলিত, নিষ্পেষিত, মজলুম মানুষের জন্য সংগ্রাম করাই মনুষ্যত্ব। বিশ্বমানবতার জন্য কাজ করে যাওয়াটা আমাদের মানবীয় কর্তব্য।

৫. উদ্ভিদ ও পশুর প্রতি কর্তব্য : উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও পশুপালন আমাদের কর্তব্য। গৃহপালিত পশুর সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য এদের প্রতি যত্ন নেওয়া, চিকিৎসা করা, পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করা আমাদের কর্তব্য।

গ. খোদায়ী কর্তব্য

বিশ্বের সব সৌন্দর্য, সব চেতন ও সব প্রেমের উৎস হিসেবে খোদাকে উপলব্ধি করা মানবজীবনের পরম কর্তব্য। সবার মাঝে, সবার সাথে যে পরম প্রেমিক খোদার যোগসূত্র আছে তা উপলব্ধি করাই মানবজীবনের কর্তব্য।

সবশেষে আমরা বলতে পারি যে, কর্তব্য হচ্ছে মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কর্তব্যবোধ না থাকলে সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়। কর্তব্যের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তা সমাজ জীবনের উন্নতির পথে সাহায্য করে, তাই বলা চলে কর্তব্য সম্পর্কে মানুষ সচেতন না থাকলে সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়।

Similar Posts