আলহামদুলিল্লাহ আসসালাতু আসসালামু আলা রাসূলিল্লাহি। সম্মানিত পাঠক আজ আমরা কোরআনের হৃদপিণ্ড বা মা বলা হয়েছে এমন একটি সূরার ফজিলত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। এবং এই সুরা ইয়াসিন এর ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে কি কি বলা হয়েছে তা জানবো। সাথে সাথে এই সুরা ইয়াসিন এর ফজিলত সম্পর্কে বিখ্যাত সাহাবী এবং মনীষীগণ, এবং বিভিন্ন তাফসিরের গ্রন্থে কি বলা হয়েছে তাও জেনে নেব ইনশাআল্লাহ।
সূরাটির নাম হচ্ছে সূরা ইয়াসিন । সুরা ইয়াসিন এর ফজিলত
সুরা ইয়াসিন এর ফজিলত : হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসারের (রাঃ) রেওয়ায়েতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, يس قلب القران অর্থাৎ, সুরা ইয়াসীন কোরআনের হৃদপিণ্ড। এ হাদীসে আরও আছে যে, যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসীন আল্লাহ ও পরকালের কল্যাণ লাভের নিয়তে পাঠ করে, তার মাগফেরাত হয়ে যায়। তোমরা তোমাদের মৃতদের উপর এ সূরা পাঠ কর। – (রুহুল মা’আনী, মাযহারী)
ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেন, সূরা ইয়াসীনকে কোরআনের হৃদপিণ্ড বলার কারণ এমনও হতে পারে যে, এ সূরায় কেয়ামত ও হাশর-নশরের বিষয় বিশদ ব্যাখ্যা ও অলংকার সহকারে বর্ণিত হয়েছে। পরকালে বিশ্বাস ঈমানের এমন একটি মূলনীতি, যার উপর মানুষের সকল আমল ও আচরণের বিশুদ্ধতা নির্ভরশীল। পরকালভীতিই মানুষকে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করে এবং অবৈধ বাসনা ও হারাম কাজ থেকে বিরত রাখে। অতএব দেহের সুস্থতা যেমন অন্তরের সুস্থতার উপর নির্ভরশীল তেমনি ঈমানের সুস্থতা পরকাল চিন্তার উপর নির্ভরশীল। (রুহুল মা’আনী) এ সূরার নাম যেমন সূরা ইয়াসীন প্রসিদ্ধ, তেমন এক হাদীসে এর নাম “আযীমা”ও বর্ণিত আছে। অপর এক হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, তওরাতে এ সূরার নাম “মুয়িম্মাহ” বলে উল্লেখিত আছে। অর্থাৎ, এ সূরা তার পাঠকের জন্যে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ ও বরকত ব্যাপক করে দেয়। এ সুরার পাঠকের নাম “শরীফ” বর্ণিত আছে। আরও বলা হয়েছে যে, কেয়ামতের দিন এর সুপারিশ “রবীয়া” গোত্র অপেক্ষা অধিকসংখ্যক লোকের জন্যে কবুল হবে। কতক রেওয়ায়েতে এর নাম “মুদাফিয়াও” বর্ণিত আছে অর্থাৎ এ সূরা তার পাঠকদের থেকে বালা-মুসিবত দূর করে। কতক রেওয়ায়েতে এর নাম “কাযিয়া” ও উল্লেখিত হয়েছে অর্থাৎ এ সূরা পাঠকের প্রয়োজন মিটায়। — (ৱহুল মা’আনী)
সুরা ইয়াসিন এর ফজিলত সম্পর্কে হযরত আবু যর (রাঃ) বর্ণনা করেন, মরন্নোমুখ ব্যক্তির কাছে সূরা ইয়াসীন পাঠ করা হলে তার মৃত্যু সহজ হয়। – – (মাযহারী)
সুরা ইয়াসিন এর ফজিলত সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) বলেন, যদি কোন ব্যক্তি সূরা ইয়াসীন তার অভাব অনটনের বেলায় পাঠ করে, তবে তার অভাব পূরণ হয়ে যায়। -(মাযহারী)
সুরা ইয়াসিন এর ফজিলত সম্পর্কে ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর বলেন, যে ব্যক্তি সকালে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে, সে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুখে স্বস্তিতে থাকবে এবং যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় পাঠ করবে, সে সকাল পর্যন্ত শাস্তিতে থাকবে। তিনি আরও বলেন, আমাকে এ বিষয়টি এমন এক ব্যক্তি বলেছেন, যিনি এর বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন।- (মাযহারী)
يس শব্দ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ উক্তি এই যে, এটা খন্ড বাক্য। এর অর্থ আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। তফসীরের সার-সংক্ষেপে এ কথাই বলা হয়েছে। আহকামূল-কোরআনে বর্ণিত ইমাম মালেকের উক্তি এই যে, এটা আল্লাহ তাআলার অন্যতম নাম। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকেও এক রেওয়ায়েতে তাই বর্ণিত রয়েছে। অপর এক রেওয়ায়েতে আছে যে, এটা আবিসিনীয় শব্দ। এর অর্থ “হে মানুষ” আর এখানে মানুষ বলে নবী করীম (সাঃ)-কে বোঝানো হয়েছে। হযরত ইবনে জুবায়েরের (রাঃ) বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ” ইয়াসীন” রসূলূল্লাহ (সাঃ)-এর নাম। রুহুল মা’আনীতে আছে, ইয়া ও সীন এ দু’টি অক্ষর নবী করী (সঃ)-এর নাম রাখার মধ্যে বিরাট রহস্য নিহিত।
ইয়াসীন কারও নাম রাখা কিরূপ ?
ইমাম মালেক এটা পছন্দ করেননি। কারণ, তাঁর মতে এটা আল্লাহ্ তাআলার অন্যতম নাম এবং এর সঠিক অর্থ জানা নেই। কাজেই এর অর্থ i ও ii এর ন্যায় আল্লাহ্ তাআলার বৈশিষ্ট্যমূলক কোন নাম হওয়াও সম্ভব। তবে শব্দটি ৬ বর্ণমালার মাধ্যমে লেখা হলে তা কারও নাম রাখা জায়েয। কারণ, سلام على ال ياسين কোরআনে উল্লেখিত আছে। (ইবনে আরাবী)
(৩৬-ইয়াসিন) নামকরণ:
যে দু’টি হরফ দিয়ে সূরার সূচনা করা হয়েছে। তাকেই এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
(৩৬-ইয়াসিন) :
নাযিলের সময় কাল :বর্ণনাভঙ্গী দেখে অনুভব করা যায়, এ সূরার নাযিল হবার সময়টি হবে নবী করীমের নবুওয়াত লাভ করার পর মক্কায় অবস্থানের মধ্যবর্তী যুগের শেষের দিনগুলো। অথবা এটি হবে তাঁর মক্কায় অবস্থানের একেবারে শেষ দিনগুলোর একটি সূরা।
(৩৬-ইয়াসিন): বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয় :
কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের মুহাম্মাদ এর নবুওয়াতের ওপর ঈমান না আনা এবং জুলুম ও বিদ্রূপের মাধ্যমে তার মোকাবিলা করার পরিণামের ভয় দেখানোই এ আলোচনার লক্ষ্য। এর মধ্যে ভয় দেখানোর দিকটি প্রবল ও সুস্পষ্ট। কিন্তু বার বার ভয় দেখানোর সাথে যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিষয়বস্তু বুঝাবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
- তিনটি বিষয়ের ওপর যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে:
- তাওহীদের ওপর বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনাবলী ও সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে।
- আখেরাতের ওপর বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনাবলী, সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তি ও মানুষের
- নিজের অস্তিত্বের সাহায্যে।
মুহাম্মাদী নবুওয়াতের সত্যতার ওপর একথার ভিত্তিতে যে, তিনি নিজের রিসালাতের ক্ষেত্রে এ সমস্ত কষ্ট সহ্য করেছিলেন নি:স্বার্থভাবে এবং এ বিষয়ের ভিত্তিতে যে, তিনি লোকদেরকে যেসব কথার প্রতি আহবান জানাচ্ছিলেন সেগুলো পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত ছিল এবং সেগুলো গ্রহণ করার মধ্যেই ছিল লোকদের নিজেদের কল্যাণ।
এ যুক্তি প্রদর্শনের শক্তির ওপর ভীতি প্রদর্শন এবং তিরস্কার ও সতর্ক করার বিষয়বস্তু অত্যন্ত জোরে শোরে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে হৃদয়ের তালা খুলে যায় এবং যাদের মধ্যে সত্যকে গ্রহণ করার সামান্যতম যোগ্যতাও আছে তারা যেন কুফরীর ওপর বহাল থাকতে না পারে।
ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও তাবারানী প্রমুখগণ মা’কাল ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী বলেন, يس قلب القران অর্থাৎ এ ইয়া-সীন সূরাটি কুরআনের হৃদয়। এটি ঠিক তেমনই একটি উপমা যেমন সূরা ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন বলা হয়েছে। ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন গণ্য করার কারণ হচ্ছে এই যে, তার মধ্যে কুরআন মজীদের সমস্ত শিক্ষার সংক্ষিপ্তসার এসে গেছে। অন্যদিকে ইয়াসীনকে কুরআনের স্পন্দিত হৃদয় বলা হয়েছে এজন্য যে, কুরআনের দাওয়াতকে সে অত্যন্ত জোরেশোরে পেশ করে, যার ফলে জড়তা কেটে যায় এবং প্রাণপ্রবাহ গতিশীল হয়।
এই হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার থেকেই হযরত ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন যে, নবী বলেন,l “তোমাদের মৃতদের ওপর সূরা ইয়াসীন পাঠ করো।” এর পেছনে যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা হচ্ছে এই যে, এর মাধ্যমে মরার সময় মুসলমানের অন্তরে কেবলমাত্র ইসলামী আকীদা বিশ্বাসই তাজা হয়ে যায় না বরং বিশেষভাবে তার সামনে আখেরাতের পূর্ণ চিত্রও এসে যায় এবং সে জানতে পারে দুনিয়ার জীবনের মনযিল অতিক্রম করে এখন সামনের দিকে কোন্ সব মনযিল পার হয়ে তাকে যেতে হবে। এ কল্যাণকারিতাকে পূর্ণতা দান করার জন্য আরবী জানে না এমন ব্যক্তিকে সূরা ইয়াসীন শুনাবার সাথে সাথে তার অনুবাদও শুনিয়ে দেয়া উচিত। এভাবে উপদেশ দান ও স্মরণ করিয়ে দেবার হক পুরোপুরি আদায় হয়ে যায়।
সুরা ইয়াসিন এর ফজিলত শেষ কথা
অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি সূরা হচ্ছে সূরা ইয়াসিন আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এর মর্তবা বুঝে উপকারিতা বুঝে নিয়মিত পাঠ করার মত তৌফিক দান করুন আমীন