হুদায়বিয়ার সন্ধি কি, এর লেখক, ধারা বা শর্তাবলি ও গুরুত্ব

৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে কুরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পাদিত হুদায়বিয়ার সন্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ সন্ধিতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, ইসলামের প্রতি অবিচল আস্থা, শান্তির প্রতি একাগ্রতা, সর্বোপরি মানবীয় মহান গুণাবলির বিকাশ লক্ষ করা যায়। হুদায়বিয়া নামক স্থানে এ সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় বলে এ সন্ধির নাম হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে খ্যাত।

হুদায়বিয়ার সন্ধি কি

ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে মাতৃভূমি দর্শন এবং উমরাহ ব্রত পালন করার উদ্দেশ্যে মহানবী ১,৪০০ সাহাবিসহ মদিনা থেকে মক্কার দিকে যাত্রা করেন। মহানবীর আগমনের কথা শুনে কুরাইশরা ভীত হয়ে খালিদ ও ইকরামার নেতৃত্বে বাধা দেওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। কুরাইশদের বাধা দেওয়ার পরিকল্পনার কথা শুনে মহানবী (সা.) মক্কা থেকে এক মাইল দূরে হুদায়বিয়া নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন এবং প্রকৃত উদ্দেশ্য জানার জন্য ওসমানকে দূত হিসেবে পাঠান। কিন্তু কুরাইশরা ওসমান (রা) কে আটক করে রাখে। এদিকে জনরব ওঠে যে, কুরাইশরা ওসমান (রা) কে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। ফলে মুসলিম যোদ্ধাগণ মহানবী (সা.) এর হাতে হাত রেখে দীপ্ত কন্ঠে শপথ গ্রহণ করেন যে, তাদের দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তারা হযরত ওসমান (রা) আঘাতের প্রতিশোধ নেবেন এবং মক্কায় হজ পালন না করে ফিরে যাবেন না। মুসলমানদের এ দৃঢ় শপথের কথা শুনে কুরাইশরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং ওসমান (রা) কে ছেড়ে দিয়ে সুহাইল বিন আমরকে মুসলমানদের সাথে শান্তি আলোচনার জন্য প্রেরণ করে। ফলে হুদায়বিয়ায় মুসলমানদের সাথে কুরাইশদের একটি সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এটাই বিখ্যাত হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত।

হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক কে

হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক হচ্ছেন হযরত আলী (রা)। অন্যান্য সাহাবীগনও হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখনীতে ছিলেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আমর ইবনুল আস ইসলাম গ্রহণ করেন।

হুদায়বিয়ার সন্ধির ধারা বা শর্তাবলি

হুদায়বিয়া প্রান্তরে মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে যেসব শর্তে চুক্তি সম্পাদিত হয়, তা হলো।

১. ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানগণ হজ সম্পাদন না করেই মদিনায় প্রত্যাবর্তন করবেন।

২. মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে আগামী ১০ বছর যে কোনোপ্রকার যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ থাকবে।

৩. মুসলমানগণ পরের বছর (৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে) হজ্ব পালন করতে আসতে পারবে।

৪. যদি মুসলমানগণ ইচ্ছা করেন তাহলে তিন দিনের জন্য পরের বছর মক্কায় হজ পালনের উদ্দেশ্যে আগমন করতে পারবেন। মুসলমানদের অবস্থানকালে কুরাইশগণ মক্কা ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করবেন।

৫. মক্কায় আগমনকালে মুসলমানগণ শুধু আত্মরক্ষার জন্য কোষবদ্ধ তরবারি ছাড়া অন্য কোনো মারণাস্ত্র সাথে আনতে পারবেন না।

৬. আরবের যে কোনো গোত্রের লোকের সাথে কুরাইশও মুসলমানদের সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ থেকে কোনো বাধানিষেধ থাকবে না।

৭. চুক্তির মেয়াদকালে জনসাধারণের পূর্ণ নিরাপত্তা রক্ষিত হবে এবং একে অপরের ক্ষতিসাধন করবে না। কোনোপ্রকার লুণ্ঠন অথবা আক্রমণ চলবে না।

৮. কোনো মক্কাবাসী মদিনায় আশ্রয় গ্রহণ করলে মদিনার মুসলমানগণ তাকে আশ্রয় দিতে পারবে না। অন্যদিকে কোনো মুসলিম মদিনা থেকে মক্কায় আগমন করলে মক্কাবাসী তাকে প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য থাকবে না।

৯. হজের সময় মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। মক্কা ও মদিনার মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুবিধা থাকবে।

১০. মক্কার কোনো নাবালক তাঁর অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মুসলমানদের দলে যোগদান করতে পারবে না।

১১. সন্ধির শর্তাবলি উভয় পক্ষকে পরিপূর্ণভাবে পালন করতে হবে।

হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব

নিম্নে হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

ক. সুস্পষ্ট বিজয় : মহান প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তায়ালা হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তিকে ‘সুস্পষ্ট বিজয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটি একটি অবমাননাকর সন্ধিচুক্তি মনে হলেও এ সন্ধিই বিশ্বব্যাপী দিন ইসলামের প্রচার প্রসার এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে দিনকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।

খ. রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় মর্যাদা বৃদ্ধি : এ সন্ধির ফলে মুসলমানরা প্রথমবারের মতো কুরাইশদের কাছ থেকে একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় রাজনৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে লিখিতভাবে স্বীকৃতি পায়।

গ. শান্তি প্রতিষ্ঠা : আপাতত যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ হওয়ায় মুসলমানগণ নিশ্চিতভাবে বসবাসের সুযোগ লাভ করে।

ঘ. ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতি : ইসলামের বিস্তৃতি ও প্রসারতার ক্ষেত্রে ফ্রেটি সন্ধির গুরুত্ব অপরিসীম। এ সন্ধির শর্তানুযায়ী মহানবী (সা.) এর সাথে বিভিন্ন গোত্রের লোকের ইসলাম গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

আলোচনার শেষান্তে বলা যায় যে, হুদায়বিয়া নামক স্থানে কুরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ চুক্তির ফল স্বল্পকাল স্থায়ী হলেও মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়েছিল।

Similar Posts