উদারনীতিবাদ কাকে বলে? উদারনীতিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উদারনীতিবাদ কাকে বলে?
J.S. McClelland তাঁর প্রকাশিত History of Western Political Thought (১৯৯৬-তে প্রকাশিত) গ্রন্থে লিখেছেন যে লকের প্রতি উদারপন্থীদের কিছু পরিমাণ ভালোবাসা লক্ষ্য করা যায় এবং কারণ অনুসন্ধান আদৌ কষ্টসাধ্য নয়। তিনি যে সমস্ত পূর্বানুমানের আশ্রয় নিয়েছিলেন, যে দৃষ্টিভঙ্গি মনে পোষণ করতেন ও বক্তব্য বিশ্লেষণের নিমিত্ত যে সমস্ত যুক্তির অবতারণা করেছিলেন সেগুলিকে অতি সহজে উদারনীতিবাদের পৃষ্ঠপোষকতাকারী উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কোন কোন চিন্তক আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন যে লক এককভাবে উদারনীতিবাদের বিকাশ সাধন করেছিলেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনায় রাষ্ট্রের কার্যাবলি এবং প্রকৃতি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হল উদানৈতিক মতবাদ। বস্তুত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উদারনীতিবাদের সাধারণ অর্থ হল রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি প্রতিষ্ঠা। ‘Encyclopedia Britannica’ অনুযায়ী, উদারনীতিবাদ হল এমন এক ধারণা যা সরকারি কাজের নীতি ও পদ্ধতিরূপে এবং ব্যক্তি ও সমাজের এক জীবনাদর্শরূপে ‘স্বাধীনতা’কে প্রতিষ্ঠা করে।
উদারনীতিবাদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সারতেরি বলেছেন, উদারনীতিবাদ হল এমন এক আদর্শ যা ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতি, আইনি-সংরক্ষণ ও সাংবিধানিক রাষ্ট্রকাঠামোকে অনুসরণ করে। হ্যারল্ড ল্যাস্কি উদারনীতিবাদ সর্বাধিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
উদারনীতিবাদ সংকীর্ণ ও ব্যাপক এই দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। সংকীর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদ বলতে এমন এক তত্ত্বকে বোঝায় যা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শাসক-প্রতিনিধিদের নির্বাচন ও অপসারণের ব্যাপারে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠা করা সংকীর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদের প্রধান উদ্দেশ্য। অন্যদিকে, ব্যাপক অর্থে উদারনীতিবাদ হল এমন এক মানসিক ধারণা যা ব্যক্তির অধিকার, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পক্ষপাতী। বস্তুতপক্ষে সংকীর্ণ ও ব্যাপক উভয় ক্ষেত্রেই উদারনীতিবাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল স্বাধীনতা।
কে ইউরোপীয় উদারনীতিবাদের জনক বলে বিবেচিত হন?
জন লক ইউরোপীয় উদারনীতিবাদের জনক বলে বিবেচিত হন।
On Liberty বইটি কার লেখা?
On Liberty বইটি জন স্টুয়ার্ট মিলের লেখা।
উদারনীতিবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
গ্রিক দার্শনিকদের দুটি প্রধান নীতি – চিন্তার স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা উদারনীতিবাদের প্রাথমিক উৎস। বস্তুত, সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসন ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে উদারনৈতিক মতবাদ জন্মগ্রহণ করে। ইউরোপে মধ্যযুগের নবজাগরণ আন্দোলন ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সাফল্যের ফলে উদারনীতিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৬৮৮ সালে গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে উদারনীতিবাদ সুসংহত আকার নেয়।
অনেকে মনে করেন, ইংল্যান্ডে উদারনীতিবাদের উদ্ভবের কারণ ছিল শিল্পবিপ্লব। শিল্পবিপ্লবের ফলে যে বণিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে তারা রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক – সবক্ষেত্রে আরও ব্যাপক স্বাধীনতার দাবিদার হয়ে ওঠে। এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব লাভ করে। ধ্রুপদি উদারনীতিবাদের প্রধান প্রবক্তা জন লকের মতে, জনগণের সম্মতি হল রাষ্ট্রের মূলভিত্তি। ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই। রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বাধীনতার পথে বাধাগুলি দূর করতে প্রয়াসী হবে।
১৭৭৬ সালে আমেরিকার ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’য় এবং ১৭৮৯ সালে ফরাসি মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণায় উদারনীতিবাদরে আদর্শ বাস্তব রূপ লাভ করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেরেমি বেন্থামের মতে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক পরিমাণ সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা। উদারনীতিবাদের আর এক প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ নীতি বা Laissez faire Policy-র কথা বলেন। তিনি নির্দিষ্ট কয়েকটি কাজের মধ্যে রাষ্ট্রের কার্যকলাপকে সীমিত রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। পরবর্তীকালে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গ্রিন. ব্র্যাডলি. বোসাঙকেটের হাত ধরে উদারনীতিবাদ আরও সংশোধিত ও পরিবর্তিত হয়। উদারনীতিবাদের সমর্থকরা এসময় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্ব প্রচার করেন।
আধুনিককালে উদারনীতিবাদে নাগরিকদের রাজনৈতিক ও পৌর অধিকার, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা, শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন, অবাধ বাণিজ্যনীতি, মুক্ত বাজার অর্থনীতি, পুঁজির বিশ্বায়ন ইত্যাদি মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়।