একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত কি কি

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সেদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভৃতি অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত যেদেশে অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকে সেদেশের উন্নয়ন দ্রুত হয়। কারণ বিভিন্ন শর্ত একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়। যেমন লাগসই শিক্ষাব্যবস্থা না থাকলে কারিগরি উন্নতি কম হবে, যা আবার কম বিনিয়োগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

একটি দেশের উন্নয়নের ১৬ টি পূর্বশর্ত

নিম্নে একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্তগুলো বর্ণনা করা হলো।

১. সহজলভ্য প্রাকৃতিক সম্পদ

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সহজলভ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলে উৎপাদন বাড়ে না, উন্নয়নও হয় না (যেমন- উত্তর মেরু বা দক্ষিণ মেরু, সাহারা বা গোবি অঞ্চল)। প্রাকৃতিক সম্পদই মূল উপকরণ। এরাই উৎপাদনের ভিত্তি। প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া কেউ এত বেশি উন্নত হতে পারত না।

২. মূলধন সংগ্রহ

উন্নয়নের মূল কথা মূলধন সংগ্রহ। উপকরণকে সঠিকভাবে পরিবর্তিত করে শ্রম। কিন্তু শুধু হাতে সে কাজ করে না। অনেক নিপুণ যন্ত্রপাতির সাহায্য দরকার হয়। এ ধরনের মূলধন না থাকলে উৎপাদন কম হয়।

৩. দক্ষ জনশক্তি

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কেবল প্রাকৃতিক সম্পদই যথেষ্ট নয়; সব প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। দেশের জনশক্তি দক্ষ হলে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভবপর হবে।

৪. প্রযুক্তিগত উন্নতি

উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহারের ফলে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায় এবং উৎপাদনের পরিমাণগত ও গুণগতমান বৃদ্ধি পায়। সুতরাং সমাজে বিদ্যমান প্রযুক্তিগত স্তরের ওপর উন্নয়নের হার নির্ভরশীল।

৫. দক্ষ উদ্যোক্তা শ্রেণি

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দক্ষ উদ্যোক্সা শ্রেণি উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল ভূমিকা পালন করে। অর্থনীতিবিদ সুম্পিটারের মতে, আধুনিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় উদ্যোক্তা শ্রেণির ভূমিকা সর্বাধিক।

৬. অবকাঠামোগত অবস্থা

কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রারম্ভেই প্রয়োজন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে সহজেই শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়ন হবে এবং ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়ঃনিষ্কাশন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমেই উন্নয়ন সম্ভব। তাই উন্নত অবকাঠামোই পারে উন্নত অর্থনীতির ভিত্তির সূচনা করতে।

৭. জনসংখ্যার প্রভাব

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশে জনাধিক্য থাকবে না। জনসংখ্যা কাম্য স্তরে থাকা উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত । যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অর্থনৈতিক হার বেশি হয় তবে উন্নয়ন অর্জন সম্ভব।

৮. আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি

দেশের উন্নয়নে বলিষ্ঠ কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের যথোপযুক্ত উপস্থিতি থাকা বাঞ্ছনীয়। এরূপ আর্থিক প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত মূলধন সরবরাহ করতে পারে। এছাড়া ব্যবসা বাণিজ্য সহজসাধ্য করতে এরূপ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই উন্নয়নের প্রয়োজনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উপস্থিতি একান্তভাবে প্রয়োজন।

৯. শিক্ষাবিস্তার

শিক্ষা অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ জনসাধারণ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের সক্রিয় সহযোগিতা পাওয়া যায় না। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে হলে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার একান্ত প্রয়োজন। এর ফলে জনগণের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং এদেশের উন্নয়নে নিজস্ব ভূমিকা সম্বন্ধে তারা সচেতন হয়ে ওঠে।

১০. প্রতিযোগিতামূলক বাজার

প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অস্তিত্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য থাকলে উৎপাদন হ্রাস করে বেশি দামে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান পূর্ণ দক্ষতায় কাজ করে না। বাজারে প্রতিযোগিতা থাকলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং সম্পদের পূর্ণ নিয়োগ লাভের পথ সুগম হয়। এতে দেশের কর্মনিয়োগ স্তর ও জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়।

১১. বৈদেশিক মুদ্রার প্রভাব

দেশে প্রয়োজনীয় শিল্প স্থাপনের জন্য বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি এবং কলাকৌশল আমদানি করতে হয়। কিন্তু রপ্তানি বাণিজ্য শক্তিশালী না হওয়ায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার অভাব রয়েছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

১২. বিশেষায়ন

শ্রমবিভাগের মাধ্যমে বিশেষায়ন সম্ভবপর হয় এবং এর ফলে শ্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। বৃহদায়তন উৎপাদনে শ্রম বিভাজন সম্ভবপর হয়। বিশেষায়ন ও বৃহদায়তন উৎপাদনে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক।

১৩. জনগণের আগ্রহ

অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য জনগণের চেষ্টা ও আগ্রহের একান্ত প্রয়োজন। উন্নয়নের ভার নিয়তির ওপর ছেড়ে দিলে সমাজে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে না।

১৪. প্রশাসনিক দক্ষতা

সম্পদ বা মূলধন থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে এমন কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ মূলধন অথবা সম্পদের বণ্টন হতে হবে। দক্ষ বণ্টন ব্যবস্থা থাকলে নিয়োগ, জাতীয় আয় ইত্যাদি দ্রুত বাড়বে। এর জন্য দরকার দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা। দক্ষ প্রশাসন আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। ফলে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুত হতে পারে।

১৫. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একান্ত আবশ্যক। গণতান্ত্রিক সরকার অথবা জনগণের সমর্থনে যেকোনো সরকার রাষ্ট্রপরিচালনায় নিয়োজিত থাকলে রাজনৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা বিদ্যমান থাকে। এ অবস্থায় শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যে দ্রুত উন্নতি সাধন সম্ভবপর হয়ে ওঠে। বিদেশি অশুভ চক্র কোনোরূপ ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। সামগ্রিক অর্থে অর্থনীতি উন্নয়নের পথ ধরে এগোতে পারে।

১৬. জাতীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকা

কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা নিতান্ত অপরিহার্য। জাতীয় নেতৃবৃন্দ যেমনঃ সমাজের রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ডাক্তার, প্রকৌশলী যদি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে অর্থনীতিতে উন্নয়নের পথ অনেকটা প্রশস্ত হবে।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এমন একটি জটিল ও ব্যাপক প্রক্রিয়া যা অর্থনৈতিক উপাদান ছাড়াও বহুমুখী সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। ওপরে বর্ণিত কোনো শর্ত এককভাবে দ্রুত উন্নয়নের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে না। কারণ বিভিন্ন শর্ত একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়।