যোগাযোগের উদ্দেশ্য সমূহ আলোচনা কর
যোগাযোগের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে কারবার প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং উক্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা। ব্যবসায়িক যোগাযোগ নানাবিধ উদ্দেশ্য অর্জনের দিকে ধাবিত হয়। তাই ব্যবসায় যোগাযোগের উদ্দেশ্য অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত।
যোগাযোগের উদ্দেশ্য সমূহ
যোগাযোগের বহুবিধ উদ্দেশ্য রয়েছে। এসব উদ্দেশ্যগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যসম্পাদন সম্বন্ধীয় উদ্দেশ্য, ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক কার্যসম্পাদন সংক্রান্ত উদ্দেশ্য এবং অন্যান্য উদ্দেশ্য ইত্যাদি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। নিম্নে সাংগঠনিক লক্ষ্য অর্জনের প্রেক্ষিতে যোগাযোগের উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা করা হল।
১. ব্যবসায়ের লক্ষ্য অর্জন (Achieving goal of business) : ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান প্রথমে তার লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং সে লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন কার্যসম্পাদন করে। যোগাযোগের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংগঠনের সকল স্তরের ব্যবস্থাপনা ও কর্মীদের মধ্যে সুষ্ঠু সুযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জোরদার করা।
২. তথ্যের আদানপ্রদান (Exchange of idea) : তথ্যের আদানপ্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন পক্ষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয় যার ফলে সংগঠনের লক্ষ্য অর্জন সহজতর হয়। যোগাযোগের একটি অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে এবং প্রতিষ্ঠান ও বাহ্যিক পক্ষগুলোর মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদান করা।
৩. পরিকল্পনা প্রণয়ন (Preparation of planning) : কারবার প্রতিষ্ঠানে লক্ষ্য ও সম্পাদিত কার্যাবলি নিয়ে পূর্ব থেকেই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। কারণ পরিকল্পনাহীনভাবে ব্যবসায়িক কার্যকলাপ পরিচালিত হলে তা প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয় না। যোগাযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের পরামর্শ সংগ্রহকরণে প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করা।
৪. সমন্বয় সাধন করা (Co-ordination) : যোগাযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমন্বয় ও সংহতি স্থাপন করা। ব্যবসায়িক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে পারস্পরিক সংহতি স্থাপন করে এবং বিভিন্ন বিভাগের কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনকে সহজতর করে।
৫. নীতিমালা প্রণয়ন (Principles) : যোগাযোগের একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে নীতিমালা প্রণয়নে সহায়তা করার জন্য কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করা। কারবার প্রতিষ্ঠানের কার্যসম্পাদনের নীতিমালা ও কর্মপন্থা প্রণয়নে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত যোগাযোগ পদ্ধতির মাধ্যমে সংগৃহীত হয়ে থাকে।
৬. কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন (Development of market skill) : সুষ্ঠু ও সুনিপুণভাবে কার্যদায়িত্ব পালনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনকে সহজতর করে তোলার জন্য কর্মীদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হয়। যোগাযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মীদের প্রশিক্ষণদানের মাধ্যমে এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত জ্ঞানের বিকাশ ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
৭. সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ (Proper control) : কর্মীদের দ্বারা সম্পাদিত কার্যাবলিতে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। কারণ নিয়ন্ত্রণের অভাবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে কার্যসম্পাদিত হয় না এবং লক্ষ্য অর্জন ব্যাহত হয়। পরিকল্পিত উপায়ে কার্যসম্পাদিত হচ্ছে কি না তা তদারক করা এবং প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে নিয়ন্ত্রণ বলা হয়। যোগাযোগের উদ্দেশ্যের মধ্যে অধস্তনদের কার্য নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত থাকে।
৮. কার্য সন্তুষ্টি বৃদ্ধি (Increase of job satisfaction) : সুষ্ঠুভাবে কার্য দায়িত্ব পালন করার জন্য মনোবল উন্নত করার মাধ্যমে কর্মী ও নির্বাহিদের কার্য সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করতে হয়। কার্য সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করা হলে কর্মীরা কাজের প্রতি আগ্রহী হয় এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে কার্য সন্তুষ্টি বৃদ্ধি করা যাতে করে লক্ষ্য অর্জনে সকল পক্ষের সর্বোচ্চ সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব হয়।
৯. নির্দেশনা দান করা (Direction) : যোগাযোগের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্দেশনা দান করা। যোগাযোগ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নির্দেশ নিম্নপদস্থ কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেয়। সুষ্ঠু কার্য পরিচালনার জন্য সংগঠনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ, নির্দেশ ইত্যাদি যথাসময়ে সঠিকভাবে অধস্তনদের নিকট প্রেরণ করা অত্যাবশ্যক।
১০. পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন (Development of mutual relation) : প্রতিষ্ঠানে কার্য উপযোগী অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সকল স্তরের মানবসম্পদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত গড়ে তুলতে হবে। ঊর্ধ্বতন, অধস্তন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকাণের মধ্যে সুষ্ঠু সম্পর্ক বজায় থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। যোগাযোগ সকল স্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের মধ্যে তথ্য ও ভাবের আদানপ্রদানের মাধ্যমে সুষ্ঠু সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটায় এবং তা ধারাবাহিকভাবে বজায় রাখে।
১১. ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা (To attraction customers) : প্রভিটি কারবার প্রতিষ্ঠানই চায় তাদের পণ্য ও সেবার প্রতি অধিক ক্রেতা আকৃষ্ট করতে এবং বিক্রয় বৃদ্ধি করতে। প্রতিষ্ঠানের এ উদ্দেশ্যকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলে সুষ্ঠু ও কার্যকর যোগাযোগ যোগাযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্রেতাদেরকে প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের পণ্যের গুণাগুণ সম্বন্ধীয় তথ্য জানিয়ে দেওয়া যাতে করে তারা উক্ত পণ্যের প্রতি অধিক আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। ফলপ্রস্” ও উত্তম যোগাযোগের কারণেই ক্রেতা ও বিক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
১২. প্রণোদনা দান (Motivation): প্রণোদনা দানের মাধ্যমে কর্মীদেরকে কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়। যোগাযোগ কর্মীদের মধ্যে প্রণোদনার সঞ্চার করে কার্য দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনমুখী করে তোলে। ব্যবস্থাপনা ও কর্মীদের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যোগাযোগ কার্য প্রণোদনার সৃষ্টি করে। সুতরাং যোগাযোগের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মীদের কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য প্রণোদনা দান করা।
১৩. সাংগঠনিক কার্যসম্পাদন (Organizational work performance) : প্রাতিষ্ঠানিক কার্যসম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহে বিভিন্ন উৎস ব্যবহার করতে হয়। যোগাযোগের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কার্যাবলি সম্পাদনে কার্যকর সহযোগিতা প্রদান করা। এতে করে কারবার প্রতিষ্ঠান তার উৎপাদন ও প্রশাসনিক কার্য নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।
১৪. সমস্যার সমাধান (Problems solve) : যোগাযোগের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে কারবার প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক কর্মী, কর্মকর্তা ও নির্বাহিদের মধ্যে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানও অন্তর্ভুক্ত থাকে। কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমেই কেবল এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভবপর হতে পারে। সুতরাং শ্রম ব্যবস্থাপনার মধ্যে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করাও যোগাযোগের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।
১৫. কর্মীদের মনোভাৰ সম্পৰ্কে অবহিত হওয়া : যোগাযোগ কর্মীদের মনোভাব সম্পর্কে ব্যবস্থাপনাকে অবহিত করে। কর্মীদের মনোভাব সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত হওয়া না গেলে ব্যবস্থাপনার পক্ষে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব হয় না। কর্মীদের মনোভাব সম্পর্কে অবহিত করে ব্যবস্থাপনাকে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যোগাযোগের উদ্দেশ্য।
১৬. উন্নয়নের গতিশীলতা সৃষ্টি (To create of development dynamics): যোগাযোগ সামগ্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের গতিশীলতা আনয়ন করে। প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি অর্জন, সংবাদ প্রচার ও অগ্রগতিতে অবদান পালন ইত্যাদি যোগাযোগের মাধ্যমে সম্ভব হয়। সুতরাং যোগাযোগকে ব্যবসায়ের ধারাবাহিক অগ্রগতির মূল হিসেবে অভিহিত করা যায়।
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যোগাযোগের উদ্দেশ্যের আওতা অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। উপরিউক্ত উদ্দেশ্যগুলো ছাড়াও আরও অনেক উদ্দেশ্য রয়েছে যেগুলো কারবার প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ও সর্বলতাকে ত্বরান্বিত ও সহায়তা করে। ব্যবসায়িক যোগাযোগের মাধ্যমে বহুমুখী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে অর্জনের প্রচেষ্টা চালানো হয়।