আর্জেন্টিনায় কালো মানুষ নিধন প্রকল্প

আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের দিকে তাকালে একটি জিনিস লক্ষ করবেন যে, সাধারণত কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার খুঁজে পাবেন না।
ম্যারাডোনা, মেসি, হিগুয়াইন, অ্যাগুয়েরো, দি মারিয়া, দিবালা প্রায় সবাই সাদা বর্ণের।
একটি দলে সাদা-কালো বর্ণের খেলোয়ার থাকা না থাকাটা সমস্যার না। অনেক দল আছে, যাদের প্রায় সকল খেলোয়ার কালো বর্ণের,
অনেক দল আছে যাদের প্রায় সকল খেলোয়ার সাদা বর্ণের।

কিন্তু, আর্জেন্টিনায় সাদা বর্ণের আধিপত্যের পেছনে আছে এক লোমহর্ষক ইতিহাস। এই দেশটিকে সাদা বর্ণের মানুষ দ্বারা পরিপূর্ণ করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। যার ফলে অনেকাংশে আর্জেন্টিনা থেকে কালো বর্ণের মানুষ হারিয়ে যায়; তাদেরকে ‘হারিয়ে’ দেয়া হয়।

ব্রাজিলের মতো আর্জেন্টিনায়ও আটলান্টিক দাস বাণিজ্য চলে। ১৬’শ শতাব্দীর শেষদিকে আর্জেন্টিনায় দাস নিয়ে আসা হয় দেশের কৃষিকাজের জন্য।
পেদ্রো গুমেস রেইনেল নামের এক পর্তুগীজ আদম ব্যবসায়ী বার্ষিক ৬০০ জন দাস নিয়ে আসার জন্য চুক্তিবদ্ধ হোন।
সেই থেকে আফ্রিকা থেকে কিডন্যাপ করে মানুষ নিয়ে আসা হয় আর্জেন্টিনায়। স্বাধীন মানুষদেরকে দাস হিশেবে বিক্রি করে দেয়া হয় মনিবের কাছে।
মনিব তাদেরকে দিয়ে কৃষিকাজ এবং গৃহস্থলীর কাজ করাতো।

এভাবে ৩০০ বছরে আর্জেন্টিনায় প্রায় ২,০০,০০০ দাস নিয়ে যাওয়া হয়।

আফ্রিকার যেসব জায়গা থেকে দাস নিয়ে যাওয়া হয়, সেসব জায়গার অনেকগুলো ছিলো মুসলিম অধ্যুষিত। ব্রাজিলের মতো আর্জেন্টিনায়ও আফ্রিকার মুসলিমদেরকে দাস হিশেবে পাচার করা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে (১৭৮০-৯০) কৃষ্ণাঙ্গরা আর্জেন্টিনার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকে পরিণত হয়; যাদেরকে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে সেটার শতকরা হার ছিলো ৩০-৪০%।

বর্তমানে আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যার ৯৭% হলো শ্বেতাঙ্গ। তাহলে আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে আর্জেন্টিনায় যে প্রায় ৫০ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ ছিলো, তারা কোথায় গেলো? তাদের সংখ্যা কিভাবে ৫০% থেকে ৩% -এ নেমে এলো?

দাসপ্রথা

১৮১২ সালে আর্জেন্টিনায় দাসপ্রথা নিষিদ্ধের প্রস্তাব হয়। ১৮১৩ সালে আস্তে আস্তে দাসপ্রথা বন্ধের জন্য ‘The Free Womb Act’ আইনটি কার্যকর হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে দাসপ্রথার সমাপ্তি ঘটে ১৮৫৩ সালে; যদিও আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত দাসপ্রথা কার্যকর ছিলো।

এতোদিন যারা দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলো, তারা এবার মুক্তি পেলো। যাদের দাদা বা তার দাদাকে এককালে দাস হিশেবে আর্জেন্টিনায় নিয়ে আসা হয়েছিলো, যারা জন্মগ্রহণ করার পর দেখলো তারা দাসের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা এবার স্বাধীন হলো। আসলেই কি স্বাধীন হয়েছিলো?

জার্মানীতে হিটলার যেমন ইহুদি নিধন শুরু করেছিলো, আর্জেন্টিনায়ও একসময় কৃষ্ণাঙ্গ নিধন শুরু হয়। আর্জেন্টিনার বুদ্ধিজীবি ও লেখক ডমিঙ্গো ফস্তিনো সারমিয়েন্তো ১৮৬৮-১৮৭৪ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট। আর্জেন্টিনাকে ‘কালো মানুষ মুক্ত’ করার জন্য তিনি উদ্যোগ নেন। কৃষ্ণাঙ্গদেরকে বাধ্য করেন সেনাবাহিনীতে যোগদানে।

ইতোপূর্বে ‘War of the triple alliance’ খ্যাত আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়ে মিলে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আর্জেন্টিনার যুদ্ধ শিবিরে যারা সৈন্য ছিলো, তাদের অনেকাংশ ছিলো আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ। সেই যুদ্ধে হাজারে-হাজারে কৃষ্ণাঙ্গ মারা যায়।

ডমিঙ্গো ফস্তিনো সারমিয়েন্তো আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের বাধ্য করেন গহীন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসতি গড়তে।
ফলে ঐসব জায়গায় পীতজ্বর ও কলেরা দেখা দিলে সেখানকার অধিবাসীরা মৃত্যুবরণ করে। শুধু তাই নয়।
আর্জেন্টিনাকে কৃষ্ণাঙ্গ মুক্ত করার জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের ছোটোখাটো অপরাধের জন্য দীর্ঘদিন জেলে রাখা হতো, তাদেরকে অপবাদ দিয়ে মৃতুদণ্ড দেয়া হতো

একদিকে চলছিলো আর্জেন্টিনাকে কৃষ্ণাঙ্গ মুক্ত করার প্রকল্প, অন্যদিকে ডমিঙ্গো ফস্তিনো সারমিয়েন্তো ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ লোকদেরকে আহ্বান জানিয়েছিলেন আর্জেন্টিনায় এসে বসতি স্থাপন করতে।
সাদা মানুষদের দেশ বানানোর জন্য ডমিঙ্গো ফস্তিনো সারমিয়েন্তোর আহ্বানে ইউরোপ থেকে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ আর্জেন্টিনায় বিভিন্ন সময়ে পাড়ি জমায়।
৪০ লক্ষ সাদা চামড়ার ইউরোপীয় অভিবাসী আর্জেন্টিনাকে বানিয়ে নেয় তাদের হোমল্যান্ড। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়।

এভাবেই ২৫০ বছর পূর্বে যে দেশে সাদা-কালো মানুষের অনুপাত ছিলো প্রায় সমান, ২৫০ বছর পর সেটা দাঁড়ায় ৯৭:৩। আর্জেন্টিনা পরিণত হয় সাদা মানুষের দেশ হিশেবে।

দুই.

ব্রাজিল ছিলো পর্তুগালের উপনিবেশ, আর্জেন্টিনা ছিলো স্পেনের।
অর্থাৎ, উপমহাদেশে যেমন ব্রিটিশ রাজত্ব ছিলো, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় তেমনি ছিলো পর্তুগিজ-স্পেনীয় আধিপত্য।
স্পেনে মুসলিম শাসনের পতনের পর স্পেনকে মুসলিম মুক্ত করার জন্য নানান প্রকল্প নেয়া হয়।
তারমধ্যে একটি ছিলো স্পেন শাসিত কলোনীগুলোতে মুসলিমদের স্থানান্তর।
সেই ধারাবাহিকতায় স্পেনের কিছু মুসলিমদেরকে পাঠানো হয় আর্জেন্টিনায়।

আফ্রিকা থেকে যেসব মানুষকে দাস বানিয়ে আর্জেন্টিনায় নেয়া হয়েছিলো, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলো মুসলিম। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্য ও উসমানী খিলাফতের রাজধানী তুরস্কে থেকে অসংখ্য মুসলিম পাড়ি জমান আর্জেন্টিনায়। আরব ও তুরস্কের মুসলিমরা আর্জেন্টিনার সাদা চামড়ার সেন্সরে পার পেয়ে যান!

সেই সময় সিরিয়া-লেবাননের অনেকগুলো পরিবার আর্জেন্টিনায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে। আর্জেন্টিনায় বাড়তে থাকে মুসলিম অভিবাসী সংখ্যা। কয়েক প্রজন্ম পর আর্জেন্টিনায় সিরিয়ার একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন একজন্য ব্যক্তি, যিনি পরবর্তীতে আইনজীবি হোন, রাজনীতি করেন।

১৯৩০ সালে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা ব্যক্তিটি ১৯৬৬ সালে তার ধর্ম পরিবর্তন করে খ্রিস্টান হয়ে যান। কেনো তিনি খ্রিস্টান হোন? সেটার উত্তর দেন তার সাবেক স্ত্রী জুলেমা ইয়োমা। তিনি বলেন:

“কার্লোস সাউল মেনেম ১৯৬৬ সালে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন শুধু এই কারণে যে, তিনি আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হবেন।”

মসজিদ স্থাপন

১৯৮৯-১৯৯৯, সিরিয়ান বংশোদ্ভুত কার্লোস সাউল মেনেম আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।
বলা হয়ে থাকে যে, কার্লোস মেনেম প্রেসিডেন্ট হবার জন্য ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলেও মুসলিমদের প্রতি তিনি আন্তরিক ছিলেন।
তার শাসনকালে সৌদি আরবের সাথে আর্জেন্টিনার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে এবং সৌদি সরকার আর্জেন্টিনার মুসলিমদের জন্য একটি মসজিদ উপহার দেয়।
সৌদি সরকারের অর্থায়নে কার্লোস মেনেমের সময় মসজিদটি স্থাপিত হয় আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে।

আর্জেন্টিনার সরকার ১৯৯২ সালে মসজিদটি নির্মাণকালে ৩৪,০০০ বর্গমিটার জমি দান করেছিলো।
মসজিদটির নাম- কিং ফাহাদ ইসলামিক কালচারাল সেন্টার; যা দক্ষিণ অ্যামেরিকার সবচেয়ে বড়ো মসজিদ।
মসজিদটিতে একসাথে ১২০০ জন পুরুষ ও ৪০০ জন নারীর নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে।
২০১০ সালের পিউ রিসার্চ অনুসায়ী আর্জেন্টিনায় প্রায় ১০ লক্ষ মুসলিম বসবাস করে।
ইসলামিক সেন্টার অব নর্থ অ্যামেরিকার ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল ওয়াক্কাস সাঈদের মতে,

২০১০ সালের পিউ রিসার্চ অনুসায়ী আর্জেন্টিনায় প্রায় ১০ লক্ষ মুসলিম বসবাস করে। ইসলামিক সেন্টার অব নর্থ অ্যামেরিকার ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল ওয়াক্কাস সাঈদের মতে,

“লাতিন অ্যামেরিকায় ইসলাম চর্চা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ইউরোপের তুলনায় তুলনামূলক ভালো।”

আর্জেন্টিনায় মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকলেও বেশিরভাগের শিকড় থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন।
পর্যাপ্ত ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে তারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় ভুলতে বসেছে এবং অনেকেই নিজেদের মুসলিম পরিচয় নিয়ে সঙ্কোচবোধ করে।
বুয়েন্স আয়ার্সের মসজিদ গুলোতে জুমুআর নামাজে পর্যাপ্ত মানুষ পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন শায়খ ফারাজ রাব্বানী।
আর্জেন্টিনায় সফর শেষে তিনি তার সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি ভিডিও বানিয়েছেন-
‘How Islam Almost Disappeared from Argentina’

আর্জেন্টিনার মানুষ স্পেনিশ ভাষায় কথা বলে। এই ভাষায় পর্যাপ্ত ইসলামি কন্টেন্ট না থাকার কারণে আর্জেন্টিনার মুসলিমদের মধ্যে আস্তে আস্তে ইসলামের জ্ঞানের সাথে সংযোগ হারিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি অভিহিত করেন।

আরিফুল ইসলাম
৯ জুলাই ২০২১

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *