কাজী মোতাহার হোসেন কে ছিলেন
কাজী মোতাহার হোসেন কে ছিলেন
প্রাচীন প্রস্তর যুগ। বিশ্বজুড়ে তখন গুহামানবদের বাস। তীর ধনুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ওরা জঙ্গলে প্রান্তরে। উত্পাদন করতে জানে না, তবে পাথরের ব্যবহার জানে। পাথর, লাঠি, তীর ধনুক দিয়ে পশু শিকার করে জীবন চালায়। তখন কি মানুষ সংখ্যার ব্যবহার জানত? এই বইয়ের লেখক কাজী মোতাহার হোসেন বলছেন, সেযুগের মানুষও জানত সংখ্যার ব্যবহার । তবে সেটা ১ আর ২ দুইয়ের বেশি নয়। নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ কৃষিকাজ শেখে। শেখে পশু পালনও। ফসলের হিসাব রাখতে, গবাদি পশু গুণতে তাই সংখ্যার দরকার হলো। কিন্তু সে ইতিহাস আমরা কীভাবে জানলাম। লেখক জানিয়েছেন সে ইতিহাসও। জানিয়েছেন নব্য প্রস্তর যুগেই পণ্যের আদান-প্রদান শিখেছিল মানুষ। তাই গুনতে না শিখে উপায় ছিল না।
লেখক শুনিয়েছেন জ্যামিতির গোড়ার কথা। কীভাবে গ্রিক পণ্ডিতদের হাতে পূর্ণতা পেল জ্যামিতি। কীভাবে তৈরি হলো পিথাগোরাসের উপপাদ্য। কীভাবে একে অতীতের সকল জ্যামিতিবিদদের কাজ একত্রিত করে, নিজের জ্যামিতিক জ্ঞান একত্রিত করে কী অধ্যাবসায় আর পরিশ্রমের ফলে এলিমেন্টস সংকলন করলেন, সে ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ, জানিয়েছেন জ্যামিতিক পদ্ধতির ভেতর-বাহিরের কলা-কৌশলও।
আজকের গণিতের অপরিহার্য উপাদান ত্রিকোনোমিতি। সেই ত্রিকোনোমিতির ইতিহাসও আজকালের নয়। প্রায় বাইশ শ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। তবে ‘ত্রিকোনোমিতি’ নামটা এসেছে অনেক পরে। তবে লেখক জানাচ্ছেন, ত্রিকোণোমিতির চর্চা দুই সহস্রাব্দের হলেও মিশরে যারা পিরামিড তৈরি করেছিল তাঁদের নিশ্চয়ই ত্রিকোণোমিতিক জ্ঞান ছিল। ত্রিকোনোমিতর জ্ঞান ছাড়া এত নিখুঁত স্থাপত্য তৈরি সম্ভব নয়। লেখক আরো জানাচ্ছেন, অ্যারিস্টার্কাস, হিপাকার্স, মেনেলাস, টলেমিরা কীভাবে ত্রিকোনোমিতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছেন।
অনেক বড় বড় সংখ্যার গুণ-ভাগ করতে, বর্গমূল-ঘনমূল বের করতে আগে কতই কষ্ট করতে হয়ে কী কষ্টই না করতে হয়েছে। সেই কষ্ট থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি, তাঁর জন্য একক কৃতিত্ব জন নেপিয়ার নামে এক স্কটিশ গণিতবিদের। একটা বই লিখে গোটা ব্যাপরটাকে পানির মতো সহজ করে দেন। সেই বই থেকেই দুনিয়ার গণিবিদেরা পরিচিত হন লগারিদম নামে গণিতের এক নতুন কৌশলের সাথে।
আধুনিক গণিতবিদের প্রবাদ পুরুষ স্যার আইজ্যাক নিউটন। তিনিই প্রথম প্রকৃতির নিয়ম অর্থাত্ পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে গণিতের ভাষায় প্রকাশ করেছেন। আজকের পদার্থবিজ্ঞান যে এত উন্নতি লাভ করেছে, প্রকৃতিকে এত বিমূর্তরূপে পড়তে পারছিতাঁর পেএছন ব্রিটিশ এই বিজ্ঞানীর অবদান সবচেয়ে বেশি। তাই-ই হয়তো নিউটনকে নিয়ে, নিউটনের পদ্ধতিকে নিয়ে কেটা অধ্ত্রায়জুড়ে আলোচনা করেছেন লেখক। আর সেই লেখকের নাম কাজী মোতাহার হোসেন।
কাজী মোতাহার হোসেন নাকি ভুলোমনা মানুষ ছিলে। এমনকী নিজের আত্মীয়-স্বজনকেও অনেক সময় চিনতে পারতেন না। তাই বলে নিজের মেয়েকেও। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর মেয়ে সনজীদা খাতুনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কাজী মোতাহার হোসেনর ভালো গুণ ছিল, তিনি ছোট-বড় যেই হোক, পরিচিত মানুষ দেখলেই সালাম দিতেন। একদিন সানজীদা খাতুনকেও সালাম দিলেন ম্যাডাম সম্মোধন করে। তারপর মেয়ের দিকে না তাকিয়ে সোজা চলে গেলেন নিজের অফিসে। সানজীদা খাতুন তাঁর মায়ের কাছে নালিশ করলেন বাবার বিরুদ্ধে- বাবা, আমাকে দেখেও সালাম দেয়, সম্মান দেখায়, না চেনার ভান করেন। মোতাহার হোসেনের স্ত্রী তাঁকে বললেন, মেয়ে অভিযোগ করেছে, তুমি নাকি ম্যাডাম-ট্যাডাম ডেকে ওকে সালাম দিয়েছো। তখন কাজী মোতাহার হোসেন বললেন, ও, ওটা সানজীদা ছিল! তাই তো বলি চেনা চেনা লাগছিল কেন?
কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় আসেন। থাকবেন কোথায়, আড্ডায়ই বা জমবে কোনখানে? কেন কাজী মোতাহার হোসেন আছেন না! দিনভর আড্ড চলে, কবি আর বিজ্ঞানীতে। সঙ্গে দাবার আসর। কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন ডাকসাইটে দাবাড়ু। উপমহাদেশের সেরা দাবাড়ুদের একজন। অবিভাক্ত বাংলায় এবং পূর্ব পাকিসত্মানে তিনি টানা ৩১ বছর আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। বই পড়তে ভালোবাসতেন। লিখেছেনও বিসত্মর। তাঁর লেখালেখি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছে। লিখেছেন বিজ্ঞান বিষয়ক বইও। তাঁর বিখ্যাত দুটি দুটি বই হলো গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস ও আলোক বিজ্ঞান।
কাজী মোতাহার হোসেনের জন্ম ১৮৯৭ সালে ৩০ জুলাই। কুষ্টিয়ার কুমারখালির লক্ষ্মীপুর গ্রামে। অবশ্য সেটা তাঁর মামার বাড়ি। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বর্তমান রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। স্কুল জীবন কেটেছে কুষ্টিয়াতেই। কুষ্টিয়া মুসলিম হাইস্কুল থেকে ১৯১৫ সালে তিনি এরপর ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন রাজশাহী কলেজ থেকে। এরপর ১৯১৯সালে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএসসি পাশ করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিস্ট্যাটিকস থেকে পরিসংখ্যানে ডিপ্লমা ডিগ্রি অর্জন করেন। একই সঙ্গে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পিএইচডি ড্রিগি লাভ করেন। পিইচডিকালীন তিনি ‘হোসেন চেইন রুল’ নামে পরিসংখ্যানের একটা নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন।
২৯২১ সাল। কাজী মোতাহার হোসেন তখনও ঢাকা কলেজের ছাত্র। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ডোমেনেস্ট্রটর (ব্যবহারিক ক্ল্যাসের প্রদর্শক) পদে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯২৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী প্রভাষক পদে নিয়োগ পান। তাঁর একন্ত প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানের মাস্টার্স কোর্স চালু হয়। তিনি তখন পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি গণিত বিভাগেও শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি গণিত বিভাগের রিডার (বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপকের সমমর্যাদার) পদে প্রমোশন পান। ১৯৫৪ সালে তিনি পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। ওই বছরই সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং ওই প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালক নিযুক্ত হন।
কাজী মোতাহার হোসেন আপদমসত্মক বিজ্ঞানমষ্ক মানুষ ছিলেন। তিনি শুধু বিজ্ঞান বিষয়ক বই-ই প্রবন্ধ সাহিত্যেও তাঁর সমান পা্লিত্য ছিল। কাজী আবদুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হোসেন এবং আবুল ফজলকে সঙ্গে নিয়ে গড়েছেন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। করেছেন ‘শিখা’ পত্রিকার সম্পাদানাও। তিনি বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন কলেন। তাঁর উদ্যোগেই গড়ে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের। আমরণ তিনি এই ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। শিক্ষ ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক। তারও আগে সাহিত্য ও বিজ্ঞান গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬৬ সালে পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার