অলিগোপলি বাজার কি | অলিগোপলি বাজারের উদাহরণ, বৈশিষ্ট্য এবং প্রকারভেদ
অলিগোপলি বাজার কি
অর্থনীতিতে বাজার বলতে আমরা কোন একটি নির্দিষ্ট দ্রব্যের ক্রয়বিক্রয়কে বুঝি। এ ক্রয়বিক্রয়ের সাথে জড়িত থাকে ক্রেতা ও বিক্রেতা। ক্রেতা ও বিক্রেতার উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে আমরা বাজারকে কয়েক ভাগে ভাগ করি। তার মধ্যে একটি হচ্ছে অলিগোপলি। অলিগোপলি বাজার হল এমন একটি বাজারব্যবস্থা যেখানে দু’য়ের অধিক কিন্তু ‘অসংখ্য নয়’ সংখ্যক ফার্ম বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এরূপ বাজারে ‘অসংখ্য নয়’ সংখ্যক ফার্ম বলতে যে ফার্মসমূহের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং বোঝাপড়া করার সুযোগ রয়েছে এমন সংখ্যক ফার্মের সমন্বয়ে গঠিত বাজার বুঝায়। অলিগোপলি অর্থ অল্প বিক্রেতা বা Few Seller’s। Oligopoly শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে। Oligopoly শব্দের দুটি অংশ। যথা : Oligos এবং Polis । Oligos এর অর্থ কতিপয়। Polis শব্দের অর্থ বিক্রেতা। উৎসের দিক থেকে Oligopoly বলতে কতিপয় বিক্রেতাকে বুঝায়।
অলিগোপলি বাজার কাকে বলে
যে বাজারে স্বল্পসংখ্যক বিক্রেতা বা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান (ফার্ম – Firm) সমজাতীয় কিংবা পৃথক অথচ নিকটতম বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন করে তাকে অলিগোপলি (Oligopoly) বাজার বলে। অল্প বিক্রেতার কারণে এখানে একজনের দাম এবং উৎপাদন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন অন্যান্য ফার্মকে প্রভাবিত করে। এ বাজারব্যবস্থায় কোন ফার্ম এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না, হয় সে পারস্পরিকভাবে সমঝোতায় আসতে পারে; নতুবা অন্যান্য ফার্মের সাথে চুক্তি করে দাম ও উৎপাদন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাই অলিগোপলি হল এমন এক বাজারব্যবস্থা যেখানে অল্প সংখ্যক ফার্ম পারস্পরিক বোঝাপড়া বা চুক্তির মাধ্যমে দাম ও উৎপাদন নির্ধারণ করে।
অলিগোপলি বাজারের উদাহরণ
ইস্পাত উৎপাদন, তেল, রেলপথ, উৎপাদন, মুদি দোকানের চেইন এবং ওয়্যারলেস ক্যারিয়ার ইত্যাদি বাজার হচ্ছে অলিগোপলি বাজারের উদাহরণ। এয়ারলাইন্স এবং ফার্মাসিউটিক্যালসও অলিগোপলি বাজারের বৈশিষ্ট্য মেনে চলে। এই শিল্প সমূহকে অর্থনীতিতে ফার্ম বলা হয়।
অলিগোপলি বাজার কত প্রকার
অলিগোপলি বাজারের প্রকারভেদ : অলিগোপলি বাজারকে মূলত নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১. খোলা অলিগোপলি ও বন্ধ অলিগোপলি
যে অলিগোপলি বাজার নতুন প্রতিযোগী ফার্ম সহজেই প্রবেশ করতে পারে তাকে খোলা অলিগোপলি বাজার বলে। অপরদিকে সে অলিগোপলি বাজারে নতুন ফার্ম সহজে প্রবেশ করতে পারে না তাকে বদ্ধ অলিগোপলি বাজার বলে।
২. বিশুদ্ধ অলিগোপলি ও পৃথকীকৃত অলিগোপলি
যখন স্বল্প সংখ্যক ফার্ম সমজাতীয় দ্রব্য কিংবা প্রায় সমজাতীয় দ্রব্য উৎপাদন করে এবং বাজার দখলের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে তখন তাকে বিশুদ্ধ অলিগোপলি বাজার বলে। এরূপ বাজারে কোন ফার্ম যদি দাম পরিবর্তন করে তাহলে অন্যান্য ফার্মের উপর এর সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে। পক্ষান্তরে যখন প্রতিযোগী ফার্মসমূহ পৃথক অথচ নিকটতম বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন করে এবং বাজার দখলের জন্য পরস্পর তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে তাকে পৃথকীকৃত অলিগোপলি বাজার বলে। এরূপ বাজারের প্রত্যেক ফার্ম কিছু পরিমাণে একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করে।
৩. আংশিক অলিগোপলি ও পূর্ণ অলিগোপলি
যে অলিগোপলি বাজরে মাত্র একটি বা অল্প কয়েকটি বৃহদায়তন ফার্ম অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃত ক্ষুদ্রায়তন হয় এবং বৃহদায়তন ফার্মগুলো দাম সম্পর্কে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে এবং ক্ষুদ্রায়তন ফার্ম সেই দাম মেনে নেয় তাকে আংশিক অলিগোপলি বাজার বলে। পক্ষান্তরে যে অলিগোপলি বাজারে বিক্রেতারা প্রত্যেকেই দ্রব্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যোগান দেয় এবং দাম ধার্যের ব্যাপারে কেউই কারও নেতৃত্ব অনুসরণ করে না তাকে পূর্ণ অলিগোপলি বলে।
৪. যোগসাজসপূর্ণ অলিগোপলি এবং যোগাসাজসহীন ওলিগোপলি
যে অলিগোপলি বাজারে বিক্রেতা বা ফার্মগুলোর মধ্যে যোগসাজস থাকে তাকে যোগসাজসপূর্ণ ওলিগোপলি বলে। পক্ষান্তরে যে অলিগোপলি বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী ফার্মগুলোর মধ্যে কোন যোগসাজস থাকে না তাকে যোগসাজসহীন অলিগোপলি বলে।
অলিগোপলি বাজারের বৈশিষ্ট্য
অলিগোপলি বাজারব্যবস্থার যেসব বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখে ধরা পরে তা নিম্নরূপ।
১. সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা
অল্পসংখ্যক ফার্মের মধ্যে প্রতিযোগিতা বিদ্যমান থাকায় দাম এবং উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়। একজন বিক্রেতা উৎপাদন বা দামের সামান্য পরিবর্তন করলে অন্যান্য বিক্রেতার উপর তার প্রভাব পড়ে। প্রত্যেক বিক্রেতা দাম ও উৎপাদন নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে অন্যান্য ফার্মের উপর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কিরূপ হবে তা বিবেচনা করে।
২. বিজ্ঞাপন প্রচারের গুরুত্ব
অলিগোপলিতে একজন বিক্রেতা অপর বিক্রেতার সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত থাকে। অন্যের কাছ থেকে কিভাবে ক্রেতা ছিনিয়ে নেওয়া যায় এবং নিজ দ্রব্যের ভোক্তাদের কিভাবে ধরে রাখা যায় সে বিষয়ে প্রত্যেক বিক্রেতা বিবেচনা করে। তাই নিজ দ্রব্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নেয়। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা, সাইনবোর্ড, ব্যানার এবং পিকচার প্রদানের মাধ্যমে এরূপ বাজারে প্রচার প্রচারণা দ্বারা ভোক্তাদেরকে নিজ দ্রব্যের অনুরক্ত করতে চেষ্টা করে।
৩. দলীয় মনোভাব
অলিগোপলি ফার্মসমূহ অনেক সময় মুনাফা সর্বাধিক করার জন্য দলীয় স্বার্থ বিবেচনা করে। কয়েকটি ফার্ম দলীয়ভাবে উৎপাদন কাজ পরিচালনা করতে পারে। এ দলীয় মনোভাব সমঝোতামূলক বা চুক্তি মাফিক হতে পারে।
৪. একাত্মরূপের অভাব
অলিগোপলি ফার্মসমূহের আয়তনের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে। কোন কোন ফার্ম আয়তনে অনেক বড় আবার কোন কোন ফার্ম ছোট হতে পারে। কোন কোন ফার্ম উৎপাদন এবং বাজার সম্পর্কে খুবই অভিজ্ঞ, আবার কোন কোন ফার্ম অনভিজ্ঞ হতে পারে। এভাবে ফার্মসমূহের খরচের মধ্যেও পার্থক্য থাকে। ইত্যাদি কারণে ফার্মসমূহের মধ্যে একাত্মরূপের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বড়, অভিজ্ঞ বা কম খরচ সম্পন্ন ফার্মসমূহ শিল্প ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করে ক্ষুদ্র ফার্মগুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করে।
৫. চাহিদারেখার অনিশ্চিত প্রকৃতি
মুষ্টিমেয় বিক্রেতাগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকায় একজনের পরিবর্তিত দামের দ্বারা অন্যজনের উপর কিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। যেমন, একটি ফার্ম দাম কমালে প্রতিযোগী ফার্মগুলো দাম কমাবে না কি অপরিবর্তিত রাখবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। আবার দাম যদি হ্রাস করে তবে তা কতটুকু হবে সেটির কোন নিশ্চয়তা নেই। দাম কমলে কোন ফার্মের বিক্রয় কতটুকু বাড়বে সে সম্পর্কে কোন নিশ্চিত ধারণা ফার্মসমূহ করতে পারে না। কারণ, কোন ফার্মের চাহিদারেখা একরূপ নয়। বিভিন্ন ফার্মের চাহিদারেখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থিতিস্থাপকতা প্রযোজ্য।
৬. দ্রব্যের প্রকৃতি
অলিগোপলি বাজারব্যবস্থার দ্রব্যসমূহ সমজাতীয় বা অসমজাতীয় হতে পারে। যদি অসমজাতীয় দ্রব্য নিয়ে অলিগোপলি বাজার গড়ে উঠে, তবে তাকে পৃথকীকৃত অলিগোপলি (Differentiated Oligopoly) বলে। এ ধরনের বাজারে উৎপাদিত দ্রব্যসমূহে গুণগত বা আকৃতিগত পার্থক্য থাকে। অন্যদিকে, সমজাতীয় দ্রব্যের বাজারকে বিশুদ্ধ অলিগোপলি (Pure oligopoly) বলে। তাই অলিগোপলি বাজারে সমজাতীয় বা অসমজাতীয় দ্রব্য থাকবে; তবে দ্রব্যসমূহ একই ধরনের প্রয়োজন মেটাবে।
৭. দামের অনমনীয়তা
অলিগোপলি বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল দামের অনমনীয়তা। দাম অনমনীয় হওয়ার কারণে উৎপাদনকারীগণ খুবই দক্ষ বা অভিজ্ঞ থাকে। তাই কোনরূপ অনিশ্চয়তা বা ঝুঁকি এড়ানোর জন্য দামের যুদ্ধে উৎপাদনকারীরা অবতীর্ণ হতে চায় না। দামের পরিবর্তন নতুন ফার্মের প্রবেশের কারণ হতে পারে। যা মুনাফা হ্রাস করবে। অলিগোপলি অনেক কষ্টে বিজ্ঞাপন খরচ করে যে ভোক্তাদেরকে নিজ দ্রব্যের অনুরোক্ত করতে সক্ষম তাদেরকে হাত ছাড়া করা তার মোটেও উদ্দেশ্য নয়। এজন্য তারা দাম পরিবর্তন না করে বিজ্ঞাপন খরচ দ্বারা বিক্রয় বাড়ানোর চেষ্টা করে। এছাড়া চুক্তিমাফিক যে দাম নির্ধারিত হয় তা হ্রাসবৃদ্ধি করে অযথা দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় না। তাই অলিগোপলি বাজারে দামের অনমনীয়তা লক্ষ্য করা যায়।