আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অব্যক্ত ইতিহাস

বলুন তো,২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের ধারণাটি কে করেছিলেন???

বিষয়টি আপনার মতো আমারও জানা ছিলো না,মাতৃভাষা কে নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারলাম। তিনি হচ্ছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি তার এই ধারণাটি শেয়ার করেছিলেন তার বন্ধু আব্দুস সালামের সাথে।

১৯৯৮ সালের ৯-ই জানুয়ারি রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের সেই সময়ের সাধারণ সম্পাদক কফি আনান কে একটি চিঠি লিখেন যেটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করার। কিন্তু,জাতিসংঘ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

তারপর কানাডা প্রবাসী এই দু’জন বাঙালি বন্ধু সরাসরি জাতিসংঘের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। তাদের সাথে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা হলো জাতিসংঘের যিনি পাবলিক রিলেশন অফিসার ছিলেন তার সাথে। তার নাম ছিল হাসান ফেরদৌস।

তিনি দুই বন্ধু কে উপদেশ দিলেন যে এই বিষয় টি নিয়ে কেউ ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তাব দিলে জাতিসংঘ কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগ কে তেমন গুরুত্ব দিবে না। জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সমিতি ইউনেস্কোর যে পরিচালনা কমিটি তার কোন সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে যদি এটি সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রস্তাব করা যায় তাহলে জাতিসংঘ সেটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে।

তারপর দুই বন্ধু ওয়াশিংটনের যে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত তার সাহায্য চাইলেন।রাষ্ট্রদূত সেই চিঠি তার কাছে পাঠাতে বললেন যে চিঠি রফিকুল জাতিসংঘের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সেই চিঠি জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বাংলাদেশের যিনি স্থায়ী প্রতিনিধি আনোয়ারুল করিম তার কাছে দিলেন দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য।

কিন্তু,দুই বন্ধু ভাবলেন বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রস্তাব গেলে জাতিসংঘ সেটির গুরুত্ব বেশি দিবে না।কারণ,এই আন্দোলন টি ছিল বাংলাদেশের নিজস্ব আন্দোলন।

ভাষা সমিতি গঠন

তার চেয়ে যদি কানাডার মতো বহুজাতিক দেশ থেকে প্রস্তাবটি যায় তাহলে হয়তো জাতিসংঘ তা উপেক্ষা করবে না।সেই ভাবনা থেকে দুই বন্ধু মিলে বিশ্বের ৭ টি ভাষার ১০ জন সদস্য কে নিয়ে কানাডার ভ্যানকোভা শহরে একটি ভাষা সমিতি গঠন করেন যার নাম দিয়েছিলেন “মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড”।

সমিতির পক্ষ থেকে একটি আবেদন পাঠানো হয় জাতিসংঘের কানাডার রাষ্ট্রদূত রবার্ট পাওয়েল কে। সেই আবেদনে বিস্তারিত বর্ণনা করে বলা হয় হয় ২১ শে ফেব্রুয়ারি দিনটি হওয়া উচিত বিশ্বের সমস্ত বিপন্ন মাতৃভাষার আত্নরক্ষার সংগ্রামের প্রতীক।মে দিবস,নারী দিবসের মতো ২১ শে ফেব্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক ভাবে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের দাবি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে জানাতে। কিন্তু,দুই বন্ধুর সমস্ত উদ্যোগ কানাডার বৈদেশিক দপ্তরে প্রতিহত হয়।দুই বন্ধু এতে হতাশ হলেও হাল ছাড়েন নি।

প্রস্তাব উত্থাপন

১৯৯৯ সালের শুরুতে তারা দু’জন আবার জাতিসংঘের দপ্তরে যোগাযোগ শুরু করলেন। এবার হাসান ফেরদৌস তাদের পরামর্শ দিলেন প্যারিসের ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে গিয়ে যোগাযোগ করতে। দুই বন্ধু সেখানে গিয়ে কথা বললেন প্যারিসের ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের প্রোগ্রাম স্পেশালিষ্ট অ্যানা মারিয়ার সঙ্গে। অ্যানা মারিয়া তাদের কে ইউনেস্কোর যে পরিচালনা পর্ষদ তাদের যে সদস্য রাষ্ট্র সেই রাষ্ট্রগুলোর ফ্যাক্স নাম্বার দিয়ে বললেন আপনারা তাদের কাছে আপনাদের আবেদন রাখুন তাদের কে অনুরোধ করে বলুন তারা যেন ইউনেস্কোর আসন্ন অধিবেশনে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে এবং নিজেরা উত্থাপন না করলেও কেউ উত্থাপন করলে তারা যেন তা সমর্থন করেন।

হাঙ্গেরি হলো প্রথম দেশ যে দেশ দুই বন্ধুর আবেদনে সাড়া দিয়ে জানায় কেউ যদি প্রস্তাব করে তাহলে তারা সেটা সমর্থন করবে। ভারত কিন্তু সাড়া দেয়নি।

দুই বন্ধু এবার যোগাযোগ করলেন তৎকালীন বাংলাদেশের শিক্ষা সচিব রফিকউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। রফিকউদ্দিন আহমেদ সমস্ত বিষয় জানার পর যোগাযোগ করলেন বাংলাদেশের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জনাব সাদেকের সঙ্গে।

সাদেক সাহেব বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর গুরুত্ব বুঝলেন এবং কোন বিলম্ব না করে অনানুষ্ঠানিকভাবেই প্রস্তাবটি অনুমোদন করে প্যারিসে পাঠালেন।

বাংলাদেশ ইউনেস্কো কমিশনের প্রধান কফিলউদ্দিন আহমেদ জাতিসংঘের বিশেষ ফর্মে ভর্তি করে নিজের স্বাক্ষরে ২১ শে ফেব্রুয়ারী কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে সরকারিভাবে পেশ করলেন।

একুশের চেতনা বয়ে চলুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে – আর্টিকেলটি পড়তে এখানে ভিজিট করুন।

পাকিস্তানের সমর্থন

এদিকে দুই বন্ধু আব্দুস সালাম এবং রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের যিনি শুভেচ্ছা দূত আইসল্যান্ডের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তাকে সহ জাতিসংঘের তদানীন্তন ১৮৮ দেশের প্রত্যেককে যাবতীয় চিঠিপত্র পাঠিয়ে, তাদের সামনে ২১ শে ফেব্রুয়ারীর যে ঘটনা তার ব্যখ্যা,তাৎপর্য সমস্ত কিছু তাদেরকে জানিয়ে পৃথিবীর বিপদগ্রস্ত যে সকল ভাষা রয়েছে সেগুলো রক্ষা করার জন্য তাদের অনুরোধ করলেন এবং সমর্থন প্রত্যাশা করলেন।

দুই বন্ধুর নিরন্তর প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১২ ই নভেম্বর ইউনেস্কোর টেকনিক্যাল কমিটির দ্বারা বাংলাদেশের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। শুনলে অবাক হবেন সেদিনই পৃথিবীর ২৯ টি দেশ সেই প্রস্তাবকে সমর্থন করে। আরও অবাক হবেন যে ২৯ টি দেশের মধ্যে একটি দেশ ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের সমর্থন যেন ছিল তাদের ভুলের আত্ম স্বীকারোক্তি।

অবশেষে সব বাঁধা পেরিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৭-ই নভেম্বর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারী কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার কথা ঘোষণা করা হয়।

আমি বাংলায় কথা কই
আপনার কি মনে হয় ২৯ টি দেশ বিনা কারণেই বাংলাদেশের প্রস্তাব কে সমর্থন করেছিল???
না,মোটেও সেরকম নয়।

শহীদ হয়েছিলেন মাত্র ৯ বছরের ছেলে অহিউল্লাহ

তাদের সামনে ২১ শে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা তুলে ধরা হলে তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, রফিক বিন আব্দুল লতিফ।যিনি ছিলেন জগন্নাথ কলেজ বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র। পরিবারের বড় সন্তান।যার দিকে তাকিয়ে ছিল তার সমস্ত পরিবার।তারা বুঝেছিলেন পরিবারের বড় মেধাবী সন্তানের জীবনের মূল্য।

তারা বুঝতে পেরেছিলেন, আবাই বিন শামসুদ্দিন যাকে আমরা আবুল বরকত নামে চিনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ হয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়েছিলেন। স্নাতক সম্পন্ন করা একটি ছেলের প্রাণের মূল্য তারা অনুধাবন করেছিলেন। তারা বুঝেছিলেন আব্দুস সালাম বিন মোহাম্মদ ফাজেল মিয়া,আব্দুল জব্বার বিন হাসান আলী, শফিউর রহমান শফিক বিন মাহবুবুর রহমান, আউয়াল বিন মোহাম্মদ হাশিম,অহিউল্লাহ বিন হাবিবুর রহমান সহ প্রমূখের জীবনের মূল্য, মাতৃভাষার প্রতি তাদের শ্রদ্ধার মূল্য।

এই শহীদ আউয়াল ছিলেন একজন রিক্সা চালক।যার এক বেলার আহার যোগাড় হতো সারাদিন পরিশ্রমের পর।

শহীদ হয়েছিলেন মাত্র ৯ বছরের ছেলে অহিউল্লাহ। তার মাথায় গুলি লেগেছিল। পুলিশ তার লাশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেই লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।অহিউল্লাহর পিতা-মাতা পুলিশের কাছে বারবার তার সন্তানকে দেখতে চাওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু, তারা তাদের ছেলে কে শেষ বারের মতোও দেখতে পারেন নি। আজ পর্যন্ত জানা যায়নি কি করা হয়েছিল তাঁর লাশ।

দুই বন্ধু আব্দুস সালাম এবং রফিকুল ইসলামের নিরন্তর প্রচেষ্টায় বিশ্বের ২৯ টি দেশ আামাদের মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝলেও আমরা কেন আমাদের মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝি না???

আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও কেন ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা লিখি??? যেখানে সহজে বাংলা লেখার জন্য দেশের সোনার ছেলেরা আবিষ্কার করেছে অভ্র,বিজয়ের মতো কী-বোর্ড।

আব্দুল গাফফার চৌধুরী

আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলেছিলেন,

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ শে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভূলিতে পারি।
ভুলতে পারি না মানে,আমরা তো ভুলেই গিয়েছি। শুধু বছরে একবার শহীদ মিনারে ফুল দিলেই ভাইয়ের রক্তের গুরুত্ব,মাতৃভাষা প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় না।

মনে রাখার অর্থ হলো মাতৃভাষা কে বুকে লালন করা,বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করা।শহীদদের জন্য আল্লাহর দরবারে দু-হাত তুলে প্রার্থনা করা।

আমাদের দেশে কেউ শুধু ভালোভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে পারলে তাকে উচ্চশিক্ষিত হিসেবে ধরে নেওয়া হয় অথচ কেউ বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারলে তাকে কোন গুরুত্ব দেওয়া হয় না।এটা স্পষ্ট ভাবে মাতৃভাষাকে অসম্মান করা।

আমরা কেন বুঝি না,বিশ্বের অন্য কোন জাতির মাতৃভাষা নিয়ে এরকম গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নেই যা আমাদের রয়েছে।
আপনি জানেন কি??? যত নবী-রাসুল কে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে তাদের সবাইকে সেই জাতির মাতৃভাষায় পাঠানো হয়েছে। রাসূল (সঃ) তাঁর জীবনে যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো সাহাবীরা সংরক্ষণ করে রেখেছেন যা আমরা হাদিস হিসেবে জানি। লক্ষ্য করে দেখুন,তাঁর ভাষা ছিল বিশুদ্ধ। তিনি কখনই অশুদ্ধ, অসাবলীল ভাষা ব্যবহার করেন নি।অর্থাৎ,আপনাকে বুঝতে হবে রাসূল (সঃ) এর মাতৃভাষা ছিল আরবী আর সেটা তিনি বিশুদ্ধভাবে জানতেন। অতএব,আপনাকে আমাকেও মাতৃভাষায় বিজ্ঞ হতে হবে,বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলতে শিখতে হবে। সূরা ত্বাহায় বর্ণিত হয়েছে, মূসা (আঃ) কে মহান আল্লাহ তায়ালা যখন দ্বীনের দাওয়াত দিতে বলেছিলেন তখন মূসা (আঃ) আল্লাহর কাছে বলেছিলেন তাঁর সাথে তার ভাই হারুন (আঃ) কে দিতে। কারণ,হারুন (আঃ) বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় সাবলীল ও সুন্দরভাবে কথা বলতে পারতেন। তাই আমাদেরকেও মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝতে হবে।

মাতৃভাষা চর্চা

আমরা অন্যান্য ভাষাও শিখবো, চর্চা করবো।কিন্তু,সেটা কখনেই নিজের মাতৃভাষা কে পিছনে ফেলে নয়। ভুলে যাবেন না,আপনাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সৃষ্টি করে যে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে পাঠিয়েছেন এটাও একটা নেয়ামত। আর আল্লাহ তায়ালা সূরা ইব্রাহিমের ৭ নং আয়াতে বলেন,”যে আমার নেয়ামতের শোকরগুজারী করে, আমি তার নেয়ামত আরও বাড়িয়ে দেয়,আর যে আমার নেয়ামত পেয়ে তার শোকরগুজারী করে না,আমি তার নেয়ামত ছিনিয়ে নেই,এবং তাকে কঠিন আজাবে গ্রেফতার করি।”

পরিশেষে বলতে চাই, মাতৃভাষা চর্চা করুন। ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা লেখা বন্ধ করুন। নিজের ভাষার ঐতিহ্য কে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *