কেন্দ্রীকরণের সুবিধা এবং অসুবিধা সমূহ আলোচনা কর
ব্যবস্থাপনার উচ্চ পর্যায়ের কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা পদ্ধতিগতভাবে সংরক্ষণ বা পুঞ্জিভূত রাখাকে কেন্দ্রীকরণ বলে। সাধারণত একটি সংগঠনে এর বহুমাত্রিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন- ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, সিদ্ধান্তের কেন্দ্রীকরণ, কাজের কেন্দ্রীকরণ প্রভৃতি। এক্ষেত্রে এর বহুবিধ সুবিধা রয়েছে।
কেন্দ্রীকরণের সুবিধাসমূহ
কেন্দ্রীকরণের সুবিধাসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হল।
১. দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Quick decision Making) : কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমৃদয় ক্ষমতা শীর্ষ ব্যবস্থাপনার হাতে ন্যস্ত থাকে। এতে তাকে অধস্তনদের সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয় না। তিনি এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। মোটকথা সিদ্ধান্ত গ্রহণ যত দ্রুত ও যথার্থ হবে, সংগঠন তত এগিয়ে যাবে।
২. কর্মসম্পাদনের একরূপতা (Unity in activities) : উচ্চস্তরের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকার ফলে সংগঠনে কর্মচারী কর্মকর্তার মধ্যে একটা ঐক্য গড়ে ওঠে। এখানে কোন প্রকার দ্বিমতের সৃষ্টি হয় না।
৩. ব্যক্তিগত নেতৃত্বের সুবিধা (Facilitating personal leadership) : কেন্দ্রীকরণ পদ্ধতিতে ব্যক্তিগত নেতৃত্বের সৃষ্টি হয়। কারণ এখানে যোগ্য ও দক্ষ লোকদের হাতে ক্ষমতা একত্রীভূত করে ন্যস্ত করা হয়। ফলে সংগঠন সুষ্ঠুভাবে ও যথাযথভাবে চলতে পারে।
৪. সমন্বয়ে সহযোগিতা (Facilitating in co-ordination) : ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ফলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে সংযোজন যথার্থ হয়। কারণ এখানে অধস্তন কর্মচারীগণকে সর্বদা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। ফলে Interaction বৃদ্ধি পায়।
৫. যোগসূত্র স্থাপন (Maintain corclation) : ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হয় যা সংগঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অধস্তন কর্মচারীগণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অধীনে কাজ করে থাকেন এবং এতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
৬. ব্যয় হ্রাস (Reducing cost) : কেন্দ্রীকরণের ফলে প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনায় একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যবস্থাপনার স্তর হ্রাস পায়। এতে করে সার্বিকভাবে ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হয়।
৭. জরুরি অবস্থা মোকাবিলা (To handle emergencies) : সংগঠনে অনেক সময় হঠাৎ করে বিশেষ কোন পরিস্থিতি বা জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করতে হলে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত আবশ্যক।
৮. শৃঙ্খলা রক্ষা (Maintain order) : কেন্দ্রীকরণের অন্যতম একটি সুবিধা হচ্ছে এতে সর্বস্তরে শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়। কেন্দ্রীকরণের ফলে সকল স্তরে একই আদর্শ অনুসৃত হওয়ায় শৃঙ্খলা রক্ষা আরও সহজ হয়।
৯. সহজ নিয়ন্ত্রণ (Easy control) : কেন্দ্রীকরণের ফলে উচ্চ পর্যায়ের নির্বাহিগণ অধিক কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বজায় থাকে। ফলে কার্যাবলি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
১০. গোপনীয়তা রক্ষা (Maintaining secrecy) : আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক কারবারি জগতে গোপনীয়তা রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই কারবারি জগতে গোপনীয়তা রক্ষা করে চলতে না পারলে কারবার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আন্তর্জাতিক বাজার টিকে থাকা অসম্ভব। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীভূত থাকলে প্রয়োজনীয় গোপনীয়তা সহজেই রক্ষা করা যায়।
১১. তত্ত্বাবধানের সুবিধা (Supervision facilities) : কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধান কার্য সহজ হয়। এক্ষেত্রে নির্বাহির নিয়ন্ত্রণ স্তর সীমিত থাকে। ফলে কর্মীদের কার্যকরভাবে তত্ত্বাবধান করা যায়।
১২. মিতব্যয়িতা অর্জন (Achieving economy) : ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে অধিক কেন্দ্রীভূত থাকার ফলে অধিক নির্বাহির প্রয়োজন হয় না। এখানে কয়েকজন নির্বাহি দ্বারাই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব। এতে নির্বাহির কেন্দ্রীক ব্যয় বহুলাংশে হ্রাস পায়।
১৩. কাৰ্যদক্ষতা বৃদ্ধি (Increasing work efficiency) : সংগঠনের সর্বস্তরে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাৰ্যদক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাছাড়া সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নির্বাহি ও অধস্তনদেরকে কাজের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এক্ষেত্রে অধস্তনরা তাদের স্ব-স্ব কাজের জন্য ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনার নিকট জবাবদিহি থাকে। ফলে সংগঠনে কাজের মান ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
কেন্দ্রীকরণের অসুবিধাসমূহ
সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে কেন্দ্রীকরণে যেসব বাধা বা অসুবিধাসমূহ রয়েছে নিচে তা আলোচনা করা হল।
১. স্থানীয় চাহিদা উপেক্ষা (Over look local demand) : কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থায় সিদ্ধান্তকে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় চাহিদাকে এখানে অবজ্ঞা করা হয়। যথা : উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের সুবিধা অসুবিধা চাহিদা নিশ্চয়ই উচ্চস্তরের কর্মকর্তাদের জানার কথা নয় ।
২. সিদ্ধান্ত গ্রহণ যথার্থ হয় না (Decision making is not appropriate) : কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবসায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যথার্থ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ স্থানীয় সময়োপযোগী ও অবস্থা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কেন্দ্রের জন্য অসম্ভব।
৩. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব (Delay in decision making) : প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ক্ষমতা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিলম্ব হয়। কারণ দেশের একটি স্থানে কোন সমস্যার উদ্ভব হলে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত অর্পিত থাকলে হলে সেখানে পৌঁছাতে স্বভাবতই দেরি হওয়ার কথা।
৪. স্বেচ্ছাচারিতা (Autocracy) : কেন্দ্রীকরণের ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে সম্পর্কের হানি ঘটে।
৫. সংগঠনে অদক্ষতা বৃদ্ধি পায় (Increase unskilled in the organization) : কেন্দ্রীভূত সংগঠনে ক্ষমতা একটা নির্দিষ্ট গ্রুপের হাতে থাকায় অধস্তন কর্মচারীগণ ক্রমশ অদক্ষ হয়ে পড়েন। কারণ তারা সংগঠনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এবং কর্মের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
৬. দুর্বল নেতৃত্ব (Weak leadership): কেন্দ্রীকরণের ফলে উচ্চস্তরের একটা বিশেষ মহলের উপর দায়িত্বভার অর্পিত হয়। ফলে তারা কাজের অন্যান্য বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে পারে না।
৭. নির্বাহির কার্যভার বৃদ্ধি (Increasing executive workload): কেন্দ্রীকরণে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা শীর্ষ নির্বাহির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এতে নির্বাহিকে একই সাথে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আদেশ দান ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করতে হয়। ফলে তাদের কার্যভার লাঘব হয়।
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, কেন্দ্রীকরণের উপরিউক্ত বহুবিধ সুবিধা লক্ষ্য করা যায়। তবে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণ কার্যত অগণতান্ত্রিক বলে মনে হয়। তবে সংগঠনের প্রকৃতি ও ধরন অনুযায়ী এটা হওয়া উচিত। দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি, অবস্থা অনুযায়ী ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ উভয়ই দরকার বলে মনে হয়। এ প্রসঙ্গে M. G. Newport এবং R. L. Trewatha এর মতে, “অতি সাম্প্রতিক সময়ে সংগঠনসমূহকে সমন্বিত উপায়ে পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়। ফলে কর্তৃত্বের কেন্দ্রীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।“