ডায়োড কি এবং ডায়োড কিভাবে কাজ করে?
আমরা যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা মোটামুটি সকলেই ডায়োড সম্পর্কে কিছু না কিছু জানি। আজ আমরা ডায়োড সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। তো চলুন শুরু করা যাক।
ডায়োড কি? (What is Diode?)
সঙ্গাঃ ডায়োড একটি দুই প্রান্তবিশিষ্ট ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস যা সার্কিটে কারেন্টকে একদিকে প্রবাহিত করে এবং বিপরীত দিক দিয়ে কারেন্ট যেতে বাধা দেয়।
এর একদিকের রোধ প্রায় শূন্য এবং বিপরীত দিকের রোধ অনেক অনেক বেশি। তাই বিপরীত দিক দিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত হতে পারেনা।
এতে দুটি ইলেকট্রোড থাকে, এর একটি হচ্ছে অ্যানোড এবং অপরটি ক্যাথোড। ডায়োড মূলত অর্ধপরিবাহী সিলিকন এবং জার্মেনিয়াম দিয়ে তৈরি।
একটি পি-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর এবং একটি এন-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করে ডায়োড তৈরি করা হয়। দুই সেমিকন্ডাক্টরের সংযোগস্থানকে p-n জাংশন বলে।
সেমিকন্ডাক্টর ডায়োডে p-রিজিওন এবং n-রিজিওন দুইটি ভিন্ন রিজিওন পাশাপাশি স্থাপন করে ডায়োড তৈরি করা হয়। ডায়োডের p-রিজিওনকে অ্যানোড এবং এবং n-রিজিওনকে ক্যাথোড বলে।
এই ডায়োড শুধু ফরওয়ার্ড বায়াসে কারেন্ট পরিবহন করে। রিভার্স বায়াসিং এ এটি কারেন্ট পরিবহন করে না। ডায়োড যেহেতু এক দিকে কারেন্ট প্রবাহিত করে তাই একে একমুখী সুইচ বলে।
সাধারণ ডায়োডের কাজ হল কারেন্টকে ফরোয়ার্ড ডিরেকশনে প্রবাহিত করা। অন্যদিকে কারেন্ট যদি রিভার্স ডিরেকশনে প্রবাহিত করানো হয় তখন এটি কারেন্টকে বাধা দেয়। এভাবে ডায়োড একমুখী হিসেবে কাজ করে।
ডায়োডের প্রতীক (Symbol of Diode)
উপরের ছবিতে ডায়োডের একটি প্রতীক দেখানো হয়েছে। ফরোয়ার্ড বায়াসের ক্ষেত্রে তীরচিহ্নটি কারেন্ট প্রবাহের দিক নির্দেশ করে। এখানে অ্যানোড কানেক্ট করা হয় ডায়োডের p সাইডের সাথে এবং ক্যাথোড কানেক্ট করা হয় n সাইডের সাথে।
আমরা সিলিকন বা জার্মেনিয়ামের সাথে ত্রিযোজী বা গ্রহীতা পরমাণু কিংবা পঞ্চযোজী বা দাতা পরমাণু ভেজাল হিসেবে মিশিয়ে p-n জাংশন ডায়োড তৈরি করতে পারি।এই ডোপিং সেমিকন্ডাক্টরে p-n জাংশন তৈরি করে।
এছাড়া p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর এবং n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর একসাথে যুক্ত করেও আমরা p-n জাংশন তৈরি করতে পারি। যে প্রান্তে p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর থাকে সে প্রান্তকে বলা হয় অ্যানোড আর যে প্রান্তে n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর থাকে সে প্রান্তকে বলা হয় ক্যাথোড।
ডায়োড যেভাবে কাজ করে (How Diode works)
একটি ডায়োড p-টাইপ এবং n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরের সমন্বয়ে কাজ করে। একটি p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে প্রচুর পরিমাণে হোল থাকে এবং খুবই নগন্য পরিমাণ মুক্ত ইলেকট্রন থাকে।
এজন্য p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে হোলকে বলা হয় মেজোরিটি চার্জ ক্যারিয়ার এবং মুক্ত ইলেকট্রনকে বলা হয় মাইনোরিটি চার্জ ক্যারিয়ার।
অপরদিকে একটি n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে প্রচুর পরিমাণে ইলেকট্রন থাকে এবং খুবই নগন্য পরিমাণ হোল থাকে। এজন্য n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে ইলেকট্রনকে বলা হয় মেজোরিটি চার্জ ক্যারিয়ার এবং হোলকে বলা হয় মাইনোরিটি চার্জ ক্যারিয়ার।
আনবায়াসড ডায়োড (Unbiased Diode)
যখন একটি এন-টাইপ অঞ্চল (Region) এবং একটি পি-টাইপ অঞ্চল পরস্পরের সংস্পর্শে আসে তখন ঘনত্বের পার্থক্যের কারণে, ব্যপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেজোরিটি চার্জ ক্যারিয়ারগুলি একপাশ থেকে অন্যপাশে চলে যায়।
হোলের ঘনত্ব পি-টাইপ অঞ্চলে বেশি এবং এন-টাইপ অঞ্চলে কম হওয়ায়, হোলগুলি পি-টাইপ অঞ্চল থেকে এন-টাইপ অঞ্চলের দিকে সরে যেতে থাকে।
একইভাবে, ইলেকট্রনের ঘনত্ব এন-টাইপ অঞ্চলে বেশি এবং পি-টাইপ অঞ্চলে কম হওয়ায়, ইলেকট্রনগুলি এন-টাইপ অঞ্চল থেকে পি-টাইপ অঞ্চলের দিকে সরে যেতে থাকে।
ফ্রি ইলেক্ট্রনগুলি ব্যপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এন-টাইপ অঞ্চল থেকে পি-টাইপ অঞ্চলের দিকে যায় এবং হোলের সাথে মিলিত হয়।
ফলে পি-টাইপ অঞ্চলে উন্মুক্ত নেগেটিভ আয়ন সৃষ্টি হয়। একইভাবে, হোলগুলি ব্যপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পি-টাইপ অঞ্চল থেকে এন-টাইপ অঞ্চলের দিকে যায় এবং ইলেকট্রনের সাথে মিলিত হয়। ফলে এন-টাইপ অঞ্চলে উন্মুক্ত পজিটিভ আয়ন সৃষ্টি হয়।
এইভাবে, পি-টাইপ অঞ্চলে নেগেটিভ আয়নের একটি স্তর তৈরি হয় এবং এন-টাইপ অঞ্চলে পজিটিভ আয়নের একটি স্তর তৈরি হয় যা পি টাইপ এবং এন টাইপ সেমিকন্ডাক্টরের সংযোগ স্থলের মাঝখানে অবস্থান করে।
উন্মুক্ত পজিটিভ আয়নের স্তর এবং উন্মুক্ত নেগেটিভ আয়নের স্তরটি ডায়োডের মাঝখানে এমন একটি অঞ্চল (Region) তৈরি করে যেখানে কোনও চার্জ ক্যারিয়ার থাকেনা। চার্জ ক্যারিয়ারের অভাবের কারণে এই অঞ্চলটিকে ডিপ্লেশন অঞ্চল এবং এই লেয়ারকে বলা হয় ডিপ্লেশন লেয়ার।
ডিপ্লেশন অঞ্চল তৈরি হয়ে গেলে একপাশে থাকে আরেকপাশে যাওয়ার মত আর কোন চার্জ অবশিষ্ট থাকেনা। এর কারণ হচ্ছে ডিপ্লেশন অঞ্চলজুড়ে ইলেকট্রিক ফিল্ডের প্রভাব যা চার্জ ক্যারিয়ারের একদিক থেকে অন্য দিকে স্থানান্তরকে বাধা দেয়।
ফরোয়ার্ড বায়াসিং (Forward Biasing)
ডায়োডের p-n জাংশনের p প্রান্তের সাথে পজিটিভ সোর্স এবং p-n জাংশনের n-প্রান্তের সাথে নেগেটিভ সোর্স সংযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে ফরোয়ার্ড বায়াসিং বলে। এর ফলে সোর্স ভোল্টেজ পটেনশিয়াল ব্যারিয়ারকে অতিক্রম করে এবং জাংশনে কারেন্ট প্রবাহিত হয়।
যদি কোন ভোল্টেজ সোর্সের পজিটিভ প্রান্তের সাথে ডায়োডের p-প্রান্ত এবং ভোল্টেজ সোর্সের নেগেটিভ প্রান্তের সাথে ডায়োডের n-প্রান্ত সংযুক্ত করি এবং সোর্স ভোল্টেজ শূন্য থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে বৃদ্ধি করতে থাকি।
তখন সেখানে তড়িৎ ক্ষেত্র (ইলেকট্রিক্যাল ফিল্ড) বিদ্যমান থাকার পরও শুরুর দিকে আমরা সেখানে কোন কারেন্ট ফ্লো বা কারেন্ট প্রবাহ দেখতে পাবোনা। কেননা মেজোরিটি চার্জ ক্যারিয়ারগুলোর ডিপ্লেশন লেয়ার ভাঙার মত পর্যাপ্ত শক্তি পায়না।
এই ডিপ্লেশন লেয়ারকেই বলা হয় পটেনশিয়াল ব্যারিয়ার যা মেজোরিটি চার্জ ক্যারিয়ারের বিরুদ্ধে কাজ করে। আর এই পটেনশিয়াল ব্যারিয়ারকেই বলা হয় ফরোয়ার্ড পটেনশিয়াল ব্যারিয়ার।
মেজোরিটি চার্জ ক্যারিয়ারগুলি তখনই পটেনশিয়াল ব্যারিয়ার অতিক্রম করে যেতে পারে যখন সোর্স ভোল্টেজের মান ফরোয়ার্ড পটেনশিয়াল ব্যারিয়ার এর চেয়ে বেশি হয়।
সিলিকনের ক্ষেত্রে ফরোয়ার্ড পটেনশিয়াল ব্যারিয়ার হল 0.7 ভোল্ট এবং জার্মেনিয়ামের এর ক্ষেত্রে এটি 0.3 ভোল্ট। যখন সোর্স ভোল্টেজ ফরোয়ার্ড পটেনশিয়াল ব্যারিয়ারে চেয়ে বেশি হয় তখন মুক্ত অবস্থায় থাকা মেজোরিটি চার্জ ক্যারিয়ারগুলি পটেনশিয়াল ব্যারিয়ার অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে কারেন্ট প্রবাহ শুরু করে দেয়।
এ ক্ষেত্রে ডায়োডটি শর্ট সার্কিট হিসেবে কাজ করে এবং কারেন্ট প্রবাহ কন্ট্রোল করার জন্য আলাদা রেজিস্টরের প্রয়োজন পড়ে।
রিভার্স বায়াসিং (Reverse Biasing)
ডায়োডের p-n জাংশনের p প্রান্তের সাথে নেগেটিভ সোর্স এবং p-n জাংশনের n-প্রান্তের সাথে পজিটিভ সোর্স সংযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে রিভার্স বায়াসিং বলে। এর ফলে সোর্স ভোল্টেজ পটেনশিয়াল ব্যারিয়ারকে অতিক্রম করে এবং এ কারণে জাংশনে কারেন্ট প্রবাহিত হতে পারেনা।
যদি কোন ভোল্টেজ সোর্সের নেগেটিভ প্রান্তের সাথে ডায়োডের p-প্রান্ত এবং ভোল্টেজ সোর্সের পজিটিভ প্রান্তের সাথে ডায়োডের n-প্রান্ত সংযুক্ত করি এবং সোর্স ভোল্টেজ শূন্য থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে বৃদ্ধি করতে থাকি।
তখন সোর্সের নেগেটিভ ভোল্টেজের কারনে সেখানে ইলেকট্রোস্ট্যাটিক আকর্ষণের সৃষ্টি হয়। ফলে পি টাইপ অঞ্চলের হোলগুলি জাংশন থেকে আরও দূরে সরে যায় এবং জাংশনে আরও উন্মুক্ত নেগেটিভ আয়ন তৈরি হয়।
একইভাবে, এন টাইপ অঞ্চলের মুক্ত ইলেকট্রনগুলি জাংশন থেকে আরও দূরে সরে যায়। ফলে জাংশনে আরও উন্মুক্ত পজিটিভ আয়ন তৈরি হয়।
উপরোক্ত ঘটনার ফলে ডিপ্লেশন এরিয়া আরো প্রশস্ত হয়। ডায়োডের এই অবস্থাকেই রিভার্স বায়াস বলা হয়। এই অবস্থাতে কোন মেজোরিটি ক্যারিয়ার ডায়োডের পি এন জাংশন অতিক্রম করতে পারেনা বরং তারা জাংশন থেকে আরো দূরে চলে যায়।
সুতরাং আমরা বলতে পারি কোন ডায়োড রিভার্স বায়াসে কানেক্ট করা হলে ডায়োডের ভিতর দিয়ে কোন কারেন্ট প্রবাহ চলতে পারেনা।
তবে রিভার্স বায়াসে যদি নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি ভোল্টেজ অর্থাৎ ডায়োডের সহ্য ক্ষমতার চেয়ে বেশি ভোল্টেজ এপ্লাই করা হয় তখন ডায়োডের ডিপ্লেশন এরিয়া ভেঙে যায় এবং অধিক মাত্রায় কারেন্ট প্রবাহিত হয়।
এই প্রবাহ যদি আলাদা রেজিস্টর দ্বারা নিয়ন্ত্রন করা না হয় তবে ডায়োডটি স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ডায়োডের প্রকারভেদ (Types of Diode)
নিচে বিভিন্ন ধরনের ডায়োডের নাম দেওয়া হলঃ
- সেমিকন্ডাক্টর ডায়োড
- লাইট এমিটিং ডায়োড
- জেনার ডায়োড
- টানেল ডায়োড
- ক্রিস্টাল ডায়োড
- ফটো ডায়োড
- পিন ডায়োড
ডায়োডের বৈশিষ্ট্য(Characteristics of Diode)
সাধারণত একটি ডায়োডে নিচের বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে।
- ফরোয়ার্ড বায়াসে শূন্য রেজিস্ট্যান্স দেখায়।
- রিভার্স বায়াসে অসীম রেজিস্ট্যান্স দেখায়।
- দুইটি স্টেবল অন এবং অফ স্টেট থাকে।
ডায়োডের ব্যবহার (Uses of Diode)
ডায়োডের ব্যবহার নিচে দেওয়া হলঃ
- রেকটিফায়ার হিসেবে কাজ করে।
- ডিটেক্টর হিসেবে কাজ করে।
- সুইচ হিসেবে কাজ করে।
- ওয়েভ শেপিং সার্কিটে ব্যবহার করা হয়।
- মডুলেশন হিসেবে কাজ করে।
- রিভার্স ভোল্টেজ প্রটেকশন হিসেবে কাজ করে।
- হাই ভোল্টেজ প্রটেকশন হিসেবে কাজ করে।
- ক্লাম্পিং
- ক্লিপিং
- লজিক সার্কিটে ব্যবহার করা হয়।