সূরা কাহাফের ফজিলত

আসসালামু আলাইকুম আজকে আমরা পবিত্র কুরআনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সূরা সূরা কাহাফ এর ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব এবং জানার চেষ্টা করব বিভিন্ন হাদিসের গ্রন্থে সূরা কাহাফ এর ফজিলত সম্পর্কে কি বর্ণিত হয়েছে এবং বিভিন্ন তাফসীরের গ্রন্থে ইমামগণ এই সূরার ফজিলত সম্পর্কে কি কি উল্লেখ করেছেন এবং এই সূরার নামকরণের কারণ নাযিলের সময়কাল এবং আলোচনার বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য কি তার সবকিছুই আমরা আলোচনা করব আশা করি আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়বেন তাহলে বিস্তারিতভাবে সবকিছু জানতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।

প্রথমে জেনে নেওয়া যাক সূরা কাহাফ এর ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য।

সূরা কাহফের ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য : মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও মুসনাদে আহমদে হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করে, সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। উল্লেখিত গ্রন্থসমূহে হযরত আবুদ্দারদা থেকেই অপর একটি রেওয়ায়েতে এই বিষয়বস্তু সূরা কাহফের শেষ দশ আয়াত মুখস্থ করা সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে।

মুসনাদে আহমদে হযরত সাহল ইবনে মু’আমের রেওয়ায়েতে আছে যে, রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন : যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম ও শেষ আয়াতগুলো পাঠ করে, তার জন্যে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটি নূর হয়ে যায় এবং যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ সূরা পাঠ করে, তার জন্যে যমীন থেকে আসমান পর্যন্ত নূর হয়ে যায়।

সূরা কাহাফের ফজিলত সম্পর্কে

কোন কোন রেওয়ায়েতে বর্ণিত রয়েছে, যে ব্যক্তি শুক্রবার দিন সূরা কাহফ তেলাওয়াত করে, তার পা থেকে আকাশের উচ্চতা পর্যন্ত নূর হয়ে যাবে, যা কেয়ামতের দিন আলো দেবে এবং বিগত জুমআ থেকে এই জুমআ পর্যন্ত তার সব গোনাহ্ মাফ হয়ে যাবে। – (ইমাম ইবনে কাসীর এই রেওয়ায়েতটিকে মওকুফ বলেছেন)

হাফেয জিয়া মুকাদ্দাসী ‘মুখতারাহ্’ গ্রন্থে হযরত আলী (রাঃ)-এর রেওয়ায়েতে বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ যে ব্যক্তি জুমআর দিন সূরা কাহফ পাঠ করবে, সে আট দিন পর্যন্ত সর্বপ্রকার ফেৎনা থেকে মুক্ত থাকবে। যদি দাজ্জাল বের হয়, তবে সে তার ফেৎনা থেকেও মুক্ত থাকবে। (এসব রেওয়ায়েত ইবনে কাসীর থেকে গৃহীত।)

সূরা কাহাফ এর ফজিলত সম্পর্কে

রূহুল মা’আনীতে হযরত আনাস (রাঃ)-এর বর্ণিত রেওয়ায়েতে রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : সুরা কাহফ সম্পূর্ণটুকু এক সময়ে নাযিল হয়েছে, এবং সত্তর হাজার ফেরেশতা এর সঙ্গে আগমন করেছেন। এতে এর মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়।

এতক্ষণ আমরা সূরা কাহাফ এর ফজিলত জানলাম।

(১৮- কাহাফ : নামকরণ:

প্রথম রুকূ’র ৯ আয়াত اذ اوي الفتية الى الكهف থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ নাম দেবার মানে হচ্ছে এই যে, এটা এমন একটা সূরা যার মধ্যে আল কাহফ শব্দ এসেছে।

(১৮-কাহাফ : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এখান থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের তৃতীয় অধ্যায়ে অবতীর্ণ সূরাগুলো শুরু হচ্ছে। মক্কী জীবনকে আমি চারটি বড় বড় অধ্যায়ে ভাগ করেছি। সূরা আন’আমের ভূমিকায় এর বিস্তারিত বিবরণ এসে গেছে। এ বিভাগ অনুযায়ী তৃতীয় অধ্যায়টি প্রায় ৫ নববী সন থেকে শুরু হয়ে ১০ নববী সন পর্যন্ত বিস্তৃত। পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর মোকাবিলায় এ অধ্যায়টির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, পূর্ববর্তী অধ্যায় দু’টিতে কুরাইশরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর আন্দোলন ও জামায়াতকে বিপর্যস্ত করার জন্য বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উপহাস, ব্যাংগ-বিদ্রূপ, আপত্তি, অপবাদ, দোষারোপ, ভীতি প্রদর্শন, লোভ দেখানো ও বিরুদ্ধ প্রচারণার ওপর নির্ভর করছিল। কিন্তু এ তৃতীয় অধ্যায়ে এসে তারা জুলুম, নিপীড়ন, মারধর ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির অস্ত্র খুব কড়াকড়িভাবে ব্যবহার করে। এমনকি বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে দেশ ত্যাগ করে হাবশার দিকে যেতে হয়।

আর বাদবাকি মুসলমানদের এবং তাদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবার ও বংশের লোকদের আবু তালেব গিরি গুহায় পূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কটের মধ্যে অবরুদ্ধ জীবন যাপন করতে হয়। তবুও এ যুগে আবু তালেব ও উমমূল মু’মিনীন হযরত খাদীজার (রা.) ন্যায় দু’ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রভাবের ফলে কুরাইশদের দু’টি বড় বড় শাখা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পৃষ্ঠপোষকতা করছিল। ১০ নববী সনে এ দু’জনের মৃত্যুর সাথে সাথেই এ অধ্যায়টির সমাপ্তি ঘটে। এরপর শুরু হয় চতুর্থ অধ্যায়। এ শেষ অধ্যায়ে মুসলমানদের মক্কায় জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনকি শেষ পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমস্ত মুসলমানদের নিয়ে মক্কা ত্যাগ করতে হয়। সূরা কাহফের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায়, মক্কী যুগের এ তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুতেই এ সূরাটি নাযিল হয়ে থাকবে। এ সময় জুলুম-নিপীড়ন, বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তখনো মুসলমানরা হাবশায় হিজরত করেনি। তখন যেসব মুসলমান নির্যাতিত হচ্ছিল তাদেরকে আসহাবে কাহফের কাহিনী শুনানো হয়, যাতে তাদের হিম্মত বেড়ে যায় এবং তারা জানতে পারে যে, ঈমানদাররা নিজেদের ঈমান বাঁচাবার জন্য ইতিপূর্বে কি করেছে। (১৮-কাহাফ)

সূরা কাহাফের ফজিলত সম্পর্কে বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :

মক্কার মুশরিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরীক্ষা নেবার জন্য আহলি কিতাবদের পরামর্শক্রমে তাঁর সামনে যে তিনটি প্রশ্ন করেছিল তার জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়। প্রশ্ন তিনটি ছিলঃ এক, আসহাবে কার্ফ কারা ছিলেন? দুই, খিযিরের ঘটনাটি এবং তার তাৎপর্য কি?১ তিন, যুলকারনাইনের ঘটনাটি কি? এ তিনটি কাহিনীই খৃস্টান ও ইহুদীদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত ছিল। হিজাযে এর কোন চর্চা ছিল না। তাই আহলি কিতাবরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সত্যিই কোন গায়েবী ইলমের মাধ্যম আছে কিনা তা জানার জন্যই এগুলো নির্বাচন করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তাঁর নবীর মুখ দিয়ে কেবল এগুলোর পূর্ণ জবাব দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং এ সংগে এ ঘটনা তিনটিকে সে সময় মক্কায় কুফর ও ইসলামের মধ্যে যে অবস্থা বিরাজ করছিল তার সাথে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে দিয়েছেন।

১. হাদীসে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল রূহ সম্পর্কে। বনী ইসরাঈলের ১০ রুকূ’তে এর জবাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু সূরা কাফ ও বনী ইসরাঈলের নাযিলের সময়কালের মধ্যে রয়েছে কয়েক বছরের ব্যবধান। আর সূরা কাহফে দু’টির জায়গায় তিনটি কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আমার মতে, দ্বিতীয় প্রশ্নটি হযরত খিযির সম্পর্কেই ছিল, রূহ সম্পর্কে নয়। খোদ কুরআনেই এমনি একটি ইশারা আছে, তা থেকে আমার এ অভিমতের প্রতি সমর্থন পাওয়া যাবে।

একঃ আসহাবে কাহ্ফ সম্পর্কে বলেন, এ কুরআন যে তাওহীদের দাওয়াত পেশ করছে তারা ছিলেন তারই প্রবক্তা। তাদের অবস্থা মক্কার এ মুষ্টিমেয় মজলুম মুসলমানদের অবস্থা থেকে এবং তাদের জাতির মনোভাব ও ভূমিকা মক্কার কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের ভূমিকা থেকে ভিন্নতর ছিল না। তারপর এ কাহিনী থেকে ঈমানদারদেরকে এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, যদি কাফেররা সীমাহীন ক্ষমতা ও আধিপত্যের অধিকারী হয়ে গিয়ে থাকে তাদের জুলুম-নির্যাতনের ফলে সমাজে একজন মু’মিন শ্বাস গ্রহণ করারও অধিকার হারিয়ে বসে তবুও তার বাতিলের সামনে মাথা নত না করা উচিত বরং আল্লাহর ওপর ভরসা করে দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত। এ প্রসংগে আনুসংগিকভাবে মক্কার কাফেরদেরকে একথাও বলা হয়েছে যে, আসহাবে কাহফের কাহিনী আখেরাত বিশ্বাসের নির্ভুলতার একটি প্রমাণ। যেভাবে আল্লাহ তা’আলা আসহাবে কাহকে সুদীর্ঘকাল মৃত্যু নিদ্রায় বিভোর করে রাখার পর আবার জীবিত করে তোলেন ঠিক তেমনিভাবে মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন মেনে নিতে তোমরা অস্বীকার করলে কি হবে, তা আল্লাহর ক্ষমতার বাইরে নয়।

দুইঃ মক্কার সরদার ও সচ্ছল পরিবারের লোকেরা নিজেদের জনপদের ক্ষুদ্র নও মুসলিম জামায়াতের ওপর যে জুলুম-নিপীড়ন চালাচ্ছিল এবং তাদের সাথে ঘৃণা ও লাঞ্ছনাপূর্ণ আচরণ করছিল আসহাবে কাহফের কাহিনীর পথ ধরে সে সম্পর্কে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। এ প্রসংগে একদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই মর্মে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, এ জালেমদের সাথে কোন আপোস করবে না এবং নিজের গরীব সাথীদের মোকাবিলায় এ বড় লোকদের মোটেই গুরুত্ব দেবে না । অন্যদিকে এ ধনী ও সরদারদেরকে এ মর্মে নসীয়ত করা হয়েছে যে, নিজেদের দু’দিনের আয়েশী জীবনের চাকচিক্য দেখে ভুলে যেয়ো না বরং চিরন্তন ও চিরস্থায়ী কল্যাণের সন্ধান করো।

তিনঃ এ আলোচনা প্রসংগে খিযির ও মূসার কাহিনীটি এমনভাবে শুনিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তাতে কাফেরদের প্রশ্নের জবাবও এসে গেছে এ সংগে মু’মিনদেরকেও সরবরাহ করা হয়েছে সান্তনার সরঞ্জাম। এ কাহিনীতে মূলত যে শিক্ষা দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, যেসব উদ্দেশ্য ও কল্যাণকারিতার ভিত্তিতে আল্লাহর এ বিশাল সৃষ্টিজগত চলছে তা যেহেতু তোমাদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়েছে তাই তোমরা কথায় কথায় অবাক হয়ে প্রশ্ন করো, এমন কেন হলো? এ কি হয়ে গেলো? এ-তো বড়ই ক্ষতি হলো! অথচ যদি পর্দা উঠিয়ে দেয়া হয় তাহলে তোমরা নিজেরাই জানতে পারবে এখানে যা কিছু হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে এবং বাহ্যত যে জিনিসের মধ্যে ক্ষতি দেখা যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত তার ফলশ্রুতিতে কোন না কোন কল্যাণই দেখা যায়।

চারঃ এরপর যুলকারনাইনের কাহিনী বলা হয়। সেখানে প্রশ্নকারীদেরকে এ শিক্ষা দেয়া হয় যে, তোমরা তো নিজেদের এ সামান্য সরদারীর মোহে অহংকারী হয়ে উঠেছো অথচ যুলকারণাইনকে দেখো। কত বড় শাসক। কত জবরদস্ত বিজেতা। কত বিপুল বিশাল উপায় উপকরণের মালিক হয়েও নিজের স্বরূপ ও পরিচিত বিস্মৃত হননি। নিজের স্রষ্টার সামনে সবসময় মাথা হেঁট করে থাকতেন। অন্যদিকে তোমরা নিজেদের এ সামান্য পার্থিব বৈভব ও ক্ষেত খামারের শ্যামল শোভাকে চিরস্থায়ী মনে করে বসেছো। কিন্তু তিনি দুনিয়ার সবচেয়ে মজবুত ও সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করেও মনে করতেন সর্বাবস্থায় একমাত্র আল্লাহর ওপরই নির্ভর করা যেতে পারে, এ প্রাচীরের ওপর নয়। আল্লাহ যতদিন চাইবেন ততদিন এ প্রাচীর শত্রুদের পথ রোধ করতে থাকবে এবং যখনই তাঁর ইচ্ছা ভিন্নতর হবে তখনই এ প্রাচীরে ফাটল ও গর্ত ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।

এভাবে কাফেরদের পরীক্ষামূলক প্রশ্নগুলো তাদের ওপরই পুরোপুরি উল্টে দেবার পর বক্তব্যের শেষে আবার সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, বক্তব্য শুরু করার সময় যা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ তাওহীদ ও আখেরাত হচ্ছে পুরোপুরি সত্য। একে মেনে নেয়া, সে অনুযায়ী নিজেদের সংশোধন করা এবং আল্লাহর সামনে নিজেদের জবাবদিহি করতে হবে বলে মনে করে দুনিয়ায় জীবন যাপন করার মধ্যেই তোমাদের নিজেদের মংগল। এভাবে না চললে তোমাদের নিজেদের জীবন ধ্বংস হবে এবং তোমাদের সমস্ত কার্যকলাপও নিষ্ফল হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *