ব্যবস্থাপকের গুণাবলি কি কি

Mr. Appley এর মতে, “Management is the art of getting things done through the effort of other people.” অর্থাৎঅপর লোকের প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাজ করে নেওয়াই হল ব্যবস্থাপনা।  সংজ্ঞাটি থেকে ব্যবস্থাপনার তথা ব্যবস্থাপকের কার্যাবলি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যায়। কর্মীদের মাধ্যমে কাজ আদায় করার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপককেই পালন করতে হয় এবং ব্যবস্থাপকের কর্মদক্ষতার উপর প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন বহুলাংশে নির্ভরশীল। ভাই ব্যবস্থাপক তার কার্যাবলি সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য কতকগুলো বিশেষ গুণ থাকা প্রয়োজন।

একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের কি কি গুণাবলি থাকা উচিত সে বিষয়গুলোকে সার্বিক বিবেচনা করে ব্যবস্থাপনাবিদ H.R.Tosdal ব্যবস্থাপকের গুণাবলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করে উপস্থাপন করেছেন, যা নিয়ে ছকে উপস্থাপনাপূর্বক আলোচনা করা হল:
ব্যবস্থাপকের প্রধান তিনটি গুণাবলি থাকে,

  • ক. মানসিক গুণাবলি (Mental quality)
  • খ. সামাজিক গুণাবলি (Social quality)
  • গ. পেশাগত গুণাবলি (Professional quality)

ক. মানসিক গুণাবলি (Mental quality)

একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের যেসব মানসিক গুণাবলি থাকা প্রয়োজন নিলে তা উল্লেখ করা হল:
১. বুদ্ধিমত্তা (Sharp intelligence) : একজন দক্ষ ব্যবস্থাপককে অবশ্যই বুদ্ধিমান হতে হবে। সকল পক্ষের পছন্দ-অপছন্দ, কাজ করার ক্ষমতা-অক্ষমতা ইত্যাদির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ব্যবস্থাপককে কার্যসম্পাদন করতে হয়। ব্যবস্থাপকের বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থাপককে বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে থাকে। ব্যবস্থাপকের বিচক্ষণ বুদ্ধিই যেন ব্যবস্থাপনার সকল কর্মকাণ্ডের হাতিয়ারস্বরূপ।

২. আবিশ্বাস (Self-confidence) : আত্মবিশ্বাসের অপর নাম সাফল্যের চাবিকাঠি। জীবনের প্রতিটি কাজেই আত্মবিশ্বাস ও মনোবলকে রাখতে হয় সুদৃঢ়। এ কথাটি একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের জন্য একান্তভাবেই প্রযোজ্য। আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন ব্যক্তিও অনেক ক্ষেত্রে নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়ে থাকে।

৩. বিচার বিবেচনার শক্তি : দক্ষ ব্যবস্থাপকের বিচার বিবেচনার শক্তি থাকা প্রয়োজন। দক্ষ ব্যবস্থাপককে কর্মীসহ সকল পক্ষের সাথে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কার্যাদি সম্পর্কে আলাপ আলোচনায় বিচার বিবেচনার শক্তি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তীক্ষ্ণ বিচার বিবেচনার শক্তিসম্পন্ন ব্যবস্থাপক সহজেই নিজেকে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

৪. সাধারণ জ্ঞান (General knowledge) : সাধারণ জ্ঞান একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের মানসিক গুণাবলির ভাণ্ডারকে করে সমৃদ্ধশালী। এজন্য একজন দক্ষতাসম্পন্ন ব্যবস্থাপককে পর্যাপ্ত সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। সাধারণ জ্ঞানের মাধ্যমে ব্যবস্থাপক সকল বিষয়কে কার্যকরভাবে মূল্যায়ন ও কার্যকরী করতে সমর্থ হয়ে থাকে।

৫. বাক্‌-নৈপুণ্য : ব্যবস্থাপকের জন্য বাক্-নৈপুণ্যতার গুণটি অত্যন্ত জরুরি। গুছিয়ে কোনকিছু বলা বা উপস্থাপনাকে বলা হয় আর্ট বা কলা। ব্যবস্থাপকের কথাবার্তা এলোমেলো ও অগোছালো হলে প্রতিষ্ঠানের কেউই আকৃষ্ট হয় না, বরং কার্যক্ষেত্রে গোলযোগের সৃষ্টি হয়। তাই ব্যবস্থাপককে হতে হয় বাক্-নৈপুণ্যসম্পন্ন ব্যক্তি।

৬. পরিশ্রম করার ক্ষমতা (Industrious) : একজন সফল ও দক্ষ ব্যবস্থাপককে অবশ্যই কর্মঠ ও পরিশ্রমী হতে হবে। ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যাবলি পরিচালনা করা খুবই পরিশ্রমের কাজ। পরিশ্রম করার ক্ষমতায় যে ব্যবস্থাপক যত বেশি ভারসাম্যপূর্ণ হবেন তিনি নিজেকে ততটা দক্ষ হিসেবে প্রকাশে সক্ষম হবেন। তাই বলা যায় যে, একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের পরিপূর্ণতা পূরণার্থে ব্যবস্থাপককে অবশ্যই পরিশ্রমী হতে হবে।

৭. ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা : সকল পক্ষের কথাবার্তা ব্যবস্থাপককে ধৈর্যসহকারে শুনতে হবে। সকল পক্ষের সাথে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে আচার আচরণ করতে হবে। কারণ ব্যবস্থাপকের কথাবার্তায় অধৈর্যের পরিচয়ে প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হয় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন পক্ষ ঐ প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

খ. সামাজিক গুণাবলি (Social quality)

একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের যেসব সামাজিক গুণে গুণান্বিত হওয়া প্রয়োজন নিয়ে তা আলোচনা করা হল :

১. সততা ও ন্যায়পরায়ণতা : ব্যবস্থাপকের একটি বিশেষ সামাজিক গুণাবলি হিসেবে ব্যবস্থাপকের সততা ও ন্যায়পরায়ণতাকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ব্যবস্থাপকের সততা ও ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে যেন কারও সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি না হয়। সর্বক্ষেত্রে আস্থা বা বিশ্বাসের ভিত দণ্ডায়মানে ব্যর্থ হলে ব্যবস্থাপক কোন অবস্থাতেই নিজেকে কার্যকর ও দক্ষ হিসেবে প্রতীয়মান করতে সমর্থ হবে না।

২. সহানুভূতিশীলতা : ব্যবস্থাপককে সহানুভূতিশীল হতে হবে। বিচিত্র ধরনের পরিবেশ ও বিচিত্র ধরনের কর্মী নিয়ে ব্যবস্থাপককে একটা সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতে হবে। এ কারণেই সর্বক্ষেত্রে সঠিক সম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যবস্থাপককে অবশ্যই সহানুভূতিশীল হতে হয়।

৩. নমনীয়তা (Flexibility) : নমনীয়তা ব্যবস্থাপকের একটি বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সকল পক্ষের আচার আচরণ এবং সময়ের সাথে ব্যবস্থাপককে নমনীয় হয়ে যথোপযুক্ত এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তাই সকল অবস্থায় ব্যবস্থাপকের নমনীয় হওয়া বিশেষ প্রয়োজন

গ. পেশাগত গুণাবলি (Professional quality)

একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকে যেসব পেশাগত গুণ থাকা আবশ্যক নিয়ে তা উপস্থাপন করা হল :

১. সাধারণ শিক্ষা : দক্ষ ব্যবস্থাপক হতে হলে ব্যবস্থাপককে অবশ্যই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যবস্থাপক নিঃসন্দেহে পেশাগত ক্ষেত্রে যোগ্যত্তর হয়ে থাকে। এছাড়া শিক্ষিত মানুষ হয় বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল, সহনশীল, নমনীয় ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত। তাই একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন সাধারণ শিক্ষা বা শিক্ষাগত যোগ্যতার।

২. বাজার সম্পর্কে জ্ঞান (knowledge of market) : একজন ব্যবস্থাপককে বাজার সম্পর্কে জ্ঞান অর্থাৎ সময় জ্ঞান সম্পর্কে যথাযথভাবে অবগত হতে হবে। বাজারে কোন পণ্যের চাহিদা কিরূপ, ক্রেতাগণ কোন পণ্য পছন্দ করে এবং কোনটি করে না ইত্যাদি সম্পর্কে কার্যকর ও যথাযথ জ্ঞান রাখতে হবে। অর্থাৎ যথাসময়ে কার্যসম্পাদনে ব্যবস্থাপককে মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।

৩. অভিজ্ঞতা (Experience) : একজন ব্যবস্থাপককে দক্ষ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে হলে প্রয়োজন পেশাগত অভিজ্ঞতার। আমরা জানি যে, ব্যবস্থাপনা হচ্ছে কলা ও বিজ্ঞাপনের সম্মিলিত একটি বিষয়। তাই প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা অর্থাৎ কলা সংক্রান্ত জ্ঞানের পরিপূর্ণতার জন্য প্রয়োজন ব্যবস্থাপকের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিবিধ সমস্যা ও তার সমাধানকল্পে প্রয়োজন ব্যবস্থাপকের পেশাগত বিষয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার। অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি দ্রুত সম্পন্ন করা যায় এবং সফলতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৪. পরিবেশ সম্বন্ধে জ্ঞান (knowledge of environment) : সময়, পণ্য, ক্রেতা, উৎপাদনকারী, সরকার, মালিক ইত্যাদি সার্বিক পরিবেশ সম্বন্ধে ব্যবস্থাপককে আন্তরিক ও একাগ্র হতে হবে। পরিবেশ সম্বন্ধে যথাযথভাবে অবগত হয়ে ব্যবস্থাপককে ধীরস্থির অথচ দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাথে অসর হতে হবে।

৫. প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে জ্ঞান : একজন দক্ষ ব্যবস্থাপককে তার প্রতিষ্ঠান এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় দিক সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত হতে হবে। প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে জ্ঞানের আলোকে ব্যবস্থাপক পরিকল্পনা, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও প্রণোদনা সংক্রান্ত নিজেকে সহজেই প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হবে। এ কারণেই প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে জ্ঞানকে ব্যবস্থাপকের একটি বিশেষ গুণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, একজন সফল ব্যবস্থাপকের যে সমস্ত গুণ থাকা প্রয়োজন তার আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উল্লিখিত গুণাবলি সমৃদ্ধ একজন ব্যবস্থাপক নিজেকে আদর্শ ও দক্ষ ব্যবস্থাপক হিসেবে পরিগণিত করতে সর্বক্ষেত্রে সমর্থ হয়ে থাকেন।

Similar Posts