রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা

আল্লাহর বান্দা‌দের জন্য রমজান মাস ইহকাল ও পরকা‌লের জন্য কল্যান ব‌য়ে আনে। রোজা পালন করতে গিয়ে একজন মুসলিমের রমযান মাসের প্রতিদিন সূবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকতে হয়। এছাড়াও মুসলিমরা এই সময় সকল প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থেকে নিজেদের মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। এ কারণে রোজা যে শুধু মাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতিই সাধন করে তা নয়, বরং শারীরিক ও মানসিক উন্নতিও ঘটায়। যা কিনা চি‌কিত্‍সা বিজ্ঞা‌নের বি‌ভিন্ন গ‌বেষণায়ও উঠে এসে‌ছে। রমজানের রোজায় আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে সাথে বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা নানান শারীরিক উপকারিতা পেয়ে থাকি ফ্রী।

১৭৬৯ সালে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ পিটার ভেনিয়ামিনভ রোজা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। সেই রিপোর্টে তিনি মানুষকে রোজা রাখার উপদেশ দেন। তার যুক্তি ছিল রোজার কারণে পরিপাকতন্ত্র একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিশ্রাম পায়। ফলে সুস্থ হবার পর তা ঠিক মত নিজের কাজ চালাতে পারে। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ পিজি স্পাসকি বলেন, রোজার মাধ্যমে কালাজ্বর ও শরীরের অন্যান্য পুরাতন রোগ কোন মেডিসিন ছাড়াই ভালো হয়ে যায়। জার্মান ডাক্তার ফেডারিক হ্যানিম্যান বলেন, রোজার মাধ্যমে মৃগী রোগ ও আলসারের চিকিত্‍সা করা যায়। এছাড়াও পেটের অসুখ, অজীর্ণ, বদহজম, গ্যাস্ট্রিকের চিকিত্‍সাও করা যায়।

ইতালির বিখ্যাত শিল্পী মাইকেল এঞ্জেলা ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। ৯০ বছর পার হবার পরও তিনি কর্মক্ষম ও কর্মঠ ছিলেন। এর রহস্য জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি বহু বছর আগে থেকে মাঝে মাঝে রোজা রেখে এসেছি। আমি প্রত্যেক বছর এক মাস ও প্রতি মাসে এক সপ্তাহ রোজা পালন করতাম।’
এমন অনেক উদাহরণ আছে যারা রোজার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। এই সমস্ত বুদ্ধিজীবী ডাক্তার গবেষকরা ভালো করেই জানেন মহান স্রষ্টা অকারণে রোজাকে ফরজ করেন নি। কারণ তারা কুরআন ও ইসলামের নিয়ম কানুন নিয়ে রীতিমত পড়াশুনা ও গবেষণা করেন। এখন জেনে নেয়া যাক স্বাস্থ্য ও ম‌নের উপকারিতায় রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে।

ডায়াবেটিকসের ঝুঁকি কমায়ঃ ডায়াবেটিকস রোগে আক্রান্তদের রোগীদের সবসময় ক্যালরি গ্রহণের ক্ষেত্রে আলাদা সতর্ক থাকতে হয়। রোজার দিনে ক্যালরি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আলাদা একটা নিষেধাজ্ঞা কাজ করে। তাই রোজা রাখলে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।

বার্ধক্যকে দূরে রাখেঃ বার্ধক্য ভয় পায় না এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। বার্ধক্য শরীর-মন দুটোকেই ভারাক্রান্ত আর অসহায় করে তোলে। রোজা রাখলে আয়ু বাড়ে এবং এটি বার্ধক্য সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলোকে দূরে রাখে।

মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিঃ রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে দেহ ও মনে নিঃসন্দেহে একধরণের ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। দুই দিন রোজা রাখলেই শরীরে হরমোন বাড়ার হার পাঁচ গুণ বাড়ে। রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে মস্তিষ্কে নতুন নতুন কোষের জন্ম হয়। ফলে মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বেড়ে যায়।

হার্ট এটাক্টের ঝুঁকি কমায়: ওষুধ ছাড়া রক্তচাপ কমানোর এক আশ্চর্য পদ্ধতি রোজা। রোজা রাখলে প্রথমে গ্লুকোজ, পরে চর্বি কণা গুলি ক্ষয় হয়ে শক্তি উত্‍পাদন করে। মেটাবলিক রেটও কমে। এড্রিনালীন ও নর এড্রিনালীনের মত স্ট্রেস হরমোন উত্‍পাদন কমে। আর এতে করে মেটাবলিক হার একটা স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। ফলে ব্লাড প্রেসার কমে। যায় এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে ধমনীতে চর্বি জমার প্রক্রিয়ার উপর যা হার্ট এটাক্টের ঝুঁকি কমায়।

চর্বি কমাতে সহায়তা করেঃ অতিরিক্ত খাবার গ্রহনের জন্য অনেকেই অনেক সমস্যায় ভুগতেছেন। তাই তো ইসলাম অতিরিক্ত আহার গ্রহনের পক্ষে নয়। অতিরিক্ত খাবার গ্রহনের ফলে দেহে প্রচুর চর্বি জমে যায়, ফলে শরীর অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যায়, যা স্বাভাবিক জীবন যাপনকে ব্যাহত করে। কিন্তু রোজা রাখলে শরীরে জমে থাকা চর্বি শরীরের কাজে ব্যবহৃত হয় ফলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়।

হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধিঃ মানুষের শারীরিক মাত্রা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে হরমোন বেশি প্রয়োজন, তা রোজা রাখার ফলে বৃদ্ধি পায়। চিকিত্‍সাবিজ্ঞানীদের মতে রোজা একই সঙ্গে দেহের রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। রোজা পালনের ফলে দেহে রোগজীবাণুবর্ধক অনেক জীবাণু ধ্বংস হয়।

ধূমপানের অভ্যেস ত্যাগ: যারা রোজা রাখেন তাঁরা দিনের দীর্ঘ সময় ধরে ধূমপান করেন না। এভাবে টানা একমাস ধূমপান না করার কারণে রোজাদারদের ধূমপানের অভ্যাস অনেকটাই কমে যায়। সেই সঙ্গে ধূমপানের কারণে সৃষ্ট নানা রকম সমস্যা দূর হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধূমপান না করার কারণে রোজার মাসটি ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করার জন্য শ্রেষ্ঠ সময়। অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সুস্থতার পাশাপাশি রোজায় মানসিক শক্তি, স্মরণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, আধ্যাত্মিক শক্তি সহ সব কিছুই বৃদ্ধি পায়।

রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধের কাজ: চিকিত্‍সাবিজ্ঞানীদের মতে রোজা একই সঙ্গে দেহের রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। রোজা পালনের ফলে দেহে রোগজীবাণুবর্ধক অনেক জীবাণু ধ্বংস হয়। ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে নানা প্রকার নার্ভ-সংক্রান্ত রোগ বৃদ্ধি পায়। রোজাদারের শরীরে পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে চর্মরোগ বৃদ্ধি পায় না। সুতরাং রোগের অজুহাত দেখিয়ে রোজা ভঙ্গ করা বৈধ নয়। আবার রোজার দিন শেষে মাগরিবের আজানের সময় যথাসময়ে ইফতার করা সুন্নত।

ইফতারের প্রচলিত কিছু উপকরণের মধ্যেও বিশেষ স্বাস্থ্যগত তাত্‍পর্য রয়েছে। যেমন ছোলা ইফতারের ঐতিহ্যগত একটি উপাদান। ছোলার মধ্যে আমিষ, ভিটামিন, শ্বেতসার ও খনিজ লবণের পরিমাণ আশ্চর্যজনকভাবে বেশি। চিনির শরবত ইফতারের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে কাজ করে। মোট কথা আধুনিককালে যাঁরা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছেন, তাঁদের জ্ঞানও আল্লাহপাক সৃষ্টি করেছেন। এ কারণে বৈজ্ঞানিকরা যতই গবেষণা করবেন, আল্লাহ তায়ালার দেওয়া প্রতিটি বিধানে তাঁরা তত বেশি উপকারিতা ও বৈজ্ঞানিক সমাধান খুঁজে পাবেন।

জিহ্বা ও লালাগ্রন্থির বিশ্রামে খাদ্যদ্রব্যের স্বাদ বৃদ্ধি: পূর্ণ এক মাস রোজার ফলে জিহ্বা ও লালাগ্রন্থি বিশ্রাম পায়। ফলে এগুলো সতেজ হয়। যারা ধূমপান করেন তাদের জিহ্বায় ক্যান্সার প্রভৃতি রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই এক মাস রোজার সময় ধূমপায়ীরা ধূমপান কম করেন বলে উল্লিখিত রোগগুলো হওয়ার আশঙ্কা কম। এ ছাড়া এক মাস রোজার ফলে জিহ্বায় খাদ্যদ্রব্যের স্বাদও বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে তাদের বেলায়, যারা অত্যাধিক ধূমপান আর পান খেয়ে জিহ্বায় খাদ্যদ্রব্যের স্বাদ হারিয়েছেন।

আহারের সময় খাদ্যদ্রব্য যখন চিবানো হয় তখন লালাগ্রন্থি থেকে এক প্রকার রস নির্গত হয়, যা খাদ্যদ্রব্য চিবাতে, গলাধঃকরণ ও হজম করতে সাহায্য করে। দীর্ঘ এক মাস রোজার ফলে গ্রন্থিগুলো বিশ্রাম পায় বলে সতেজ হয়। লালগ্রন্থি থেকে অনবরত লালা নির্গত হওয়ায় মুখগহব্বর ভেজা ও পিচ্ছিল থাকে। গ্রন্থিগুলো থেকে কোনো কারণে যদি লালা নির্গত না হয়, তবে তাকে শুকনা মুখ বলে। তাই পূর্ণ এক মাস রোজার ফলে লালাগ্রন্থিগুলো বিশ্রাম পায় বলে শুকনা মুখ হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।

সারা বছরে পুরো এক মাস রোজা রাখার ফলে শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশ্রাম পায়। দৈনিক গড়ে প্রায় ১৫ ঘণ্টা উপবাসের সময় লিভার, কিডনি ও মূত্রথলি প্রভৃতি অঙ্গ বেশ উপকারিতা লাভ করে। যাদের লিভার ও প্লিহা বড় হয়ে গেছে, রোজার ফলে তাদের ওই বর্ধিত অংশ আপনাআপনি কমে আসতে সাহায্য করে। কিডনি ও মূত্রথলির নানা প্রকার উপসর্গ রোজার ফলে নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। রোজার ফলে অগ্ন্যাশয় থেকে হজমের রস দিনের বেলায় নির্গত বন্ধ থাকে বিধায় তা-ও একমাস বিশ্রাম পায়। ফলে অগ্ন্যাশয়ের কারণে বহুমূত্র রোগ উপশম পাবে।

অতি ভোজনের ফলে অনেকেরই পাকস্থলি বড় হয়ে যায়। রোজার ফলে বড় পাকস্থলি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং তার প্রকৃত অবস্থা ধারণ করে। পাকস্থলি একটি বৃহদাকার পেশি বিশেষ। শরীরের অপরাপর পেশির মতো এরও বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। একে বিশ্রাম দেওয়ার একমাত্র পথ এর মধ্যে খাদ্য প্রবেশ না করানো অর্থাত্‍ রোজা রাখা। মোট কথা রোজার মাধ্যমে আল্লাহপাক আমাদেরকে মাগফিরাত দান করেন।

রোজা ব্যক্তির মানসিক পরিবর্তনেও সাহায্য করে। রোজায় যে আনন্দ, অনুভূতি, আত্মিক পরিতৃপ্তির সাথে সংযম, কৃপ্রবৃত্তি দমন, লোভ-লালসা, হিংসা, প্রতিহিংসা ইত্যাদি ত্যাগ করার যে আলোকোজ্জ্বল অনুভূতির চর্চা হয় তা রমযানের রোজা ছাড়া অন্য কোনভাবে লাভ করা যায় না। তাই রোগাক্রান্ত অবস্থায়ও অনেকেই রোজা রাখতে চান।
তবে আমরা রোজা পালন করি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। সেই সাথে রোজার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা আমাদের এক্সট্রা বোনাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *