রোজা কাকে বলে | রোজা কী

রোজাকে আরবি ভাষায় সাওম বলা হয়, যার শাব্দিক অর্থ চুপ থাকা, বিরত থাকা। ইসলামী পরিভাষায় রোজার প্রকৃত অর্থ ও মর্ম হচ্ছে, নফসের খাহেশ ও আশা-আকাক্সক্ষাকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সংযত রাখা এবং লোভ-লালসা থেকে নিজের দেহ-মন-প্রাণকে বিরত রাখা। সাধারণত নফসানী খাহেশ এবং মানবিক লোভ-লালসা ও উচ্চাকাক্সক্ষা বিকাশস্থল হচ্ছে তিনটি। যথা- খাদ্য, পানীয় এবং নারী। এই তিনটি উপকরণ এবং উপায় থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দৈহিক ও আত্মিক সম্পর্ক সংযত ও সুসংহত রাখার নামই শরীয়ত মোতাবেক রোজা।

কুরআনুল কারীমের আয়াতসমূহে সুস্পষ্টভাবে এ কথা তুলে ধরা হয়েছে যে, বর্তমান ইসলামের সাথেই শুধু কেবল রোজার সম্পৃক্ততা সুনির্দিষ্ট নয়; বরং কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী মাযহাবগুলোতেও রোজাকে ধর্মের বিশেষ অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অন্ধকার যুগের আরবদের সামনে রাসূলুল্লাহ সা. উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসের মাঝে রোজা অবশ্যই ফরজ ইবাদত হিসেবে পরিগণিত ছিল। কিন্তু তৎকালীন আরবের বিরুদ্ধবাদী সম্প্রদায় এমনকি বর্তমান যুগের কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তিও মনে করেন, রাসূলুল্লাহ সা. প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সা.-এর দাবি যদি সর্বাংশে সত্য ও যথার্থ বলে প্রতিপন্ন হয় তাহলে এ কথা মেনে নিতে দ্বিধা-সংকোচের অবকাশ মোটেই থাকবে না যে, তিনি উপাদানভিত্তিক জ্ঞানবত্তার ঊর্ধ্ব পরিমণ্ডলে অবশ্যই অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই দাবির সত্যতা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে ইউরোপের অধিক প্রামাণ্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি আমরা পেশ করছি, যা অনুসন্ধানীদের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবে। ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার রোজার প্রবন্ধ লেখক উল্লেখ করেছেন, ‘রোজার বিধিবিধান ও আদায় পদ্ধতি, আবহাওয়া, সামাজিক ব্যবস্থা এবং সভ্যতা বিবর্তনের দরুন যদিও বিভিন্ন রূপ পরিদৃষ্ট হয় তথাপি আমরা অতি কষ্টে এমন কোনো ধর্মের নাম উপস্থাপন করতে পারব না, যেখানে রোজাকে ধর্মীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করা হয়নি।’ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘বস্তুত রোজা একটি ধর্মীয় প্রথা হিসেবে সকল স্থানেই স্বীকৃত আছে।’

ভারতবর্ষকে ধর্মবিকাশের সবচেয়ে পুরাতন স্থান হিসেবে দাবি করা হয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই ব্রত অর্থাৎ রোজা থেকে এখানকার ধর্মগুলোও বিমুক্ত ছিল না। ভারতীয় বর্ষপঞ্জিতে প্রতি মাসের এগারো ও বার তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর একাদশীর রোজা অপরিহার্য ছিল। এই হিসাব অনুসারে বার মাসে সর্বমোট ২৪টি রোজা পাওয়া যায়। কোনো কোনো ব্রাহ্মণ কার্তিক মাসে প্রত্যেক সোমবারে রোজাব্রত পালন করে। হিন্দু যোগীরা চিল্লা পালন করে অর্থাৎ তারা চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহার বর্জন করে উপোস থাকার প্রচেষ্টা চালায়। ভারতবর্ষের সকল ধর্মমতে বিশেষ করে জৈন ধর্মের মাঝে রোজা পালনের শর্তাবলি অত্যন্ত কঠিন। তাদের মতানুসারে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ১টি রোজা প্রলম্বিত হয়। গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যে প্রতি বছর জৈন ধর্মের অনুসারীরা কয়েক সপ্তাহ যাবৎ রোজা ব্রত পালন করে। প্রাচীন মিসরীয়দের মাঝেও রোজাকে অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির অন্তর্ভুক্ত দেখা যায়। গ্রিক ধর্মানুসারীদের মাঝে শুধু কেবল মহিলারা থাসমো ফেরিয়া-এর ৩ তারিখে রোজা রাখত। পার্শিয়ান ধর্মে যদিও সাধারণ অনুসারীদের ওপর রোজা ফরজ নয়, কিন্তু তাদের ইলহামী কিতাবের একটি শ্লোক দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাদের ওপর রোজার হুকুম প্রযোজ্য ছিল। বিশেষ করে ধর্মীয় নেতাদের জন্য পাঁচ বছর রোজা রাখা আবশ্যক ছিল। (ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা : ১০ম খন্ড, ১৯৩-৯৪ পৃষ্ঠা, একাদশ সংস্করণ)। ইহুদিদের মাঝেও রোজা ছিল আল্লাহর আরোপিত ফরজ ইবাদত। হযরত মুসা আ. কুহে তুরে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ক্ষুৎ-পিপাসার ভেতর দিয়ে অতিবাহিত করেন। (নির্গমন : ৩৪-৩৮)। সুতরাং সাধারণভাবে হযরত মুসা আ.-এর অনুসারীদের মাঝে চল্লিশ দিন রোজা রাখাকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু তাদের ওপর চল্লিশতম দিনে রোজা রাখা ফরজ, যা তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ পড়ত। (তৌরাত: সফরুল আহবার: ১৬-২৯-৩৪ : ২৩-২৭)। এ জন্য এই দশম দিনকে আশুরা বলা হতো। আর আশুরার এই দিনটি ছিল ঐ দিন যেদিন হযরত মুসা আ.-কে তৌরাতের ১০টি আহকাম দান করা হয়েছিল। এজন্য তৌরাত কিতাবে এইদিনের রোজা পালন করার প্রতি জোর তাকিদ করা হয়েছে। হযরত ঈসা আ.ও চল্লিশ দিন পর্যন্ত জঙ্গলে অবস্থান করে রোজা রেখেছেন। (মথি : ৪-২)। হযরত ইয়াহইয়া আ. যিনি হযরত ঈসা আ.-এর সমসাময়িক ছিলেন, তিনিও রোজা রাখতেন এবং তার উম্মতগণের মাঝেও রোজা রাখার রীতির প্রচলন ছিল। (মার্কস : ২-১৮)।

আরববাসীরা ইসলামের পূর্বে রোজা সম্পর্কে কম-বেশি ওয়াকিবহাল ছিল। মক্কার কোরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ মুহররম) দিনে এ জন্য রোজা রাখত যে, এই দিনে খানায়ে কাবার ওপর নতুন গেলাফ চড়ানো হতো। (মুসনাদে ইবনে হাম্বল : ষষ্ঠ খন্ড, ২৪৪ পৃ:)। মদীনায় বসবাসকারী ইহুদিরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করত। (সহীহ বুখারী : কিতাবুস সাওম, ১ম খন্ড, ১৬২ পৃ:)। অর্থাৎ ইহুদিরা নিজেদের গণনানুসারে ৭ম মাসের ১০ম দিনে রোজা রাখত।

কুরআনুল কারীমে সিয়াম সাধনার সকল হাকীকত ও মানদন্ডকে শুধুমাত্র একটি শব্দের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সে শব্দটি হলো তাকওয়া বা পরহেজগারী। রোজার হাকীকত ও বিশেষত্বসুলভ তাকওয়া ও পরহেজগারী পৃথিবীর সকল ধর্মেই একইভাবে অবলম্বন করা হয়েছে।

এ কারণে কুরআনুল কারীম ও অন্য ধর্মগুলোকে রোজার এই অভ্যন্তরীণ হাকীকতের সাথে সম্পৃক্ত করে ঘোষণা করেছে, ‘তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল যাতে করে তোমরা তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করতে পার।’ (সূরা বাকারাহ: রুকু ২৩)।

প্রকৃতপক্ষে রোজার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করা। অর্থাৎ নিজের খাহেশাতকে নিজের আওতাভুক্ত রাখা এবং দৈহিক কামনা-বাসনার তীব্র প্রভঞ্জনের ছোঁয়াচ হতে নিজেকে বিমুক্ত রাখা। এর দ্বারা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, রোজা আমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে এক প্রকার রূহানী চিকিৎসা হিসেবে। শুধু তই নয়, আল-কুরআনে ইসলামে রোজার ওপর দুটো সুনির্দিষ্ট বিশেষত্বের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যেন আল্লাহপাক তোমাদেরকে যে পথ প্রদর্শন করেছেন সে মোতাবেক তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পার এবং আল্লাহার শোকর গুজারী আদায় করো। (সূরা বাকারাহ: রুকু- ২৩)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *