ইতিহাসের প্রথম জনক কে?
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৫ সালের কথা। এক গ্রিক পণ্ডিত ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, ২৮ মে সূর্য দেখা যাবে না। কী আজব কথা! বললেই হলো, সূর্য দেখা যাবে না! কেউ তাঁকে বিশ্বাস করল না। লোকে ভাবল, পাগল–টাগল হবে হয়তো। কিন্তু পণ্ডিত ২৮ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। পণ্ডিতের কথাই ঠিক হলো। সূর্য দেখা যাচ্ছে না। সবাই অবাক হয়ে এই ঘটনা দেখল। অনেকে ভয়ও পেল।
এই সময় ঘটল আরেকটি মজার ঘটনা। ছয় বছর ধরে লিডিয়ার রাজা অ্যালিয়াটিস ও মিডিয়ার রাজা সিয়াক্সেরিসের মধ্যে চলছিল তুমুল যুদ্ধ। সূর্য উধাও হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেল সেই যুদ্ধ। দুই রাজা মনে করলেন, তাঁদের বিবাদ ও পাপের জন্যই এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। অপদেবতারা খেয়ে ফেলেছেন সূর্যকে। তখনই দুই পক্ষ শত্রুতা ভুলে বন্ধুত্ব করল। অনেকের মনে হতে পারে, এ আর এমন কী কথা! সূর্যগ্রহণের কারণে সূর্য দেখা যায়নি। এ খবর তো এখনকার কলেজপড়ুয়া ছেলেও বলে দিতে পারে। কিন্তু এখন থেকে আড়াই হাজার বছর আগে সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা ছিল না। অবশ্য পণ্ডিত বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপারটি। তিনি পরে ব্যাখ্যা করেন, আকাশের চাঁদ যখন পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবীর কোনো কোনো জায়গা থেকে সূর্য দেখা যায় না। এই ঘটনার পর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল পণ্ডিতের নাম। কী নাম পণ্ডিতের? থেলিস। মিলেটাসের থেলিস নামেও পরিচিত এই বিজ্ঞানী। মিলেটাস নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে থেলিসের নাম হয়েছে মিলেটাসের থেলিস। তিনি সে সময় মিলেটাসের সেরা সাতজন জ্ঞানীর মধ্যে একজন ছিলেন। থেলিসকে মনে করা হয় ইতিহাসের প্রথম বিজ্ঞানী।
থেলিসের জীবন সম্পর্কে ইতিহাস থেকে তেমন কিছু জানা যায়নি। তাঁর সম্পর্কে যা কিছু জানা যায়, তা অ্যারিস্টটল, হেরোডোটাস এবং তাঁদের সমসাময়িক লেখকদের বই থেকে। গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শনের জনক থেলিস আনুমানিক ৬২৪ বা ৬২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেছেন। থেলিসের জন্মসাল নিয়ে দ্বিমত আছে। অনেকে মনে করেন, থেলিস মিলেটাস শহরে ৬৩৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে আমরা যেটাকে তুরস্ক বলে জানি, ২ হাজার ৫০০ বছর আগে এই জায়গার নাম ছিল মিলেটাস। সে সময় মিলেটাস শহর গ্রিকদের ভূখণ্ড ছিল। তবে অনেকের ধারণা, থেলিসের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল ফিনিশিয়াতে। সেখান থেকে এসে মিলেটাসে তাঁরা বসবাস শুরু করেন। থেলিসের বাবা এক্সেমায়েস ব্যবসায়ী ছিলেন। মা ক্লেবুলাইন ঘরের কাজ সামলাতেন। থেলিসও বাবার মতো একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসা উপলক্ষে তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতেন। তিনি একবার ব্যবসার কাজে মিসরে গিয়েছিলেন। মিসরে ভ্রমণের সময় সেখানকার পুরোহিতদের কাছে তিনি জ্যামিতি শেখেন। মিসর থেকে শেখা জ্যামিতি তিনিই প্রথম গ্রিসে নিয়ে আসেন। মিসর থেকে ফিরে অল্পকালের মধ্যে ব্যবসা থেকে অবসর নেন। অবসর নিয়ে কিন্তু তিনি বসে থাকেননি। ব্যবসা ছেড়ে অবসর সময়ে জ্যামিতি নিয়ে কাজ করতেন। থেলিস গণিত ও জ্যামিতির জন্যই বেশি প্রশংসিত হয়েছেন। মিসরীয়রা যে জ্যামিতির ধারণা দিয়েছিল, তা ছিল শুধু তলসংক্রান্ত। কিন্তু থেলিস তার উন্নতি করে দেখান, ত্রিভুজের ভূমি ও ভূমিসংলগ্ন দুটি কোণ দেওয়া থাকলে একটি ত্রিভুজ আঁকা সম্ভব।
গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাসের মতে, থেলিস দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নিজের ছায়ার দৈর্ঘ্য ও পিরামিডের ছায়ার দৈর্ঘ্যের অনুপাত নির্ণয় করে পিরামিডের উচ্চতা পরিমাপ করেছিলেন। তিনি নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সমুদ্রে অবস্থানরত জাহাজের দূরত্ব নির্ণয় করার কৌশলও আবিষ্কার করেন। এ ছাড়া তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন, ৩৬৫ দিনে বছর। তিনি সূর্যগ্রহণ সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। সে ব্যাপারে প্রথমেই বলা হয়েছে। থেলিস কিছু যুগান্তকারী উপপাদ্যের জনক। যেমন একটি বৃত্ত তার যেকোনো ব্যাস দ্বারা সমদ্বিখণ্ডিত হয় বা সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের সমান সমান বাহুগুলোর বিপরীত কোণগুলোও পরস্পর সমান অথবা অর্ধবৃত্তস্থ কোণের পরিমাণ এক সমকোণ ইত্যাদি। এগুলো খুব সরল, কিন্তু যুগান্তকারী। থেলিস তাঁর পূর্বপুরুষদের মতো রূপকথার স্রোতে গা ভাসাননি। তিনিই প্রথম সবকিছুর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়ম খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। পৃথিবীর মানুষকে তিনি জানিয়েছেন নতুন নতুন তথ্য। তিনি পৌরাণিক কাহিনির বিশ্বাস থেকে সরে প্রাকৃতিক বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। থেলিসই মূলত গবেষণামূলক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছিলেন। থেলিসের নিজের লেখা কোনো পাণ্ডুলিপি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন উৎস অনুসারে থেলিসই প্রথম প্রাকৃতিক বিশ্বের ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
থেলিস জীবিত থাকা অবস্থায় মিলেটাসের মানুষ কুসংস্কারে লিপ্ত ছিল। তারা দেবতাদের ভয় পেত। তারা মনে করত, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের কুকর্মের ফল। দেবতারা মানুষের কাজে সন্তুষ্ট না হলেই বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা কালবৈশাখীর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আবির্ভাব হয়। কিন্তু থেলিস এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না। তিনি যেকোনো প্রাকৃতিক ঘটনার মধ্যে শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস না খুঁজে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক ঘটনা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারলে এর পেছনের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। থেলিস আরও বিশ্বাস করতেন, কোনো সমস্যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা গেলে তার পূর্বাভাসও পাওয়া সম্ভব। তাঁর যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার এই দৃষ্টিভঙ্গি মানবসভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। সূচনা হয়েছে এক নতুন দিগন্তের। তবে থেলিস এটাও বিশ্বাস করতেন, সবকিছু সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বর বা দেবতাদের হাত রয়েছে। তাঁর বিখ্যাত উক্তির মধ্যে একটি হলো, সবকিছু ঈশ্বরে পরিপূর্ণ। কিন্তু শুধু গণিত নিয়ে ভাবলে বা উপপাদ্য বানালেই তো আর ইতিহাসের প্রথম বিজ্ঞানী হওয়া যাবে না। বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়েও কাজ করতে হবে। করেছিলেনও থেলিস। মহাবিশ্বের প্রকৃতি নিয়েও থেলিস ভেবেছিলেন। তিনি সব সময় মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে জানার জন্য নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতেন। ভাবতেন, মহাবিশ্ব কী দিয়ে গঠিত? তবে তিনি শুধু ভেবেই থেমে থাকেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মহাবিশ্বের সবকিছু একটি মৌলিক উপাদান দিয়ে গঠিত। আর সেই মৌলিক উপাদানটি হলো পানি। পানিই একমাত্র উপাদান, যা দিয়ে মহাবিশ্বের সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির মৌলিক উপাদান পানি ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। কেননা পানি দিয়ে সবকিছু করা যায়। আমাদের জীবনেও পানি সবচেয়ে বেশি দরকারি। তা ছাড়া পানি কঠিন, তরল ও বায়বীয়—সব অবস্থাতেই থাকতে পারে। সুতরাং মহাবিশ্ব তৈরির মৌলিক উপাদান পানি না হয়ে যায় না। এখানেই ভুলটা করেছিলেন থেলিস। যদিও আমরা এখন জানি, পানি মৌলিক উপাদান নয়। থেলিসের আরও একটি বিখ্যাত উক্তি, সবকিছুর আদিমতম উপাদান পানি।
তিনি শুধু মহাবিশ্ব তৈরির উপাদান নিয়েই পড়ে ছিলেন না। মহাবিশ্বে পৃথিবীর অবস্থান কোথায়, সে ব্যাপারেও বর্ণনা করেছেন। তাঁর ধারণা ছিল, যেহেতু মহাবিশ্ব পানি দিয়ে তৈরি, তাই পৃথিবী পানির ওপরে সমতলভাবে ভাসমান। থেলিস সমতল পৃথিবীতে বিশ্বাস করতেন। মৃত্যুর আগমুহূর্তেও তিনি মিসরের পুরোহিতদের প্রতি ঋণ ভোলেননি। মৃত্যুর আগে তাঁর ছাত্র পিথাগোরাসকে মিসরে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। পিথাগোরাসও শিক্ষকের কথা শুনে মিসরে গিয়েছিলেন। মিসরের পুরোহিতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ৫৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ৭৮ বছর বয়সে ইতিহাসের এই আদি বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন।