পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা সমূহ ব্যাখ্যা কর
প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্যই পরিকল্পনা প্রথম এবং প্রধান ধাপ। পরিকল্পনার ব্যর্থতার দায়ভার প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যাবলির উপর পতিত হয়। তাই পরিকল্পনাকে যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত রাখতে সকল প্রতিষ্ঠানই সচেষ্ট হয়। তথাপি পরিকল্পনার কতিপয় সীমাবদ্ধতা আছে, যার ফলে পরিকল্পনা বিভিন্ন সময় ব্যর্থতায় পরিণত হয়।
পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা
পরিকল্পনার বহুবিধ সীমাবদ্ধতা আছে, যা কখনও সংশোধন করা যায়, আবার কখনও সংশোধন সম্ভব হয় না। নিম্নে পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতাসমূহ আলোচনা করা হল।
১. পূর্বানুমানের সমস্যা (Problems in forecasting)
পরিকল্পনার ভিত্তিমূলই হল পূর্বানুমান। পূর্বানুমান সকল সময়ই সঠিক হয় না। যখন পূর্বানুমান নির্ভুলভাবে করা সম্ভব হয় না, তখন পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাই ভুল পূর্বানুমান পরিকল্পনার একটি অন্যতম সীমাবদ্ধতা।
২. সময়সাপেক্ষ (Timeliness)
পরিকল্পনা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এর বাস্তবায়নও যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। কোন কোন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক জটিলতা এবং অধিক লেনদেনের দরুন পরিকল্পনা আরও অধিক দীর্ঘায়িত হয়। কিন্তু ব্যবসায়িক জগতের বহু ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই দীর্ঘসূত্রতা পরিকল্পনার অপর একটি সীমাবদ্ধতা, যা আরও বহুবিধ সীমাবদ্ধতার জন্ম দেয়।
৩. অনমনীয়তা (Inflexibility)
নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ফলে এবং নিত্যনতুন বিকল্প পণ্য পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে ব্যবসায় বাণিজ্য দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্ষেত্রেও দ্রুত পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়ে। এতে করে পরিকল্পনারও দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। কিন্তু দ্রুত পরিকল্পনার পরিবর্তন ততটা সহজ নয়। এমনকি নিত্যনতুন পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা অচল হয়ে পড়ে। তাই নমনীয়তার অভাব পরিকল্পনার একটি অন্যতম সীমাবদ্ধতা।
৪. কৃত্রিম নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি (Creation of artificial security)
পরিকল্পনা অনেক ক্ষেত্রে কৃত্রিম নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করে। এটা পরিকল্পনার একটি বিরাট সীমাবদ্ধতা। কেননা প্রতিষ্ঠানের অনেকেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে নিশ্চয়তা অনুভব করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান মূল লক্ষ্যের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। ফলে পরিকল্পনা লক্ষ্য অনুযায়ী চলছে কি না সেদিকে নজর থাকে না। এই মিথ্যা নিরাপত্তাবোধ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
৫. ব্যয়সাপেক্ষ (Costly)
পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন অত্যধিক ব্যয়বহুল। তাই এটাও পরিকল্পনার একটি সীমাবদ্ধতা। কেননা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, বিশেষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা পরিকল্পনার মূলভিত্তি। এ সমস্ত ব্যয় উপেক্ষা করে পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব হয় না।
৬. সৃজনশীলতা দমন (Barriers for creativity)
পরিকল্পনার ধারায় অনেক ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার মৃত্যু ঘটে। কর্মচারীদের নিজ প্রতিভার বিকাশের সুযোগ থাকে না। ফলে তারা কর্মস্পৃহা ত্যাগ করে উৎসাহ উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে। এতে করে কর্মী তার স্বাধীন সত্তা হারায়।
৭. পৌনঃপুনিকতার অভাব (Lack of recurring)
পরিকল্পনা একটি নির্ধারিত পটভূমিতে রচিত হয়। তাই অবস্থার পরিবর্তনে বাস্তব কাজের পৌনঃপুনিকতা বজায় থাকে না। ফলে স্থায়ী পরিকল্পনা তার কার্যকারিতা হারায়। তাই স্থায়ী পরিকল্পনার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও পৌনঃপুনিক কাজের উপস্থিতি একান্ত জরুরি।
৮. মানবীয় প্রভাব (Effect of human being)
পরিকল্পনার সকল স্তরেই মানবীয় প্রভাব লক্ষণীয়। প্রধানত মূল পরিকল্পনাকারীর অদক্ষতা পরিকল্পনার একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। অদক্ষ পরিকল্পনাকারীর প্রভাবে সকল তথ্য উপাত্ত সঠিক হওয়ার পরও পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যায়। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, দুর্বল চিন্তা, অদূরদর্শীতার কারণে পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
৯. ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজে বাধাঁ (Borders in others management activities)
প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেই তাদের বিভিন্ন বিভাগের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকে। এই পরিকল্পনা যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এসব কার্যাবলির মধ্যে সংগঠন, সমন্বয় সাধান, প্রেষণা ও নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযোগ্য।
১০. আশাতীত প্রত্যাশা (Excuse expectancy)
সঠিক পরিকল্পনা একটি প্রতিষ্ঠাকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে সক্ষম। তবে সকল ক্ষেত্রে এটার বাস্তবায়ন সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান সংশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পরিকল্পনা হতে অতিমাত্রায় সফলতা আশা করে থাকে, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতায় রূপান্তরিত হয়।
১১. দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা (Problems to rapid decision)
পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কতকগুলো পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপ অনুসরণ করা হয়। এসব পদক্ষেপসমূহ অনেক সময়সাপেক্ষ হয় বলে প্রতিষ্ঠানের যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বিলম্বিত করে। ফলে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
১২. মানসিক প্রতিবন্ধকতা (Mental barrier)
প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই প্রচলিত রীতিনীতি এবং ধ্যানধারণাকে বিশ্বাস করে থাকে। ফলে কর্মীরা নতুন কোনকিছুকে গ্রহণ করতে চায় না। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ভবিষ্যৎ অপেক্ষা বর্তমানকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠানে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্মচারীরা অপারগতা প্রকাশ করে। এতে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
১৩. সংশোধনের ক্ষেত্রে সমস্যা (Problems in correction)
“To err is human” অর্থাৎ, মানুষ মাত্রই ভুল। যেহেতু পরিকল্পনা মানুষের দ্বারাই প্রণয়ন করা হয়ে থাকে সেহেতু এতে সাধারণত ভুল থাকতে পারে। যা পরিকল্পনাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। তাই আদর্শ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সংশোধন আনার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু পরিকল্পনার সাথে জড়িত কর্মীবৃদ্ধের অদক্ষতা, অবহেলা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবে পরিকল্পনার সঠিক সংশোধন সম্ভব হয় না। ফলে পরিকল্পনার উদ্দেশ্য অর্জন ব্যাহত হয়।
উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, পরিকল্পনাকে ব্যবস্থাপনার সফলতার অন্যতম নিয়ামক ভাবা সত্ত্বেও পরিকল্পনার নানাবিধ সীমাবদ্ধতার উপায় আলোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে। তথাপি পরিকল্পনা ব্যতীত কোন প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। তাই ব্যবস্থাপকের উচিত পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতাসমূহের যথাযথ প্রতিরোধ তৈরি করা এবং এসব সীমাবদ্ধতাসমূহকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।