আসসালামু আলাইকুম আশা করি সকলে ভালো আছেন আজকে আমরা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব তা হচ্ছে সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য কি বা রোজা ফরজ করার উদ্দেশ্য কি। আমরা অনেকেই নিয়মিতভাবে রমজান মাসে সিয়াম পালন করে থাকি কিন্তু অনেকেই জানিনা আসলে এই সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য কি। এর গভীরের অর্থ কি। আজকে আমরা গভীরভাবে সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য কি তা জানার চেষ্টা করব। অতএব আপনি যদি সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য কি এ সম্পর্কে জানতে চান তাহলে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন। আশা করি ভালোভাবে বুঝতে পারবেন সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য মূলত কি?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক
আমরা কেন সিয়াম পালন করি?
(১) আমরা সিয়াম, সওম বা রোযা কেন রাখি? তার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কি? আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা আমাদের যতগুলো ইবাদতের নির্দেশ করেছেন তার প্রতিটি ইবাদতের কিছু প্রাথমিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য রয়েছে। আর প্রত্যেকটি ইবাদতের চড়ান্ত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা সন্তুষ্টি অর্জন করে জান্নাত নিজের করে নেওয়া। ইবাদতের প্রাথমিক যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সেটি যদি অর্জিত হয় তাহলে আমরা চড়ান্ত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যে উপনীত হতে পারব। আর যদি প্রাথমিক লক্ষ্যই আমরা অর্জন করতে ব্যর্থ হই তাহলে চড়ান্ত লক্ষ্য পর্যন্ত কোনদিনই আমরা পৌঁছাতে পারবো না।
এজন্য একজন মু’মিনের, একজন মুসলিমের প্রত্যেকটি ইবাদতের প্রাথমিক লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আমরা যখন ওযু করি, ওষু কেন করি তার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো সলাত আদায় করা এবং চড়ান্ত লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত অর্জন। এখন আমরা ওযু করলাম আর সলাত আদায় করলাম না অর্থাৎ প্রাথমিক লক্ষ্যটি আমরা অর্জন করলাম না, তাহলে এই ওষু দিয়ে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি এবং জান্নাত আমরা কোন দিনই অর্জন করতে পারব না। তেমনি ভাবে আমরা যে রমাদন মাসের সিয়াম পালন করে থাকি, এই ইবাদতের একটি বড় উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বেশির ভাগ মুসলিম ভাই বোনেরা বহু বছর ধরে সিয়াম পালন করছেন অথচ তা হয়তো খেয়ালই করেন না, কেন তারা সিয়াম পালন করছেন? সিয়ামের উদ্দেশ্যটা কি? আসুন আমরা জেনে নেই, কেন আমরা সিয়াম পালন করছি, আমাদের সিয়ামের উদ্দেশ্য কি, আর প্রাথমিক লক্ষ্যটাই বা কি?
সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য কি এই সম্পর্কে
আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন,
হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।
এই সিয়াম ফরজ করার বা বাধ্যতামূলক করার মূল উদ্দেশ্য হলো لعلكم تتقون) (যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো)।
(২) এ আয়াত থেকে আমরা জানতে পারলাম কেন আমরা সিয়াম রাখবো। এ জন্য সিয়াম পালন করবো যে সিয়ামের মাধ্যমে আমরা মুত্তাকী হতে পারবো, আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবো। আর মুত্তাকী হতে পারা ও তাকওয়া অর্জন করতে পারার মানে হলো এমন একটা চেতনা তৈরি হবে যেটা জানার ফলে আমরা আল্লাহ তা আলার ভয়ে অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারবো এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলতে পারবো। এখন আমি যদি সিয়াম কেন রাখছি সেটাই না জানি তাহলে আমার ভেতরে কিভাবে সেই তাকওয়ার চেতনা তৈরি হবে।
সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য কি এ সম্পর্কে
(৩) রসুলে করিম (সঃ) এর বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, আমাদেরকে সিয়ামের বিধানটি দেওয়া হয়েছে এ জন্য যাতে করে আমরা এই বিধানটি চর্চা করার মাধ্যমে আমাদের অন্তরের তাকওয়া জাগ্রত করতে পারি। নবী (সা) এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
যে ব্যক্তি সিয়াম রেখে অনর্থক কথা, মিথ্যা কথা, মিথ্যা কাজ, প্রতারণা এগুলো পরিহার করলো না, তো এই ব্যক্তি উপবাস থাকায় আল্লাহর কোন কাজে আসবে না। আল্লাহর কোন প্রয়োজন নাই তার উপবাশ থাকার।
অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু তাআ আলা সতর্ক করছেন, যদি কেউ সিয়াম রেখে মিথ্যা কথা বলা বা প্রতরণা করা এবং অনর্থক কাজ এগুলো পরিহার না করে তা হলে তার সিয়াম পালন করা আর উপবাশ থাকা একই কথা। এর যে মূল উদ্দেশ্য সেটা অর্জিত হলো না। এ হাদীস থেকে আমরা পরিষ্কারভাবে একটি বার্তা পাচ্ছি সেটি হলো সিয়ামের উদ্দেশ্য হলো আমাদেরকে মুত্তাকী বানানো, আমাদেরকে পরহেজগার বানানো, আল্লাহর ভয় আমাদের অন্তরে জাগ্রত করা। যার মাধ্যমে একটি শক্তি তৈরি হবে সুপথে চলার, একটি প্রেরণা তৈরি হবে সুপথে চলার এবং মন্দ পথ থেকে বেঁচে থাকার।
সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য কি
(৪) এ বিষয়ে রাসুলে করিম (সঃ) এর আরো একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে:
زب صائم حظة من صيامه الجوع
সেখানে তিনি বলেছেন, বহু রোযাদার আছেন যাদের রোযার একমাত্র বিনিময় তারা পান, তা হলো ক্ষুধার কষ্ট।
অর্থাৎ তারা রোযা রেখে শুধু ক্ষুধার কষ্টই করেন, তাদের রোযা কোন উপকারে আসে না। আমাদের কার রোযা বা সিয়াম কাকে কতটুকু মুত্তাকী বানাচ্ছে, আল্লাহ’র ভয় অন্তরে জাগ্রত করছে, ইবাদতের প্রতি অনুপ্রাণিত কতটুকু হচ্ছি, আমরা যদি আমাদের সিয়াম পালন করে এই শক্তি এবং প্রেরণা অন্তরে তৈরি করতে পারি তা হলে বুঝতে হবে আমাদের সিয়াম সার্থক হচ্ছে, প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে, ইনশা আল্লাহ চূড়ান্ত লক্ষ্য আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে জান্নাতে যাওয়া সেটাও অর্জিত হবে। আর যদি, আল্লাহ না করুক, আমাদের সিয়াম বা রোগা আমাদেরকে কোনো রূপ পরিবর্তন না করে, আমরা সিয়াম আদায় করে যেই সেই থাকছি, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের সিয়ামের প্রাথমিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য যেটি, সেটি অর্জিত হচ্ছে না।
সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য কি তা জানার সাথে সাথে আমরা জানবো
সিয়াম আমাদেরকে কীভাবে মুত্তাকী বানাবে?
(১) আমরা তো সবাই সিয়াম রাখছি কিন্তু সিয়াম রেখে আমরা মুত্তাকী হতে পারছিনা, গুনাহ ছাড়তে পারছি না, অপরাধ ছাড়তে পারছি না। এর জবাব হলো, আসলে সিয়ামের ভিতরে এক ধরণের সুপ্ত প্রেরণা আছে, যেটি আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে। সেটি হলো, আমরা যখন রোযা রাখি তখন কিন্তু পানাহার বর্জন করি। এটা মানুষের সামনে যেমন বর্জন করি মানুষের পেছনেও বর্জন করি। আপনি একজন রোযাদার, আপনার ব্যক্তিগত জীবনে আপনি যদি মিথ্যা কথা বলেনও, মানুষের সাথে প্রতারণা করেনও, রোযা রেখে আপনি যখন একাকী থাকছেন বন্ধ ঘরে, সেখানে আপনার পিপাসা লাগলেও আপনি পানি পান করছেন না, আপনি ক্ষুধার্ত হলেও আপনি কিন্তু কিছু খাচ্ছেন না।
কেউ দেখছে না, তারপরও খাচ্ছেন না। কেন খাচ্ছেন না? কারণ কেউ না দেখলে কি হবে, আল্লাহ তাআলা দেখছেন। তাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে আপনি কিন্তু পানাহার থেকে বিরত থাকছেন। এই চেতনা টুকু আপনার ভেতরে আসা উচিত যে, আমি ইচ্ছা করলে খেতে পারি, পান করতে পারি কিন্তু রোযা রেখে আমি যে আল্লাহ তা’আলার ভয়ে খাচ্ছি না, পান করছি।
না- একইভাবে তো আমার অন্যায় কাজগুলো যখন আমি করছি তখনও তো আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা আমাকে দেখছেন এবং সেগুলো থেকে তো আল্লাহ তা আলা নিষেধ করেছেন। বরং রমাদন মাসে খাদ্য গ্রহণ করা- এটাতো কোন হারাম জিনিস নয়। এটাকে যে আল্লাহ তা’আলা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হারাম করে দিয়েছেন, তাহলে অন্যান্য হারাম কাজগুলোতে লিপ্ত হওয়া কত জঘন্য অপরাধ হতে পারে। আল্লাহ’র ভয় অন্তরে জাগ্রত হওয়া, এখান থেকে একটা শিক্ষা নিজের ভিতর আনা আর এটাই হলো সিয়ামের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।
সেজন্য আল্লাহ সুবাহানাহু তা’আলা শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলেছেন। আমরা জানি আমাদের বাসা বাড়িতে আমাদের ছেলে মেয়েরা, ছোট বাচ্চারা, নিজেদের মধ্যে, ভাই-বোন যদি কখনো ঝগড়াঝাটি হয়, একে অন্যকে কুপোকাত করার চেষ্টা করে, যে ছোট থাকে, মা-বাবা অনেক সময় তাকে সুযোগ করে দেয় বড় জনকে। কোনভাবে পরাস্ত করবার জন্য।
অনেক সময় হয়তো হাত ধরে রাখে যাতে করে ছোটজন ১/২ টা কিল ঘুষি দিয়ে হলেও কোনভাবে বড় ভাইকে হারানোর যে তৃপ্তি সেটা অনুভব করতে পারে। কারণ সে কখনোই বড় ভাইয়ের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারে না। আমরা ঠিক এমনিভাবে শয়তানের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারিনা, সে আমাদেরকে প্ররোচিত করে অন্যায়ের পথে নিয়ে যায়, আল্লাহ তা’আলা রমাদনের একটা মাস শয়তানকে বেঁধে রাখেন যাতে করে আমারা ভালো কাজ করতে পারি।
(২) কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, আল্লাহ তা’আলা যদি শয়তানকে বেঁধেই রাখেন তাহলে রমাদন মাসেও মানুষ কিভাবে অপকর্ম করে? এর উত্তর হলো, আসলে আমরা অপকর্ম শুধু শয়তানের মাধ্যমেই করি তা নয়, আমাদের প্রবৃত্তির মাধ্যমেও আমরা অপকর্ম করি। অতএব একটাকে বেঁধে রাখলে কি হবে, প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ কিছু অপকর্ম করে। তারপরেও ঈমানদার এবং সওম পালনকারীগণ রমাদন মাসে সাধারণত গুনাহ থেকে অনেকখানি বেঁচে থাকে।
সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে
মুসনাদে আহমাদের ১৫২৬৪ নম্বর হাদীসে এসেছে, রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
إنما الضيام جنة
আমরা রমাদন মাসে যে সিয়াম রাখি বা সারা বছর যে সিয়াম রাখি, এটা কিন্তু ঢালের মত। মানুষকে ঢাল যেমন অন্যায় থেকে অপরাধ থেকে বা অনেক বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে- সিয়ামও সেগুলো থেকে মানুষকে রক্ষা কর
সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্য কি তা জানার পাশাপাশি আমরা এখন জানবো
সিয়াম হতে আমরা কীভাবে তাকওয়া অর্জন করবো?
অতএব সওম বা সিয়াম এর মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা। প্রতিদিন সওম শেষে আপনাকে যোগ-বিয়োগ করতে হবে, হিসাব মিলাতে হবে যে আপনার ভেতর তাকওয়া আসছে কিনা। আপনার ভিতর গুনাহ ত্যাগের স্পৃহা এবং প্রেরণা তৈরি হচ্ছে কি না।
যদি হয় তাহলে বোঝাবেন আপনার তাকওয়া, আপনার রমাদনের সিয়াম সার্থক হচ্ছে ও সফল হচ্ছে, এবং আপনার সিয়ামের প্রাথমিক লক্ষ্য পূর্ণ হচ্ছে। আমরা দিনের বেলায় পানাহার করে খাচ্ছি না যে আল্লাহর ভয়ে, সে আল্লাহর ভয়ে অন্যান্য অপকর্মগুলো থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। এই প্রেরণা, এই স্পৃহা আমাদের রমাদনের সিয়াম থেকে, সারা বছরের সিয়াম থেকে নিতে হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য অনুধাবন করে নিয়মিত আদায় করার মতো তৌফিক দান করুন।