মেসোপোটেমীয় সভ্যতা, এর কৃষি, নদনদী ও নগর পরিকল্পনা

মধ্যপ্রাচ্যে মরুভূমি ও শুষ্ক স্তেপ অঞ্চলের সংখ্যা অনেক। এর উপর নদী ও তার প্রভাবে অধিক উর্বর উপত্যকাও সেখানে আছে। এ এলাকার দুটি বড় নদীর মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ উপত্যকা : নদী দুটির নাম ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রিস, আর ঐ দোয়াব অঞ্চলের দেশটি হলো – মেসোপোটেমিয়া।

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে ইরাকে ফোরাত (টাইগ্রিস) ও দজলা (ইউফ্রেটিস) নদীর উর্বর তীরাঞ্চলে মেসোপটেমীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা। এদের ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকলেও একই ভূখন্ডে গড়ে উঠায় একত্রিতভাবে এ সভ্যতা সমূহকে বলা হয় মেসোপটেমীয় সভ্যতা। মেসোপোটেমিয়া একটি গ্রিক শব্দ।

আক্ষরিক অর্থে ‘মেসো’ অর্থ মধ্যবর্তী এবং ‘পটাম’ অর্থ নদী। এর মানে মেসোপোটেমিয়া অর্থ দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল।

মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অবস্থান

মেসোপটেমীয় সভ্যতা ৫০০০ খৃষ্টপূর্বে সূচনা হয়ে প্রায় খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে পরিপূর্ণতা লাভ করে। এ সভ্যতা আরব মরুভূমির উত্তরে অবস্থিত অর্ধচন্দ্রকার উর্বর ভূমির অন্তর্গত। এ অঞ্চলটি উর্বর অর্ধচন্দ্র নামেও পরিচিত।

পূর্বে টাইগ্রিস এবং পশ্চিমে ইউফ্রেটিস নদী দুটির মধ্যস্থান ও নিচের এলাকা জুড়ে মেসোপোটেমিয়ার অবস্থান। উওরের আর্মেনিয়া পার্বত্যভূমি ও পূর্বের এলাম পার্বত্যভূমি এলাকাটিকে ঘিরে রেখেছে। দক্ষিণ পূর্বে পারস্য উপসাগর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে আরবের মরু এলাকা অবস্থিত।

মেসোপটেমিয়া নামে কোন একক সভ্যতা পাওয়া যায় না কারণ মেসোপোটেমিয়ার উওর অংশের নাম সিরিয়া এবং দক্ষিণের নাম ব্যাবিলনিয়া। ব্যাবিলনিয়ার উওরাংশের নাম আক্কাদ ও দক্ষিণাংশের নাম সুমেরু।

অধুনিক তুরস্ক,ইরান, ইরাক,কুয়েত ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলো মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত ছিল বলে মনে করা হয় । তবে বেশিরভাগ বর্তমানে ইরাকে অবস্থিত।

মেসোপটেমীয় সভ্যতা 

মেসোপোটেমিয়া সভ্যতাকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো –

  • সুমেরীয়
  • ব্যাবিলনীয়
  • অ্যাসেরীয় ও
  • ক্যালেডীয় সভ্যতা।

সুমেরীয় সভ্যতা

সুমেরীয়গণ মেসোপোটেমিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। সুমেরীয়দের আদিবাস ছিল এলেমের পাহাড়ি অঞ্চলে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে এদের একটি শাখা মেসোপোটেমিয়ার দক্ষিণে বসতি গড়ে তোলে। এদের আয়ের মূল উৎস ছিল কৃষি। এরা উন্নত সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এরা কিউনিফর্ম নামে নতুন এক লিপির উদ্ভাবন করে। এ লিপিতে লিখা হয় বিখ্যাত মহাকাব্য গিলগামেশ।

জলঘড়ি ও চন্দ্রপঞ্জিকার আবিষ্কারও এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সভ্যতায় সুমেরীয়দের সবচেয়ে বড় অবদান চাকা আবিষ্কার। সুমেরীয় শাসক উর-নামু সর্বপ্রথম পৃথিবীর ইতিহাসে লিখিত আইনের প্রবর্তন করেন যা “Code of Ur-Nammu” নামে পরিচিত।

ব্যাবিলনীয় সভ্যতা

সুমেরীয় শাসক ডুঙ্গির মৃত্যুর পর এবং ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আগেই সুমেয় ইলামাইটদের অধিকারে চলে যায়।  পরে ১৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আরব মরুভূমি থেকে এক সেমেটিক গোষ্ঠী এ অঞ্চলে  আধিপত্য  বিস্তার করে। তারায় ব্যাবিলন নামক সভ্যতার পত্তন ঘটায়।

এ ব্যাবিলন সভ্যতার স্থপতি ছিলেন বিখ্যাত আমোরাইট নেতা হাম্বুরাবি। হাম্বুরাবি লিখিত আইন প্রবর্তন করেন যা “হাম্বুরাবি কোড” নামে পরিচিত। পৃথিবীর প্রাচীনতম মানচিত্র পাওয়া যায় ব্যাবিলনের উওরের গাথুর শহরের ধ্বংসাবশেষে।

অ্যাসেরীয় সভ্যতা

ব্যাবিলন থেকে প্রায় ২০০ মাইল উওরে টাইগ্রিস নদীর তীরে আশুর নামে একটি সমৃদ্ধ শহর গড়ে উঠে। এটিই অ্যাসেরীয় সভ্যতা। ইতিহাসে এর পরিচয় সামরিক রাষ্ট্র হিসেবে।

এরাই প্রথম লোহার অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী গঠন করে এবং যুদ্ধরথের ব্যবহার করে। এরাই প্রথম বৃত্তকে ৩৬০° ও পৃথিবীকে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে ভাগ করেছিল।

ক্যালেডীয় সভ্যতা

ব্যাবিলন শহরকে কেন্দ্র করে ক্যালেডীয় সভ্যতা গড়ে উঠায় এ সভ্যতা ইতিহাসে ব্যাবিলনীয় সভ্যতা নামেও পরিচিত। এ সভ্যতার স্থপতি ছিলেন সম্রাট নেবুচাদনেজার। তিনি সম্রাজ্ঞীর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য নগর দেওয়ালের উপর এক মনোরম উদ্যান নির্মাণ করেন। ইতিহাসে যা “ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান” নামে পরিচিত। প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে এটি একটি।

ক্যালডীয়রায় প্রথম সপ্তাহকে ৭ দিনে ভাগ করে। আবার প্রতিদিনকে ১২ জোড়া ঘন্টায় ভাগ করার পদ্ধতি তারা বের করে। ক্যালেডীয়রা ১২ টি নক্ষত্রপুঞ্জের সন্ধান পান। তা থেকে ১২ টি রাশিচক্রের সৃষ্টি হয়।

কৃষিকাজ

প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় কৃষিকাজই ছিল প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের দিকে মেসোপোটেমীয়রা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর জলকে কৃষি কাজের জন্য ব্যবহার করতে থাকে। মাটি উর্বর হওয়ায় দক্ষিণ মেসোপোটেমিয়া কৃষিকর্মের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হয়ে উঠে। খ্রিস্টপূর্ব ৭-৬ সহস্রাব্দে মেসোপোটেমিয়ানরা কৃষিকাজে কোদাল ব্যবহার করত, গরু, ছাগল, ভেড়া পালত।

কিন্তু শুষ্ক আবহাওয়া ও বৃষ্টি না হওয়ায় নদীর অববাহিকা থেকে অনেক দূরের জমিগুলিতে ফসল ফলানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া প্লাবনের সময় ছিল অনিয়মিত এবং প্রকৃতি ছিল খেয়ালি। গ্রীষ্মে এখানে প্রচুর খরা দেখা দিত। তাই কৃষির জন্য সেচ ব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজন ছিল।

তবুও এত কষ্টেও মানুষ নতি স্বীকার করে নি। এ কারণে, এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের একটি দক্ষ সেচ ব্যবস্থা তৈরি করতে হয়েছিল যা তাদের জমিতে জল আনতে পারে। আর এই সেচ উন্নয়নে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ছাড়াও মেসোপটেমিয়ানরা ছিলেন চাকা এবং লাঙলের আবিষ্কারক। এঁটেল মাটি লাঙলের দ্বারা চাষ করত। তাছাড়া উভয় উপাদান ব্যবহার করে, তারা আরও সহজে জমি চাষ করতে সক্ষম হয়েছিল। জলাভূমিতে জন্মানো আগাছা ও মাটি দিয়ে তারা কুঁড়েঘর বানাত।

তাদের উৎপাদিত প্রধান ফসল ছিল যব। তাছাড়া এখানে সর্বাধিক প্রচলিত পণ্যগুলির মধ্যে ছিল বার্লি, গম, রাই বা তিল, জলপাই গাছ, খেজুর বা আঙ্গুর ইত্যাদি। গম আর যব পেকে থাকত মাঠে মাঠে। জনপদের চারপাশে ঘিরে থাকত খেজুর গাছের সবুজ সমারোহ।

অধিকাংশ চাষী ও কারিগরই ধনী ব্যক্তিদের নিকট ঋণ জালে আবদ্ধ থাকতো। দরিদ্র যেসব লোকের কোন জমি ছিল না, তারা ধনীদের জমি ইজারা নিত। ইজারাদাররা ক্ষেতে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক এবং ফলবাগানের দুই-তৃতীয়াংশ ফলমূল দিতে বাধ্য থাকতো।

এই মেসোপটেমিয়ায়, কৃষি পণ্য এবং মজাদার প্রজনন, ফিশারি, খেজুরের চাষ এবং খড় শিল্পগুলি – সংক্ষেপে, শস্য, শাকসবজি, মাংস, চামড়া, উল, শিং, মাছ, খেজুর, খড় এবং উদ্ভিদ-আঁশজাতীয় পণ্যগুলি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এবং বাড়ির প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি পণ্য রপ্তানি করা হতো। এভাবে তারা প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতো।

নদনদী

মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার অন্যতম দুটি নদী হচ্ছে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস । এ সভ্যতার মূল ভিত্তিই হচ্ছে এ দুটো নদী। নিম্নে এ দুটি নদী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –

টাইগ্রিস নদীঃ এটি দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার একটি নদী। এর আরেক নাম হলো ফোরাত। এটি তুরস্কে উৎপত্তি লাভ করে সিরিয়া ও ইরাকের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দজলা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে এবং শাত আল আরব নামে পারস্য উপসাগরে পতিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ২৮০০ কিলোমিটার এবং আয়তন ৪,৪০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এ নদী প্রতিবছর ২৮০০ কোটি ঘনমিটার পানি বহন করে।

ইউফ্রেটিস নদীঃ এটিও দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার নদী। এ নদীর অন্য নাম দজলা। এর দৈর্ঘ্য ১,৯০০ কিলোমিটার ও আয়তন ১,১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এটি পূর্ব তুরস্কের পর্বতমালায় উৎপত্তি লাভ করেছে।

প্রাচীনকালে এই ফোরাত ও দজলার মধ্যবর্তী অববাহিকাতেই বিখ্যাত সভ্যতা মেসোপোটেমিয়া বিকাশ লাভ করেছিল। অনেক সময় এ দুটি নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার সৃষ্টি হত। এতে এ সভ্যতার মানুষের ধন-সম্পদ, যান মাল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হত। তাছাড়া এ নদীগুলোর জনশক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন যন্ত্র (জলবিদ্যুৎ, গিয়ারের যন্ত্র ইত্যাদি) আবিষ্কার করত।

নগর পরিকল্পনা 

মেসোপোটেমিয়ার নিম্নাঞ্চলের সমতলে ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের শেষের দিকে কিছু জনগোষ্ঠী বসতি গড়ে তোলে। এভাবেই ইতিহাসখ্যাত মেসোপোটেমীয় নগররাষ্ট্র উর, উরুক,নাগাস, লারসা ইত্যাদির উন্মেষ ঘটে।

তাছাড়া এ সভ্যতার প্রত্যেকটি শহরের কেন্দ্র ছিল দুর্গবেষ্টিত। দুর্গের দেয়াল ছিল রোদে শুকানো ইট দ্বারা নির্মিত। উরুক শহরে ৬ মাইল দীর্ঘ দুর্গবেষ্টিত একটি অঞ্চল ছিল। অনেকের ধারণা উরুকের কিংবদন্তির বীর রাজা গিলগামেশ কর্তৃক তা নির্মিত হয়েছে। তাছাড়া পাহাড় সদৃশ সিঁড়ির ধাপ কেটে মন্দির তৈরি করা হত। এ মন্দিরকে বলা হত জিজুরাত।

সুমেরীয় শহর আবিষ্কার প্রাথমিক মেসোপটেমিয়ানদের জীবনকে আলোকিত করেছিল। হরপ্পান কেন্দ্রগুলির তুলনায় মেসোপটেমিয়ার শহরগুলি শহর পরিকল্পনার তুলনায় খুব কম ছিল, তবুও তারা অভিন্ন প্যাটার্ন অনুসরণ করেছিল। শহরটি তিন ভাগে বিভক্ত ছিল –

  • পবিত্র অঞ্চল
  •  প্রাচীরের শহর এবং
  •  বাইরের শহর।

পবিত্র অঞ্চলটি মন্দিরের টাওয়ার বা শহরের পৃষ্ঠপোষক ঈশ্বরকে উৎসর্গীকৃত জিগ্গারাট নিয়ে গঠিত। অন্যান্য দেবতাদের ছোট ছোট মন্দিরও ছিল। এই অঞ্চলে স্টোরহাউজের পাশাপাশি অফিস ছিল। প্রাচীরের শহর এবং বাইরের শহর অঞ্চলে লোকেরা বাস করত। রাস্তাঘাটে ঘরগুলি তৈরি করা হয়েছিল এবং প্রতিটি বাড়ির কেন্দ্রীয় উঠোন ছিল। উঠানের চারপাশে ঘর সংযুক্ত ছিল।

সুমেরীয়রা প্রথম সমাজ যেটি শহরটির একটি বিল্ট এবং উন্নত রূপ হিসাবে তৈরি করেছিল। তারা এই কৃতিত্বের জন্য গিলগামেশের মহাকাব্যতে প্রমাণিত হিসাবে গর্বিত ছিল, যা উরুকের দেয়াল, রাস্তা, বাজার, মন্দির এবং উদ্যানগুলির বর্ণনা সহ খোলে। উরুক নিজেই একটি নগর সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ যা পশ্চিম এশিয়া উভয়ভাবে উপনিবেশিক ও নগরায়ন করেছিল।

নীলিথিক বিপ্লব শুরু হওয়া শহরগুলির নির্মাণ প্রবণতার অন্তিম পণ্য ছিল। শহরের বৃদ্ধি আংশিক পরিকল্পিত এবং আংশিক জৈব ছিল। দেয়াল, উচ্চ মন্দির জেলা, বন্দর সহ প্রধান খাল এবং প্রধান রাস্তায় পরিকল্পনাগুলি স্পষ্ট।

উপসংহার

এক কথায় বলা যায় যে, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নদীমাতৃক সভ্যতা হিসেবে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা বিকাশ লাভ করে এবং ক্যালডীয় সভ্যতার পতনের মধ্য দিয়ে এ সভ্যতার সমাপ্তি ঘটে। বিশ্বসভ্যতায় এর প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক, তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *