আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ

আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ কি এবং কাকে বলে

আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ বলতে কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বছরের ব্যবসায়িক কার্যকলাপের সামগ্রিক ফলাফল প্রকাশের জন্য বছরের শেষে প্রণীত বিবরণীসমূহের বিশদ ও সমালোচনামূলক পরীক্ষা করাকে বুঝায়।

আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ এর সংজ্ঞা

আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণের সংজ্ঞা নিম্নরূপ :
I.M. Pandey, “Financial analysis is the process of identifying the financial strengths and weakness of the firm by properly establishing relationships between the items of the balance sheet and the profit and loss account.”

অর্থাৎ, আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী অর্থাৎ উদ্বৃত্তপত্র এবং লাভ-ক্ষতি হিসাবের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সঠিকভাবে সম্পর্ক নির্ণয়ের মাধ্যমে এর আর্থিক সবলতা ও দুর্বলতা খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া।

Leopold. A. Bernstein এর মতে, “The process of financial statement analysis consist of the application of analytical tools and technique of financial statements and data in order to derive from their measurement and relationship that are significant and useful for decision making.” অর্থাৎ, আর্থিক বিশ্লেষণ বলতে বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশলের প্রয়োগকে বুঝায় যার মাধ্যমে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিভিন্ন আর্থিক প্রতিবেদন ও তথ্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পরিমাপক সম্পর্কসমূহ বের করা যায়।

Myer এর মতে, “Financial statement analysis is largely a study of the relationship among the various financial factors in a business by a single of statements and a study of the trend of these factors as shown in a service of statements.”

Kenedy and memullar এর মতে, “আর্থিক বিবরণীর উপাত্তের তাৎপর্য ও অর্থ নিরূপণের প্রচেষ্টাই হলো আর্থিক বিবরণীর বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা যাতে ভবিষ্যৎ উপার্জনের সম্ভাবনা, সুদ এবং ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য এবং সুষ্ঠু লভ্যাংশ নীতির সম্ভাবনা সম্পর্কে পূর্বানুমান করা যায়।”

সুতরাং বলা যায় যে, আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ হলো আর্থিক বিবরণীসমূহের বিভিন্ন বিষয়ের (Items) মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সবলতা ও দুর্বলতা নির্ণয় করার একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি কারবারের সমগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়।

আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণের ব্যবহারকারী কারা

ব্যবসায়ের সাথে জড়িত বিভিন্ন পক্ষসমূহ একটি প্রতিষ্ঠানের তারল্য, সচ্ছলতা, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা, মুনাফালভ্যতা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়। আর্থিক বিশ্লেষণের ব্যবহারকারীরা নিজ নিজ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য এটি ব্যবহার করে থাকে। আর্থিক বিশ্লেষণের প্রধান প্রধান ব্যবহারকারীদের বর্ণনা নিয়ে দেওয়া হলো।

১. শেয়ারহোল্ডার : শেয়ারহোল্ডারগণ কোম্পানির মালিক। তারা কোম্পানির সারা বছরের আর্থিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়। বিনিয়োগের উপর আয়ের অনুপাত, মোট মুনাফার অনুপাত, নিট মুনাফার অনুপাত, শেয়ার প্রতি আয়, প্রাইস আর্নিং অনুপাত ইত্যাদি সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে কিনা তা শেয়ারহোল্ডাররা জানতে চায়। এগুলো জেনে তারা ব্যবস্থাপনাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকে। আর্থিক বিশ্লেষণের ফলাফলের ভিত্তিতে তারা বিনিয়োগ ধরে রাখবে কিনা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

২. ঋণপত্রের মালিক : অনেক সময় প্রতিষ্ঠানসমূহ ঋণপত্র বিক্রি করে অর্থসংস্থান করে থাকে। মূলত লাভজনক বিনিয়োগ সুবিধা গ্রহণ কিংবা আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিষ্ঠানসমূহ ঋণপত্র বিক্রি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য আছে কিনা, কোম্পানি আর্থিকভাবে সচ্ছল কিনা এসব বিষয়ে জানার জন্য ঋণপত্রের মালিকগণ আর্থিক বিশ্লেষণের সাহায্য নিয়ে থাকে।

৩. ব্যবস্থাপক : ব্যবস্থাপকগণ কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। বিভিন্ন বিভাগের দক্ষতা ও দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করার জন্য আর্থিক বিশ্লেষণের সাহায্য নিতে হয়। কারবারের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণেরও আর্থিক বিশ্লেষণের সাহায্য প্রয়োজন হয়।

৪. আর্থিক প্রতিষ্ঠান : ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখে হয়, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানসমূহ কোম্পানির ঋণ ব্যবহারের এবং ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য যাচাই করে তাকে কাজে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ আর্থিক বিশ্লেষণের সাহায্য নিয়ে থাকে।

৫. সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী : বিনিয়োগকারী শেয়ার বাজারের তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার পূর্বে কতকগুলো। গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক অনুপাত সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়। আর্থিক বিশ্লেষণ এক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে।

৬. স্টক এক্সচেঞ্জ : কোম্পানিসমূহ স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্তির জন্য আবেদন জানালে এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা যাচাই করার জন্য আর্থিক বিশ্লেষণকে ব্যবহার করে থাকে।

৭. অর্থনীতিবিদ এবং গবেষক : অর্থনীতিবিদ এবং গবেষকগণ মূলধন বালারের গতিপ্রকৃতি এবং অর্থনীতির চালচিত্র সম্পর্ক জানার জন্য অর্থিক বিবরণীসমূহ বিশ্লেষণের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে।

৮. বিনিয়োগ বিশ্লেষক : যেসব বিনিয়োগ বিশ্লেষক মূলধন বাজার নিয়ে কাজ করে তারা তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহের পারফরমেন্স যাচাই করার জন্য আর্থিক বিশ্লেষণ করে থাকে।

৯. গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা : অনেক বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা রয়েছে যারা কোম্পানির সাথে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। তারা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। এ কাজে তারা আর্থিক বিশ্লেষণের সাহায্য নিয়ে থাকে।

১০. আয়কর কর্তৃপক্ষ : আয়কর কর্তৃপক্ষ সরকারের পক্ষে রাজস্ব সংগ্রহ করে থাকে। সঠিক আয়কর নির্ধারণের কাজে তারা আর্থিক বিশ্লেষণের ব্যবহার করে থাকে।

মোটকথা, বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, কর্তৃপক্ষ স্ব স্ব প্রয়োজনে বিবরণীসমূহ বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এ ধরনের বিশ্লেষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Similar Posts